গতকাল (৫.০২.২০২৫) টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রে হয়তো বা অনেকের কাছেই চাঞ্চল্যকর একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। ভারতে মেডিক্যাল শিক্ষার সবচেয়ে নামী, অভিজাত এবং উন্নতমানের দিল্লি এইমস সহ “operational” প্রায় সবকটি এইমস-এ ২৩% থেকে ৩৮% পর্যন্ত শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। এইমস, দিল্লি-তে অনুমোদিত ফ্যাকাল্টি পদ ১,২৩৫টি। আছে ৮১০টি – ৪২৫টি ঘাটতি যা শতকরা হিসেবে ৩৪%।
(সৌজন্য – দ্য টেলিগ্রাফ, ৫.০২.২০২৫)
একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত আরেক খবরের শিরোনাম “’লেট-আস-চিট’ ক্রাই ফ্রম সেকশন অফ এমবিবিএস স্টুডেন্টস অন ক্যাম্পাসেস”। ঘটনার অকুস্থল বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ। পশ্চিমবঙ্গে এরকম খবরও ক’দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে যে, শিক্ষকের অভাবে একজন আরএমও (রেসিডেনশিয়াল মেডিক্যাল অফিসার) বিভাগীয় প্রধানের পদ সামলাচ্ছে। দায় কার? পরিচালক স্বাস্থ্যদপ্তর কিংবা সরকারের? নাকি “যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রতিবাদকারী ছাত্র ও ডাক্তার সমাজের? এর উত্তর তো সামাজিক মানুষ অবশ্যই দাবী করবে। দাবী করবে সমস্ত চিকিৎসক সমাজ এবং বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীরা। অভয়া-র ঘৃণ্যতম নির্যাতন, ধর্ষণ এবং ততোধিক ঘৃণ্য খুনের পরে এ সংবাদগুলো বেশি বেশি করে সমাজমাধ্যমে এবং জনতার গোচরে আসছে, যা এতদিন অনেকাংশেই পর্দার আড়ালে ছিল।
প্রসঙ্গান্তর
একদল মেধাবী, মানুষের চিকিৎসা করার স্বপ্ন-মাখা চোখ নিয়ে তাদেরই আরেক স্বপ্ন দেখা সাথী “অভয়া”র নৃশংস অত্যাচার ও ধর্ষণ এবং নৃশংসতম হত্যার (বিশেষণদুটোর স্থান বদলও হতে পারে) বিচার (সুবিচার অনেক দূর গ্রহের কোন ছায়াময় অস্তিত্ব!) দাবী করেছে। এবং সরকার ও রাষ্ট্রের তরফে সযত্নে তৈরি করা “আইনসিদ্ধ আইনহীনতা” (legalized lawlessness)-এর বিরুদ্ধে চোয়াল কষে দীর্ঘ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে।
একটি সিস্টেমের মধ্যেকার নীরব “সন্ত্রাস সিন্ডিকেট”, সম্পূর্ণ অবৈধ ও অনৈতিকভাবে টাকার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রীদের পাস-ফেল করানো বা নম্বর বাড়ানো, মর্গের মৃতদেহ বিক্রী থেকে নিম্ন মানের ওষুধ (কোন কোন ক্ষেত্রে ওষুধই নয়, গায়ে দেবার পাউডার) সরবরাহের ঠিকাদারি থেকে কয়েক শ’ কোটি টাকা কামানো, ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং মেডিক্যাল শিক্ষাবিভাগের অভ্যন্তরের অবর্ণনীয় দুর্নীতি – সমস্ত কিছুর ক্লেদাক্ত আবরণকে একটানে খুলে ফেলে দিচ্ছে আমজনতার সামনে। এ সাম্রাজ্যের রাজধানী আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ।
এ আন্দোলনের ফলে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে শাসকদল এবং সরকারকে এর প্রতিক্রিয়ায় নিত্যনতুন কৌশল ভাবতে হচ্ছে। জুনিয়র ডাক্তারদের proactive movement সরকারকে reactive position-এ ঠেলে দিয়েছে। এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এরা বিভিন্ন স্তরে গণ অংশগ্রহণের flood gate খুলে দিল।
শুধু এটুকুই নয়, এ আন্দোলনের অভিঘাতে নারীরা সামাজিক সুরক্ষা এবং ব্যক্তি নারীর স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন খুঁজে পেয়েছে। সমস্ত নাগরিক সমাজ – সবরকমের দলীয় প্রভাবকে দূরে সরিয়ে রেখে – একটি নতুন পরিসর তৈরি করেছে। এরকম তৃতীয় পরিসর বা নাগরিক পরিসর স্মরণীয় কালের মধ্যে উন্মোচিত হয়নি।
রাজনৈতিক দল এবং ঝান্ডা ছাড়া মানুষের বিশুদ্ধ আবেগ এবং পবিত্র ক্রোধকে রাষ্ট্র সবসময় ভয় পায়। চায়, একে বারংবার সহিংস হবার পথে ঠেলে দিতে। সফল না হলে একে প্রশমিত করার জন্য গণতন্ত্রের তথাকথিত চারটি স্তম্ভই কাজ করে – বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন মাত্রায়। সে কাজ করা শুরু হয়েছে, এবং করবেও।
