যন্ত্রে আসক্তি কী?
নেশা বলতে আমরা সাধারণত রাসায়নিক পদার্থের নেশা ভাবতেই অভ্যস্ত, যেমন মদ, গাঁজা, হেরোইন ইত্যাদির নেশা। কিন্তু, এই বদলাতে থাকা সমাজে, নেশার ধরণও বদলাচ্ছে, রাসায়নিক রূপ ছেড়ে সে এখন ঘিরে ধরছে ব্যবহারিক রূপে। এইসব আচরণগত আসক্তি (Behavioral Addiction) অথবা সহজ কথায় যাকে আমরা ‘বদভ্যাস’ বলে থাকি সেগুলির বেশীরভাগকে এখনো মানসিক রোগ হিসেবে নাম না দেওয়া হয়ে থাকলেও, বিভিন্ন গবেষণায় বার বার প্রমাণ হচ্ছে যে আমাদের বদলে যাওয়া জীবনশৈলী ক্রমাগত আচ্ছন্ন হচ্ছে বেশ কিছু নতুন ধরণের নেশায়, যেমন কম্পিউটার গেমিং, অনলাইন শপিং, অতিরিক্ত শরীরচর্চা, যৌন আসক্তি ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে অনেকগুলির মাধ্যম হিসেবেই যন্ত্র ব্যবহার হয়, যেমন কম্পিউটার গেমিং, অনলাইন শপিং, যৌন আসক্তি ইত্যাদি।
সেইজন্যেই, আজকাল Screen time অর্থাৎ টিভি, মোবাইল, ল্যাপ্টপ, ট্যাবলেট ইত্যাদির পর্দার দিকে তাকিয়ে আমরা দিনের কতখানি সময় ব্যয় করি এবং তার কারণে (daily functioning) অর্থাৎ আমাদের সাধারণ দৈনিক কাজকর্মে কতখানি অসুবিধের সৃষ্টি হয়, যন্ত্র ব্যবহার করতে না পেলে কতখানি অস্বস্তি হয় ইত্যাদি থেকে যন্ত্রের প্রতি আমরা আসক্ত কিনা তা বিচার করা হয়।
কাদের যন্ত্রে আসক্তি হওয়ার আশঙ্কা বেশী?
২০১৭-র নিমহান্স থেকে করা একটি নিরীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি ১০০০ জন ভারতীয়ের মধ্যে, ১৩ জন ইন্টারনেটে এবং ৪১ জন মানুষ মোবাইল ফোনে আসক্ত। এর মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা মেয়েদের চাইতে বেশী; এবং অণু পরিবারে এই সমস্যা যৌথ পরিবারের চাইতে বেশী। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যাগুলি প্রায় সাধারণের ৪-৫ গুণ। স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যেও যন্ত্রে আসক্তের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
ছোটদের কি যন্ত্রে আসক্তি হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে যে ২-৪ বছর বয়স থেকেই যন্ত্রে আসক্তি হওয়া সম্ভব। ৫-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১০-৩০ শতাংশকে মোবাইলের অপব্যবহার (Problematic Smartphone Use) করতে দেখা যায়।
যন্ত্র আসক্তি কতোটা ক্ষতিকর?
যেহেতু যন্ত্রের সামনে বসালে শিশু শান্ত থাকে, সেইজন্য মা বাবা এবং অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের একটা প্রবণতা দেখা যায় বাচ্চাদের খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, ব্যস্ত রাখা ইত্যাদির জন্য লম্বা সময় তাদেরকে পর্দার সামনে বসতে দেওয়ার। কিন্তু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে এতে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ বিলম্বিত হয় এবং কিছু কিছু জিনিস যেমন ভাষার সঠিক ব্যবহার, সামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারা ইত্যাদি শিখতে শিশুদের বেশী সময় লাগছে। এছাড়াও পরবর্তীকালে, অতিরিক্ত মোবাইল ইত্যাদির ব্যবহারের সাথে বেশ কিছু মানসিক রোগ বা আসুবিধের সম্পর্ক পাওয়া গেছে; যেমন বিষণ্ণতা (depressive disorder), উদ্বেগ (anxiety disorder), অনিদ্রা, সামাজিক ভীতি, একাকীত্ব ইত্যাদি। অবশ্য যেটা হয়ত অভিভাবকদের একমাত্র চিন্তার জায়গা, মোবাইল ফোন বা অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহারের সাথে পরীক্ষার নম্বরের তেমন কোনও সামঞ্জস্য পাওয়া যায়নি!
