দাদা, তোমাদের পাড়ায় ধরা পড়েছে শুনলাম?” সকাল সকাল একজন ফোন করে জিজ্ঞেস করল।
কে ধরা, কী ধরা কিছুই বুঝলাম না। চুরি ডাকাতির কোনও খবর তো পাইনি।
” কী ধরা পড়েছে? ” অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
” আরে, করোনা রোগী। জানো না?”
“চোর ডাকাত, অপরাধী ধরা পড়ে জানতাম। রোগীও যে ধরা পড়ে, সেটা সত্যিই জানতাম না। ” এই বলে ফোনটা কেটে দিলাম।
এখন এটাই ট্রেন্ড। ‘ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে’। অথবা, চুপচাপ ছিল, আমরাই তো ধরিয়ে দিলাম। হুহু, বাওয়া শার্লক হোমস আমরাও কিছু কম না।যেন কোন কুখ্যাত অপরাধী বহুদিন ফেরার ছিল, এতদিনে ধরা পড়েছে।
এই অমুককে তো অনেকদিন বাজারে দেখা যাচ্ছে না, কী কেস! করোনা নয় তো? তমুক আজ একটু কাশলেন মনে হলো, সরেজমিনে তদন্ত না করলেই নয়। অমুকের বাড়ির সব দরজা জানলা বন্ধ! গন্ধটা সুবিধের নয় মনে হচ্ছে। আজ্ঞে, এটাই এখন ট্রেন্ড।
কেউ হয়তো করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। একটা অতিমারী চলছে। স্বাস্থ্য দপ্তর বা প্রশাসন থেকে হয়তো কেউ সেই ব্যাপারে জানতে এসেছে।
তার মানেই গেল, গেল রব। ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে। চাউর করে দাও খবর। ছড়াও আতঙ্ক। ‘ধরা পড়েছে’।
এবার?
এবার, ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না কেউ। রোগীর চোদ্দ পুরষের নামও মুখে আনবে না। বাড়ির দিকে চোখ পড়লে তৎক্ষণাৎ চোখে গঙ্গাজল ছেটাবে। রোগীর বাড়ির কেউ বারান্দাতে এলেও, ঢিল ছুঁড়ে তাকে ঘরে ঢুকিয়ে দেবে। চোখে চোখ পড়ে গেলে গোবর খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি…
ধরা যখন পড়েছে, অতএব এবার তুমি গেলে। করোনায় নয়, সামাজিক বয়কট করবো তোমায়। একঘরে করবো। সেরে উঠলেও তোমার সঙ্গে আর মেশা চলে না বাপু। সেরে উঠবার সার্টিফিকেট দেখালেও চিড়ে ভিজবে না। কারণ, তুমি ধরা পড়ে গেছ!
আর, ওই লোকগুলো। স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ? যারা পাড়ায় বা বাড়িতে থাকে। প্রতিবেশী বা ভাড়াটে। ওদের হয়তো ধরা পড়েনি এখনও। কিন্তু যদি ধরা পড়ে! অতএব, তাড়াও ওদের, খেদাও পাড়া থেকে।
মোট কথা দুটো জগত। করোনা আক্রান্ত,তার পরিজন, ফ্রন্টলাইন কোভিড যোদ্ধারা একদিকে আর যাদের করোনা হয়নি এবং দিব্যচক্ষুতে দেখা গেছে কখনও হবে না তারা অন্যদিকে।
‘ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে’ আসলে কিছুই নয়। ভয়, স্বার্থপরতা, গোঁড়ামির সংমিশ্রণ। আর, শুধু এই সামাজিক বয়কট আর একঘরে হওয়ার ভয় থেকে বাঁচবার জন্যই বহু রোগী জ্বর, কাশির উপসর্গ থাকলেও ডাক্তার দেখাচ্ছেন না, হাসপাতালে যাচ্ছেন না।
পাছে ‘ধরা পড়ে’ যান। পাছে পাড়ার লোকেরা তাকেও বয়কট করে।
করোনা অনেক কিছুই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাদের। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তথাকথিত শিক্ষিত, আধুনিক মানুষদের এই চূড়ান্ত অমানবিকতা আর স্বার্থপরতা।
মশায়, ‘ধরা পড়েছে’ আবার কী কথা! একটা রোগ হয়েছে। আজ অন্যজনের হয়েছে, কাল আমার বা আপনারও হতে পারে। তখন যদি পাড়াশুদ্ধ লোক দোকানে, বাজারে ‘ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে’ বলে আপনাকে নিয়ে মজলিস বসায়; কাঠগড়ায় তোলে আপনার পরিবারকে – ভালো লাগবে তো?
‘ধরা পড়েছে’ নয়। সহমর্মী হয়ে বলুন, করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কাল আমার, আপনারও হতে পারে। এটা একটা রোগ মাত্র। তাকে নিয়ে বিচারসভা না বসিয়ে, দয়া করে মাস্ক পড়ুন, হাত পরিষ্কার রাখুন আর ভিড় না বাড়িয়ে পরস্পরের থেকে প্রয়োজনীয় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
ও, হ্যাঁ। সম্ভব হলে, দয়া করে রোগী এবং তার পরিজনদের সাহায্য করুন। মানসিক ভাবে তাদের পাশে থাকুন, খোঁজখবর নিন। ‘ধরা পড়েছে’ বলেছে তাদের নিয়ে বিকৃত উল্লাস বা মাত্রাতিরিক্ত আতঙ্ক করবেন না। কারও জ্বর হলেই তার নির্ঘাৎ করোনা হয়েছে দেগে দিয়ে তাকে একঘরে করবেন না।
কে বলতে পারে – ‘ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে’ করতে করতে, কাল হয়তো আপনিও ধরা পড়ে গেলেন!