আরও উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হল – (১) আমাদের সন্তানসম জুনিয়র ডাক্তারেরা একটি অতি শীলিত, দৃঢ় এবং প্রত্যয়ী সামজিক যুক্তিবোধের জন্ম দিয়েছে, যুক্তি এবং শিষ্ট বিতর্কের সীমানা কোন সময়েই অতিক্রম করেনি, (২) এর পরিণতিতে অগণন মানুষের অংশগ্রহণের মাঝেও নিঃসারে এই শিষ্ট যুক্তির প্রয়োগ ও পরিণতিতে অনুশীলনের সূচনা করেছে। আজকের অশিষ্ট, কদর্য, ক্লেদাক্ত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবেশে এ এক জীবন্ত সামাজিক যুক্তির প্রতিরোধ।
এটুকু প্রাপ্তি আমাদের ইতিহাসের মহাফেজখানায় চিরকালীন স্থান করে নেবে – এ আমাদের বিশ্বাস। তবে একটি প্ররোচনার ব্যাপারে সয়াবিকে সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অপ্রাপ্তি পূরণের ক্ষেত্র হিসেবে যেন আমরা এদের আন্দোলনকে বেছে না নিই। তেমনি এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কোন রাজনৈতিক দল তৈরি করার স্বপ্নবিলাসকে আমরা যেন আমল না দিই। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন অব্দি ওদের ওপরে আরও জানা-অজানা নানা পথে বিভিন্ন আক্রমণ নেমে আসবে। নাগরিক সমাজের দায়িত্ব ওদেরকে আগলে রাখার।
প্রসঙ্গে ফিরে আসা
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিকল্প কোন Health and Wellness Centre (HWC) হতে পারেনা। জনস্বাস্থ্যের আতুর ঘর হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয়, চিকিৎসা হয় মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগীর এবং আরও অনেক অবহেলিত রোগের। Do We Care-এর সুপরিচিত স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ লেখিকা সুজাতা রাও বলেন – Money was available to conduct a heart surgery, a cochlear implant, or C-section but not for essential medicines and basic diagnostics, preventive education, rehabilitative care, nursing for the elderly, school health and adolescent care, or for addressing the direct causal factors of communicable and non-communicable diseases, or treatment of injuries, fevers, snake bites – conditions that were critically important for the poor.” (pp. 24-25)
HWC এখানে নিরুত্তর। আমরা HWC চাইনা, চাই উপযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যা ১৯৪৮-এ “ভোর কমিটি”-র রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক কালে শ্রীনাথ রেড্ডির সুপারিশে যা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রাক্তন মহাসচিব (১৯৯৮-২০০৪ সময়কালের) গ্রো হারলেম ব্রান্টল্যান্ড এবং রাষ্ট্র সংঘের প্রাক্তন মহাসচিব বান কি মুন (২০০৭-২০১৬ সময়কালের) ২০১৮ সালে ভারতে আসেন স্বাস্থ্যের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য। পরে ল্যান্সেট-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন “India’s health reforms: the need for balance” (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, পৃঃ ১-২) শিরোনামে। ব্রান্টল্যান্ডের উপলব্ধি ছিল – “ভারতের নতুন স্বাস্থ্যসংস্কারের যে সব প্রোগ্রাম সেক্ষেত্রে একটি ঝুঁকি রয়েছে যে, এই প্রোগ্রামগুলো যে অর্থ খরচ হবে সেটাকে টার্শিয়ারি কেয়ারমুখী করে তুলতে পারে। এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটের অন্তত ২/৩ অংশ ব্যয়ের ঘোষিত নীতিকে গুরুত্বহীন করে তুলতে পারে।”
এবং বাস্তবে এ ঘটনা ঘটছেও – সে “স্বাস্থ্যসাথী” হোক বা “আয়ুষ্মান ভারত”, সবক্ষেত্রেই ইন্সিউরেন্সের টাকা মূলত খরচ হয় টারশিয়ারি সেক্টরে এবং কর্পোরেট হাসপাতালগুলোতে। মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যের অবস্থা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই থাকে।
ব্রান্টল্যান্ড এক্ষেত্রে আমেরিকার উদাহরণ দিয়েছেন – যেখানে জিডিপির ১৮%-এর বেশি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হলেও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নেই।
