ঢাকার লোকেরা নাকি ঘোড়া আর গুঁড়া একই ভাবে উচ্চারণ করে। এ নিয়ে বেশ মজা করে একটা কথা বলা হয়। সেখানে লাফিয়ে চলা ঘোড়াকে বলা হয়েছে, “লাফাইন্য গুড়া”। আমি কিন্তু গুঁড়া বলতে কোন কিছুর চূর্ণ বলতে যা বোঝায় তাই নিয়ে কিছু বলতে চাইছি।
আমরা খুব ছোট বেলা থেকে জানি, পিঠা বানাতে চালের গুঁড়া লাগে। তখন চালের গুঁড়া বললেই আমরা বুঝতাম, ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করা। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই ঢেঁকি ছিল। পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে সব বাড়িতেই চালের গুঁড়া তৈরী শুরু হত। পৌষ সংক্রান্তি আসার দু’ তিনদিন আগে থেকেই পিঠা বানানো শুরু হত সব বাড়িতে। এখন তো ঢেঁকি প্রায় উঠেই গেছে। এখন দোকানে দোকানে চালের গুঁড়া কিনতেই পাওয়া যায়। উল্টে ঐ চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠা বানানোর মত সময় বা উৎসাহই প্রায় নেই।
চালের গুঁড়া বা চাল বাটা দিয়ে আর একটা জিনিস করা হত; আলপনা আঁকা। গ্রামের বাড়িতে পূজা পার্বন , বিয়ে বাড়ী এসবে দুয়ারে আর উঠানে চালের গোলা দিয়ে আলপনা আঁকা হত। এখন তো পূজার আগে দেখি, প্লাষ্টিকের তৈরী আলপনা কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়া নানান রকমের রং দিয়েও আলপনা আঁকা হয়।
চাল ছাড়া আমাদের খাদ্যের আর একটা প্রধান জিনিস হল গম। গমের আটা বা ময়দা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা সবথেকে বেশী প্রচলিত গুঁড়া। গম বা যব গুঁড়া না করে খাওয়াই যায় না। এজন্য গ্রামে গঞ্জে, এমনকি শহরেও আটা চাক্কি বা গম ভাঙ্গানোর কল খুবই দেখা যায়। উত্তর ভারতের গ্রামাঞ্চলে বাড়িতেও যাঁতায় পিষে আটা তৈরী করা হয়।
আমাদের খাদ্য তালিকায় চাল গমের পরই ডাল -এর স্থান। ডাল সাধারনত গুঁড়ো করে রান্না করা হয় না। তবে ডাল গুঁড়ো করে যে ব্যাসন হয়, তার ব্যাপক ব্যবহার আছে। ডাল ভাজা করে গুঁড়া করা হলে তাকে ছাতু বলে। ছোলার ডালের ছাতু বেশ ভালো খাদ্য। একেবারে চাক্কি ওলার কাছ থেকে না কিনলে ভালো ছাতু পাওয়া যায় না। সুন্দর প্লাস্টিক প্যাকেটে যে ছাতু পাওয়া যায়, তার বেশীর ভাগটা মটরের ছাতু। আমরা ছোট বেলায় মুড়ির ছাতু খেয়েছি ; এখন আর পাওয়া যায় না। এখন প্রায় সব মুড়ির প্যাকেটের নিচে মুড়ির গুঁড়ো থাকে, ওগুলো ফেলে দিতে হয়।
ছোট বেলায় আমাদের ক্লাবের থেকে গুঁড়ো দুধ বিতরণ করা হত। বড় বস্তার মত প্যাকেটে পাঁচ দশ কেজি গুঁড়ো দুধ থাকত। তার থেকে একদিনে এক কেজি মত বের করে এক বালতি জলে গুলে দুধ বানানো হত। সেই দুধ মগে করে মেপে বিতরণ করা হত। এই গুঁড়ো দুধ কোথা থেকে আসে আমরা জানতাম না। শুনতাম বিদেশী দুধ। এক সময় চা পাতার দোকানে গুঁড়ো দুধ খুব পাওয়া যেত; এখন আর দেখিনা। বড় বড় হোটেলে প্রতিটি ঘরে চা কফি তৈরীর সরঞ্জাম থাকে। সেখানে ছোট ছোট প্যাকেটে গুঁড়ো দুধ থাকে। এই সব হোটেলের চায়ের জন্য দুধের মত চিনির প্যাকেট ও থাকে; এই চিনি সব সময় গুঁড়ো চিনি থাকে দেখেছি।
গুঁড়ো দুধের সবথেকে বেশী ব্যবহার হয় বাচ্চাদের খাওয়ার হিসেবে। শিশু বিশেষজ্ঞরা যতোই বারণ করুন, জনগণের কাছে এই কৌটোর দুধ ভয়ঙ্করভাবে জনপ্রিয়। সম্ভবত যারা এই জিনিস বাজারে বেচে মুনাফা অর্জন করে, তাদের ব্যাপক বিজ্ঞাপন ডাক্তারবাবুদের উপদেশকে হারিয়ে দিচ্ছে।
