মুখবন্ধ খামদুটো নিয়ে শুভঙ্কর স্থাণুবৎ বসে আছে। খোলার কোনো ইচ্ছেই নেই। ওর ভেতরে কী আছে আজ ও জানে। দুটো খামের ওপরেই জ্বলজ্বল করছে ডা.শুভঙ্কর স্যান্যালের নাম। একটায় নবান্নর ছাপ স্পষ্ট আর অন্যটায়—-
রোজকার মতোই সকাল ন’টায় সেদিন বেরিয়েছিল শুভঙ্কর। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভার প্রাণেশ গাড়ি চালাচ্ছিল, ওয়াইপার গাড়ির সামনের কাচ পরিষ্কার করে দিচ্ছে। বাইপাসে আজ গাড়ির ভীড় একটু কম। হঠাৎই সায়েন্স সিটি পার হতেই চোখে পড়ল দৃশ্যটা।
হেলমেট এখনো মাথায় আছে, বাইক একপাশে, ছেলেটা আর এক পাশে। গাড়িগুলো উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে। শুভঙ্করের গাড়ীও এগিয়ে গিয়েছিল,”এই দাঁড়াও প্রাণেশ।” গাড়ি থামিয়ে ছুটে গেল শুভঙ্কর। ইয়ং ছেলে কতই বা বয়েস, বাইশ-তেইশ হবে।যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দুজনের চেষ্টায় গাড়িতে ওঠানো হলো। শুভঙ্কর সোজা গাড়ি ঢোকাল বাইপাসের ধারে এক হাসপাতালে। এখানে ও নিজেও যুক্ত আছে।
তাড়াতাড়ি এমার্জেন্সীতে নিয়ে গিয়ে ভর্তির নির্দেশ দিল শুভঙ্কর। ওর রেজিস্টার অয়নকে যাবতীয় এমার্জেন্সী অ্যাটেন্ড করতে বলে ফিরে গিয়ে ওর নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে এ.সি টা একটু বাড়িয়ে দিল, “আজকালকার ছেলেরা বাইক নিয়ে কেন যে একটু সাবধানী হয় না!”
“মে আই কাম ইন ”
“ইয়েস কাম ইন ”
হাসপাতালের সি.ই.ও. মি.দত্ত ঢুকলেন, “স্যার ফার্স্ট-এইড দিয়ে সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই?”
“কেন? অ্যাডমিট করুন, আই উইল অপারেট।”
বলতে বলতে হৈ হৈ করে কিছু ছেলে ঢুকে পড়ল,”হোয়্যার ইজ শুভঙ্কর ডাক্তার? শালা গাড়িতে ধাক্কা মেরে ফেলে এখন বলছে সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে।”
“কি বলছেন!”
“ঠিক বলছি! আমরা অনেকেই দেখেছি ওঁর গাড়ি বাইকে ধাক্কা মেরেছে। না হলে আজকাল কোনো ডাক্তার রাস্তা থেকে তুলে এই হাসপাতালে নিয়ে আসবে?”
শুভঙ্করের মনে পড়ছিল ড্রাইভার প্রাণেশের সাবধানবাণী, “স্যার, কী দরকার?”