কোন দেশে স্বাস্থ্যবিমা থাকবে কিনা নির্ভর করে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্র কোন চোখে জনতার স্বাস্থ্যকে দেখবে তার ওপরে। আমেরিকাতে স্বাস্থ্যবিমার বাড়বাড়ন্ত সবচেয়ে বেশি। বস্তুত পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো হাঙ্গর-সদৃশ আন্তর্জাতিক বিমা কোম্পানির প্রায় সবকটিই আমেরিকার। সে দেশেই ইন্সিউরেন্স তথা স্বাস্থ্য বিমা-বিহীন এক ক্যান্সার আক্রান্ত কালো নাগরিকের হতদরিদ্র অবস্থায় প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু দেখে চিকিৎসকরা উপলব্ধি করেন – “এটা আমাদের কাছে ভয়ংকর ভাবেএক ট্র্যাজেডির মতো অমানবিক যে এই ধনী দেশে. ডেভিসের মতো হাজার লক্ষ মানুষ অসহায় মানুষ স্রেফ ইন্সিউরেন্সে না থাকার কারণে মারা যাবে (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন (NEJM), নভেম্বর ১৪, ২০১৩)। বিমা ব্যবস্থা পৃথিবীতে চিরকাল ছিলনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যে বিমা জোরদার এবং ক্রমসম্প্রসারিত হয়েছে। ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (UHC) এবং “সকলের জন্য স্বাস্থ্য” – এই দুটি ধারণার মাঝে গুণগত ফারাক আছে। UHC-তে ধরে নেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো যে পরিষেবা দেবে মানুষকে তার জন্য মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য ইন্সিউরেন্স থেকে টাকা পাবে। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভিত্তিই ছিলো “বুনিয়াদি স্বাস্থ্য-সুযোগের জন্য সকলের সমান প্রবেশাধিকার” এবং এর জন্য ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র, রোগীকে কোন ব্যয় বহন করতে হবেনা।
ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (UHC) এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্য – এই দুটি ধারণার মাঝে ফারাক আছে। UHC-তে ধরে নেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো যে পরিষেবা দেবে মানুষকে তার জন্য মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য ইন্সিউরেন্স থেকে টাকা পাবে। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভিত্তিই ছিলো “equitable access to basic health services” এবং এর জন্য ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র, রোগীকে কোন ব্যয় বহন করতে হবেনা। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য কি সরকারি বা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের আওতায় আসবে? হাঙ্গরের মতো হাঁ করে রয়েছে বহুজাতিক ইন্সিউরেন্স কোম্পানিগুলো। একবার যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় কবচ সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সরকারের তরফে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি ইন্সিউরেন্সের কথা বলা হলেও শেষ অব্দি তা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের হাতেই চলে যাবে।
স্বাস্থ্য কি তাহলে পরিশেষে বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের আওতায় আসবে? হাঙ্গরের মতো হাঁ করে রয়েছে বহুজাতিক ইন্সিউরেন্স কোম্পানিগুলো। একবার যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় কবচ সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সরকারের তরফে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি ইন্সিউরেন্সের কথা বলা হলেও শেষ অব্দি তা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের হাতেই চলে যাবে। ল্যান্সেট পত্রিকায় ২৪ আগস্ট, ২০১৯-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ জানাচ্ছে – ২০১৮-তে সবচেয়ে বেশি রেভেন্যু দেয় এরকম ১০০টি সংস্থার ৬৯টি কর্পোরেট সংস্থা, ৩১টি সরকারি সংস্থা। অথচ১৯৭৮ সালে WHO এবং UNICEF-এর উদ্যোগে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা বা comprehensive primary health care কনফারেন্স (১৩৪টি দেশ এবং শতাধিক অ-সরকারি সংগঠন ও ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিল) বা আলমা-আটার ঘোষণাপত্রে উচ্চারিত হয়েছিলো “নিউ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অর্ডার (NIEO)”-এর ধারণা। দেশের সম্পদ বিতরণের ব্যাপারেও সেখানে আলোচনা হয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে মেডিক্যাল সিলেবাসও তৈরি হচ্ছিলো।