এরকম আর একটা বাজারী গুঁড়ো হচ্ছে, প্রোটিন পাউডার ,আর নানান কোম্পানির তথাকথিত হেল্থ ড্রিংক। বিজ্ঞাপনে মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে এরা ব্যবসা করে যাচ্ছে। এ একমাত্র আমাদের দেশেই সম্ভব।
নানা রকমের ট্যালকম পাউডার বা প্রসাধনী গুঁড়ো খুব ব্যবহার হয়। একটা ওষুধ কোম্পানীর পাউডার তো বাচ্চাদের সব সমস্যার বিশল্যকরণী বলে চলছে। এ জিনিস চোখে ঢুকে বাচ্চার চোখ লাল হচ্ছে বললে বাচ্চার মায়েরা এমন ভাবে তাকায় যেন বলতে চায়, এ ডাক্তারটা কিছুই জানে না।
এখন আবার শুনছি সজনে পাতা বিদেশ থেকে গুঁড়ো হয়ে, কৌটোয় ভরে বাজারে আসছে, কয়েকশ টাকা দাম। চায়ের পাতা কিন্তু গোটা বা অন্তত চার ভাগের কম না হলেই দাম বেশী। একেবারে গুঁড়ো চা রাস্তার পাশের দোকানে ছাড়া চলে না।
সবথেকে দামি গুঁড়ো হল সোনার গুঁড়ো। শুনেছি, সোনার কারিগররা যে মাদুরে বসে কাজ করে সেই মাদুরে সোনার গুঁড়ো পড়ে থাকে। দিনের শেষে ঘর ঝাঁট দিয়ে যে সোনার গুঁড়ো পাওয়া যায় তার দাম কয়েকশ টাকা।
আমরা ছোটবেলায় বাড়িতে খল নুড়ি দেখেছি। একটা পাথরের নৌকার মত পাত্রকে খল বলত। বাচ্চাদের ট্যাবলেট খাওয়াতে হলে ঐ খল নুড়িতে ভেঙ্গে গুঁড়ো করে, মধু বা কোন মিষ্টি জিনিস মিশিয়ে খাওয়ানো হত। এখন সব ওষুধই বাচ্চাদের জন্য সিরাপ আকারে পাওয়া যায়। অনেক রকম আয়ুর্বেদিক ঔষধ খল নুড়িতে গুঁড়ো করে তৈরী বা খাওয়ানোর নিয়ম।
আজকাল রান্নাঘরে সবকিছু গুঁড়ো ব্যবহার চলছে। হলুদ লঙ্কা সহ প্রায় সব মশলা গুঁড়া পাওয়া যায়। প্রায় ঘরে ঘরে মশলা গুঁড়ো করার মেশিন আছে। ঐ মেশিন শুধু মশলা নয়, চিনি, চা্লও গুঁড়া করা যায়। এই গুঁড়ো করার যন্ত্র কিন্তু শিল নোড়াকে হারাতে পারেনি।
কাঁচ গুঁড়ো করে আঁঠা দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো সুতোতে লাগিয়ে সুতো ধারালো করা হয়। ঘুড়ি ওড়ানোর সময় অন্য ঘুড়ি কাটার জন্য এই সুতো খুব কার্যকর; কিন্তু এই সুতোতে অনেক মোটরবাইক আরোহীর গলা কেটে বিপদ ঘটছে। চিনা মাঞ্জায় বোধহয় লোহার গুঁড়ো দেওয়া হয়। মারাত্মক গুঁড়ো দিয়ে বোমা বানানো হয়। আবার মারাত্মক সব নেশার জিনিসও গুঁড়ো হিসেবেই পাওয়া যায়।
এক সময় মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা বিখ্যাত গ্যমাক্সিন আর ডি ডি টি গুঁড়ো কিন্তু এখন আর মশাদের কিছুই করতে পারছে না। উল্টে নদী সমুদ্রের মাছেদের মাধ্যমে এখন আমাদের শরীরে চলে আসছে। গ্যাসিয় ক্লোরিন গুঁড়ো চুনের সাথে মিশিয়ে ব্লিচিং পাইডার করা হয়।
কাপড় কাচার সাবান এখন গুঁড়োই বেশী চলছে। হোটেল ইত্যাদিতে রান্নার জন্য শুকনো লংকার গুড়ো খুব ব্যবহার হয়; আমার আবার ও জিনিস একেবারেই সহ্য হয় না।
লংকার গুঁড়ো চোখে ছিটিয়ে চুরি ছিনতাই হয় শুনেছি, কিন্তু দেখিনি এখনও। বিস্কুটের গুঁড়ো চপ কাটলেটের দোকানে খুব ব্যবহার হয়।
করাত কলের কাঠের গুঁড়োও অনেক কাজে ব্যবহার হয়। কিন্তু পুরনো কাঠের থেকে যখন খুব সূক্ষ্ম গুঁড়ো বেরতে থাকে তাকে বলে ঘুন ধরা । কাঠে ঘুন ধরলে তবু সেই কাঠ পাল্টে নেবার একটা সুযোগ থাকে।
কিন্তু একটা দেশের জাতীয় চরিত্রে ঘুণ ধরলেই সব শেষ। জাতীর মেরুদন্ডটাই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝড়ে পড়ে।