রাশভারী শুভঙ্কর শুধু বলেছিল, “প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা আমি পছন্দ করি না।”
এর মধ্যেই দুজন পুলিশ অফিসারের প্রবেশ, “স্যার, ছেলেটির দাদা একটা এফ.আই.আর. করেছে, একটু যদি থানায় আসেন, আপনার বয়ানটা দরকার”।
“আমার দুটো ও.টি. আছে, শেষ করে বিকালবেলা যেতে পারি।”
“ওকে স্যার।”
ও.টি. শেষ করে, রেস্ট-রুমে শুভঙ্কর। একটু আগেই ছেলেটির দাদার মুষ্টিবদ্ধ হাত টেবিল ঠুকে বলে গেছে, ছেলেটির অপারেশন যেন এখানেই হয় আর তার যাবতীয় খরচ শুভঙ্করকেই দিতে হবে।
“আসুন স্যার”—ছেলেগুলো পুলিশ অফিসারকে নিয়ে শুভঙ্করের ঘরে ঢুকল। পুলিশ অফিসার শুভঙ্করের দিকে হাত বাড়ালো, “স্যরি ডাক্তার স্যান্যাল, আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। ছেলেটি প্রচণ্ড স্পিডে টার্ন নিতে গিয়ে স্কীড করেছে। পাশ দিয়ে চার পাঁচটা গাড়ি চলে যাবার পর আপনার গাড়ি থামলো।”
শুভঙ্কর চুপচাপ বসে আছে। কিছু পূর্বের মুষ্টিবদ্ধ হাত এখন জোড়হাত, “স্যার, সরকারি হাসপাতালে পাঠাবেন না। ও তাহলে মরে যাবে। আপনি প্লিজ এখানেই অপারেশন করুন।”
“স্যার, ইমপ্ল্যান্ট, ওষুধ মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশ তো এখুনি লাগবে”–অয়নের প্রাথমিক হিসাব।
“একটা কিছু ব্যবস্থা করুন স্যার।”
“শোনো, আমার কাছে কিছু ওষুধ ফিজিসিয়ান স্যাম্পল আর একটা ইমপ্ল্যান্ট আছে, তোমরা যদি চাও
“আপনি স্যার, আমাদের বাপ,মানে বাপের মতো”—শুভঙ্করের কথা শেষ করার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটির দাদা, “ছেলেটাকে বাঁচান স্যার।”
“কাল সকালে তাহলে ও.টি. রাখো অয়ন। নেসেসারি ইনভেস্টিগেশন এর মধ্যে করিয়ে নিও। একটু দেখো যতটা প্রয়োজন। ওরা বেশি পারবে না।”
ও.টি.টা নির্বিঘ্নেই হয়েছিল। কিন্তু রোডস়াইড অ্যক্সিডেন্ট, কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার। ইনফেকশন পিছু ছাড়ল না। সেপ্টিসিমিয়া এবং তারপর শুভঙ্করের বিদ্যাবুদ্ধিকে ফাঁকি দিয়ে ছেলেটা চলে গেল। বডিটা নিয়ে যাবার সময় ওর দাদার জোড় করা হাত কোমরে এসেছিল, চোখের দৃষ্টিতেও একটা দেখে নেওয়া ভাব।
শুভঙ্করের মনটাও ক’দিন ভালো ছিল না। কিন্তু হঠাৎই একটা চিঠি শুভঙ্করকে হতচকিত করে দিল। ক্রেতা-সুরক্ষা দপ্তরের চিঠিতে জানানো হয়েছে পেসেন্ট অসিত মণ্ডলের চিকিৎসায় চূড়ান্ত গাফিলতিতে মৃত্যুর জন্য তার দাদা ডাক্তার শুভঙ্কর স্যান্যালের কাছে তিরিশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। কেস নম্বর ৬৩৬ এর ও.পি.নম্বর ওয়ান ডা. শুভঙ্কর স্যান্যালকে এই মর্মে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে।
সবাই বলল, দাদা, একজন ভালো ল’ইয়ার নিন। কিন্তু শুভঙ্করের এক কথা ,”চিকিৎসা করেছি আমি, কোনো ত্রুটি হয়নি আমি জানি, আমার হয়ে কোনো উকিল কি জানবে আর কীই বা বলবে।
যথারীতি কোর্টের সওয়াল জবাবে ও পক্ষের উকিল গুগলের গুগলীতে শুভঙ্করকে প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলল।
“আচ্ছা, ডা. স্যান্যাল, চিকিৎসায় যেসব ওষুধ ব্যবহার করেছেন, তার ক্যাশমেমো, ব্যাচনাম্বার সব দেখাতে পারবেন?”
“না, মানে পেসেন্ট-পার্টি–”
“আপনি হ্যাঁ কিম্বা না বলুন”
“না, ওগুলো ফিজিসিয়ান স্যাম্পল ছিল।”
“বেশ, বেশ! আচ্ছা যে ইম্প্ল্যান্ট ব্যাবহার করেছিলেন, তার পেপার নিশ্চয়ই সব আছে?”