জন্ম নিচ্ছিল নতুন উজ্জীবনা নিয়ে “স্বাস্থ্য নাগরিকত্ব”তৈরি হবার পরিস্থিতি।
আলমা-আটা (১৯৭৮)-র ঘোষণাপত্রের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল – “An acceptable level of health for all the people of the world by the year 2000 can be attained through a fuller and better use of the world’s resources, a considerable part of which is now spent on armaments and military conflicts. A genuine policy of independence, peace, détente and disarmament could and should release additional resources that could well be devoted to peaceful aims and in particular to the acceleration of social and economic development of which primary health care, as an essential part, should be allotted its proper share.” অর্থাৎ যুদ্ধের বদলে শান্তি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া (détente), এবং নিরস্ত্রীকরণ দেশের মধ্যে অতিরিক্ত সম্পদের সৃষ্টি করবে যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটাবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা হচ্ছে এই বিকাশের অতি আবশ্যিক উপাদান।
যুদ্ধ বনাম স্বাস্থ্য
বিগত ২ বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়া এবং ইউক্রেন-এর যুদ্ধ চলছে। খরচ কত, অনুমান আছে? প্রতিদিনের যুদ্ধে রাশিয়ার খরচ প্রায় ১০০০ কোটি টাকা। আর ইউক্রেন বিভিন্ন পশ্চিমী শক্তি থেকে পাওয়া প্রায় ৭০,০০০ কোটি টাকা যুদ্ধে খরচ করেছে। এর মধ্যে সিংহভাগ টাকা এসেছে আমেরিকার কাছ থেকে। “বিশ্বসম্রাট” ট্রাম্প ক’দিন আগেই ইউক্রেনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন – এতদিন টাকা দিয়েছি, এবার তোমাদের শোধ দেবার পালা (in cash নয়, in kind) – “Trump Urges Trading Ukraine’s Critical Minerals for More U.S. Aid. Ukraine has already emphasized that by supporting its war effort, the U.S. could get access to the country’s wealth of critical minerals like lithium and uranium.” (নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফেব্রুয়রি ৩, ২০২৫)
ইজরায়েলের প্যালেস্তিনিয়া দখল করার জন্য যুদ্ধের খরচ? ব্যাংক অফ ইজরায়েল-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে চলা এ যুদ্ধে ইজরায়েলের অর্থনীতির ১০% (৬৭,০০০ কোটি টাকা) ব্যয় হয়েছে। এখানে আবার “বিশ্বসম্রাট” ট্রাম্প ঢুকে পড়েছেন। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী খোলাখুলি জানিয়েছেন, যেমনটা নিউ ইয়র্ক টাইমস (ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫) রিপোর্ট করেছে – “Trump’s Gaza Takeover Plan May Sound Death Knell for the Two-State Solution. Already unlikely, the prospects for creation of a Palestinian state alongside Israel could vanish altogether if the United States takes over Gaza and displaces the population, as President Trump proposes.” নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর কিছুক্ষণ আগের সংবাদ হল – “Inside Trump’s Hastily Written Proposal to ‘Own’ Gaza. Although the president had been talking about the idea for weeks, there had been no meetings on the subject, and senior members of his government were taken by surprise.”
ভিটেমাটি হারানো গাজার মানুষদের, এমনকি অসংখ্য শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা অশক্তরাও বাদ যায়নি, মধ্যে অস্ত্রের আক্রমণ ছাড়াও বিভিন্ন সংক্রমণ শুরু হয়েছে। সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যব্যাবস্থা বোমার আঘাতে বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় কোন হাসপাতাল অবশিষ্ট নেই। এর দায় কে নেবে? যুদ্ধে মদতদাতা আমেরিকা ও পশ্চিমী শক্তি কিংবা বিশ্বের কোটি কোটি নিরুচ্চার জনতা? এ কারণেই আলমা-আটা-র ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল – যুদ্ধের বদলে শান্তি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া (détente), এবং নিরস্ত্রীকরণ দেশের মধ্যে অতিরিক্ত সম্পদের সৃষ্টি করবে যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটাবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা হচ্ছে এই বিকাশের অতি আবশ্যিক উপাদান।
আমরা এখানে একটি সংগত প্রশ্ন করতেই পারি – যুদ্ধের পেছনে গত ২ বছরে যে লক্ষাধিক কোটি টাকা খরচ হয়েছে, সে পরিমাণ যদি টাকা যদি সার্বিক স্বাস্থ্যের এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য খরচ করা যেত, তাহলে মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থা বিশ্ব জুড়েই ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যেত। এখন আর গানের কলির মতো প্রশ্ন “যুদ্ধ না শান্তি” নয়, নতুন করে লেখা হবে “যুদ্ধ না স্বাস্থ্য”।
ভারতের স্বাস্থ্য বাজেট (২০২৫-২৬) এবং শিক্ষার জন্য বরাদ্দ
এবারের বাজেট নিয়ে আলোচনা, এ প্রবন্ধের সীমার বাইরে। শুধু স্বাস্থ্যের সামান্য অংশটি নিয়ে দুয়েক কথা বলা যায়। বাজেটে ঘোষিতভাবে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ বেড়েছে – যদিও মুদ্রাস্ফীতির হিসেব করলে শেষ অব্দি ক্যোঁতটা বেড়েছে বলা শক্ত। কিন্তু ন্যাশনাল হেলথ মিশন-এ ব্যয়বরাদ্দ কমেছে। ফলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার খণ্ডহর যে আশা বা অন্যান্য কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ধরতে রাখেন তাদের কোন মাইনে বাড়েনি।
এখনও স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ রয়ে গেছে জিডিপির ২%-এর নিচে। শুধুমাত্র ক্যান্সারের ওষুধের দাম কমালে স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক ওষুধগুলো মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে না। ১০,০০০ নতুন মেডিক্যাল কলেজ বা ২০০টি ডে-কেয়ার সেন্টার খুলে শেষ অব্দি কী দাঁড়াবে? যদি মেডিক্যাল শিক্ষাখাতে ব্যয় না বাড়ে, যদি উপযুক্ত শিক্ষক না থাকে, যদি – লেখার প্রথমেই যা উল্লেখ করা হয়েছে – সন্ত্রাস ও হুমকির সংস্কৃতি বন্ধ না হয়?
এ বাজেটে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে ডিজিটাইজ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কী পরিহাস! যে বস্তুর উপস্থিতিই প্রায় চোখে পড়েনা সেটাকে আবার ডিজিটাইজ করা? টীকাকরণ প্রগ্রামকে আরও সচল করার কথা কোন গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়নি। অদ্ভুতভাবে এদেশে মেডিক্যাল ট্যুরিজম-এর বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। উৎসাহিত করা হয়েছে, ব্যয়বরাদ্দ রাখা হয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর ব্যবহার করার জন্য। কোথায় হবে এর ব্যবহার? অবশ্যই কর্পোরেট সেক্টরে এবং মুষ্টিমেয় সরকারি উচ্চতম মেডিক্যাল কলেজগুলোতে। স্বাস্থ্যের সুযোগসুবিধেহীন অগণন সাধারণ মানুষের কাছে এর কী মূল্য? কী লাভ হবে এদের?
(সৌজন্যঃ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন)
শেষ কথা
*সাধারণ মানুষকে সমস্ত স্বাস্থ্য পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থাপন করতে হবে – কোন বিজ্ঞাপনী চমক নয়, বাস্তব জগতে
*সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকল্প অন্যকিছুতেই আমাদের কোন প্রয়োজন নেই
*স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে
*স্বাস্থ্যের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, কোন ইন্সিউরেন্স কোম্পানির নয়
*আমাদের স্বাস্থ্যের প্রয়োজন, স্বাস্থ্য পরিষেবার নয়
দাদা, এই বৃদ্ধ বয়সে এসে আমার মনে হয় এই সব চুক্তি,এই সব প্রতিজ্ঞাপত্র, এই সব দাবিসনদ -এগুলি কেবলমাত্র লোককে ভুল বোঝানোর চেষ্টা। আসলে মানুষ মানুষই থেকে গেল -হিংস্র,রক্তলোলুপ,আকন্ঠ লোভী।
এসব -সবই মূল্যহীন।
সব নতুন করে ভাবা দরকার। নতুন বিশ্বনেতা দরকার। কঠোরতম শাসক দরকার -যে ব্যতিক্রম দেখলে সাঁড়াশি দিয়ে শরীর থেকে মাংস ছিঁড়ে নেবে।
এসবই 1000/1200;টাকা অনুদান তথা ভিক্ষা নেবার প্রতক্ষ্য আর পরোক্ষ ফলাফল ! যেমন প্রজা তেমনি রাজা ! সাধারণ মানুষভাগে ঠিক করুক কি করবে !