“ধর্মাবতার, আমি একবার পেসেন্টের দাদাকে ডাকতে চাই।”
দাদা এজলাসে জানিয়ে দিল আমি ভাইকে বাঁচাতে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা দিতে ডাক্তারবাবুকে বলেছিলাম।
“ধর্মাবতার, চিকিৎসার জন্য ন্যূনতম কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন না ডা শুভঙ্কর স্যান্যাল। ওষুধ, ইম্প্ল্যান্ট সব নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করেছেন। নিয়মকানুন কিছছু মানেন নি।”
“স্যার, পেসেন্টকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম”–কোনোরকমে কান্না চাপলেন ডা স্যান্যাল।
“বাঃ,আপনি রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছেন বলে, মারার অধিকারও পেয়ে গেছেন নাকি!”
বিচার শেষ। একমাস বাদে পরবর্তী শুনানিতে রায় ঘোষণা। বিধ্বস্ত শুভঙ্কর বুঝেই গেছে মামলার ফল।নিজের ওপর সব আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ঘরে ঢুকে টলতে টলতে এসে শুয়ে পড়ল। এতদিনের সঙ্গী পারমিতা ওকে এরূপে কোনো দিন দেখে নি।
আজ প্রায় সাতদিন হলো স্যান্যালবাড়ির আলো জ্বলে নি। দুটো মিনিবাসের রেষারেষিতে ফুটপাতে উঠে এসে যাদবপুরের কৃতি ছাত্র সুধন্যকে পিষে দিয়ে চলে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাবার ফুরসৎ দেয় নি।
মিডিয়ায় ক’দিন হৈ চৈ, যাদবপুরে কালো ব্যাজ আর মুখ্যমন্ত্রীর মৃতজনদের তিনলাখ টাকা সরকারি ক্ষতিপূরণ ঘোষণার পর ধীরে ধীরে সব শান্ত। শুধু শুভঙ্কর আর পারমিতা মুখোমুখি বসে থাকে, সুধন্য এই বাড়িরই ছেলে।
আজ তাই লেটার বক্স থেকে খামদুটো ড্রাইভার প্রাণেশ দিয়ে যাবার পর থেকেই শুভঙ্কর চিঠিদুটো নিয়ে বসে আছে। নবান্নের চিঠিতে এক সম্পূর্ণ সুস্থ যুবকের সরকারি মূল্য তিন লক্ষ টাকা, আর ক্রেতা সুরক্ষায় এক আহত, ক্রিটিক্যালি অসুস্থ ছেলেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টার শেষে মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ ত্রিশ লাখ টাকা।
প্রাণেশ আলো জ্বালতে গেলে শুভঙ্কর আর পারমিতা দুজনেই চিৎকার করে উঠলো,–
“আলো নয়।”
****
এ লেখাটি মৃত্যুর মূল্যায়ন নয়। কোনো মৃত্যুর কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ হয় না। এ লেখা চিকিৎসাকে পণ্য করে ক্রেতা-সুরক্ষায় বন্দী করার বিরুদ্ধে।
আজকের দিনেও অধিকাংশ চিকিৎসক, হ্যাঁ আবার বলছি অধিকাংশ চিকিৎসক আমাদের দেশে রোগ ও রুগীর চিকিৎসা করেন।
ক্রেতা সুরক্ষা,– চিকিৎসা কতদূর ত্রুটিমুক্ত করতে পেরেছে জানি না, কিন্তু রুগী-চিকিৎসক-এর সম্পর্কের ওপরে বড় আঘাত এনেছে।
যাঁর হাতে জীবন তুলে দিচ্ছি সেখানে আস্থা আর বিশ্বাসই আসল সুরক্ষা। আশা রাখি, ক্রেতা সুরক্ষা সরে গিয়ে আসল সুরক্ষা ফিরে আসবে রুগী ও চিকিৎসকের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থায়।