আমরা যখন স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকার বলি, আসলে আমরা যে কথাটা বলতে চাই কিন্তু উহ্য থেকে যায়, সেটা এই যে স্বাস্থ্যের অধিকার আসলে স্বাস্থ্য পরিষেবার নাগাল পাবার অধিকার। এখন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সে সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব কার তার ঠিক উত্তর দিতে পারলে পুরস্কার পাবার প্রয়োজন নেই, তবে এই প্রশ্নের উত্তর যাঁদের দেওয়ার কথা, তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে তারা কতটা ওয়াকিবহাল, জয়ন্তদার লেখাটায় সে উত্তর পাওয়া যাবে।
এখন জয়ন্তদা দেখছি লিখেছে ইকুইটেবল একসেস। এই কথাটা ভয়ানক গোলমেলে। মনে করুন হরিপদ কেরানীর (যে নাকি সারা জীবনে যা টাকা জমিয়েছিল সব খরচা হয়ে যৎকিণ্চিৎ রয়েছে আর মুকেশ আম্বানী, তেনার অসীম সম্পদ, । এহেন পরিস্থিকিতে দুজনেরই একই রকম অসুখ, তবে হরিপদবাবুর কেসটা আরেকটু জটিল তাঁর স্পেশালিস্ট চিকিৎসার প্রয়োজন, মুকেশবাবুর ততটা নয়, মোটামুটি প্রাথমিক চিকিৎসায় সারবে। বর্তমান ভারতের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি বিচার করে দেখলে দেখা যাবে যে এক্ষেত্রে মুকেশ বাবুর জটিল রোগের চিকিৎসা পাবার সম্ভাবনা হরিপদ কেরানীর চেয়ে অধিক, কারণ মুকেশবাবুর অসুখের পিছনে খরচ করার আর্থিক সামর্থ হরিপদবাবুর থেকে বেশী, তাই তিনি চিকিৎসায় অগ্রাধিকার পেলেন, যদিও তাঁর প্রয়োজন ছিল না, বরং শারীরবৃত্তিয় ব্যাপার বিবেচনা করলে হরিপদবাবুর জটিল চিকিৎসা পাবার অগ্রাধিকার বিবেচিত হবে। তার মানে এ এমন এক পরিস্থিতি যেখানে ক্লিনিকাল অবস্থা নয়, বরং খরচ করার সামর্থ্য নির্ণয় করছে কে চিকিৎসা পাবে, কে পাবে না। অথচ যদি সরকার বা সমাজকে জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা বলবেন কেন মশাই, হাসপাতাল তো খুলে রেখেছি সবার জন্য। ব্যাপারটা কিন্তু অসাম্য বা inequalityর নয়, inequityর। মানে সকলের জন্য (সমান) স্বাস্থ্য কথাটার একটা গলদ আছে, এবং সেই রন্ধ্রপথে একটা ঘোরতর অসাম্যের ব্যাপার আসছে। তাহলে উচিত কি ছিল? স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদি এমন হত যে দুর্বলতম মানুষ, দরিদ্রতম দরিদ্রতর মানুষকে এমন সুযোগ সুবিধা করে দেওয়া হবে যাতে তারা সবলতম প্রবলতর ধনাঢ্য মানুষের হুবহু সমান চিকিৎসা পায়, চিকিৎসার নাগাল সব অর্থে ক্লিনিকাল assessment এর নিরিখে triaged, তাহলে, তখন, আমরা স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা বলতে পারতাম। এখন ইনশিওরেনসের কথা যখন উঠছে, তখন সাধারণভাবে আমরা মনে করি সরকার আমাদের ইনশিওরার, বিশেষ করে সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থায়। কিন্তু দেশের সরকার যদি বেসরকারী ইনশিওরারদের কাছে সমর্পণ করেন, গোলমালটা হয় সেখানেই। এই সার্বিক সমস্যার বহিপ্রকাশ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র সরিয়ে অন্য মডেলকে নিতে আসা।
অনেক কিছু জানলাম।
সমৃদ্ধ হলাম।