বাচ্ছাদের যন্ত্র আসক্তি কমানোর কী উপায়?
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটুকু বোঝা যায় যে একেবারে ছোট বয়স থেকে যন্ত্র ব্যবহারের সময় বেঁধে দেওয়া জরুরী। ২-৫ বছর বয়স অব্দি দিনে এক ঘণ্টার কম যন্ত্র ব্যবহার এবং তার পরেও সীমিত সময়েই বাচ্ছার হাতে মোবাইল/ যন্ত্র ছাড়া বিধেয়। এবং সেটা দিনের শুধুমাত্র একটি স্থির করা সময়ে, শিশুটি তার দিনের অন্যান্য কাজ ঠিক ভাবে শেষ করে থাকলে তবেই। আর, শুধু সময় নয়, সন্তান ফোনে/যন্ত্রে কী ধরণের জিনিস দেখছে/করছে, সেটা তার বয়সোপযোগী কিনা, তা খেয়াল রাখা অবশ্য প্রয়োজনীয়।
করোনা পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত যন্ত্র নির্ভরতা প্রতিরোধ করব কীভাবে?
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে এই লকডাউনের সময়ে ইন্টারনেটের ব্যবহার, বিশেষত পর্নোগ্রাফি এবং ভিডিও গেমিং সম্পর্কিত ওয়েবসাইটগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আচরণগত আসক্তিগুলির মধ্যে, ইন্টারনেট আসক্তি (বিশেষত সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার), ইন্টারনেট সেক্স, ভিডিও গেম তালিকার শীর্ষে রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এর খারাপ প্রভাব ছাড়াও, পর্দার সময় বাড়ার ফলে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ হ্রাস, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ঘটে এবং দৈনিক ছন্দ ব্যাহত হয় যা শেষ পর্যন্ত শারীরিক অসুস্থতারও কারণ হয়।
উপায়ঃ
- কোনও একটি পছন্দের এবং শিক্ষণীয় বিষয় বেছে নিয়ে পরিবারের সকলে একসাথে টিভি/ মোবাইলে অনুষ্ঠান দেখুন
- সক্রিয়ভাবে যন্ত্র ব্যবহারের সময়সীমা বেঁধে রাখুন
- পারিবারিক রুটিনের সময়, যেমন খাওয়ার সময় যন্ত্রের ব্যবহার সীমিত করুন। এই পরিস্থিতিগুলি সামাজিক শিক্ষার জন্য ব্যবহার করুন।
- সন্তানের বয়স অনুযায়ী শরীর সম্বন্ধীয় তথ্য, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করুন, যাতে সে এইসব বিষয় সম্পর্কে যন্ত্র না ঘেঁটে আপনাদের সাথে খোলা মনে কথা বলতে পারে।
- নিজস্ব যন্ত্র ব্যবহা্রের সময় কম করুন, বিশেষত খাবার কিংবা বাচ্ছার সাথে খেলার সময়।
- কথোপকথন, খেলা, হাতের কাজ ইত্যাদি মিলিয়ে মিশিয়ে একটি সক্রিয় রুটিন তৈরি করুন এবং নিজেও বাচ্চাদের সাথে সেই রুটিনটি মেনে চলাকে প্রাধান্য দিন।
- যখন যে যন্ত্রটি ব্যবহার হচ্ছে না, তখন সেটি বন্ধ করে রাখুন।
- বাচ্ছার স্কুলের কাজে যন্ত্র ব্যবহারের সময়ে সাথে কিংবা আশেপাশে থেকে লক্ষ্য রাখা জরুরি, কিন্তু এমনও হতে দেবেন না যাতে তার মনে হয় যে তার ওপর সবসময় অতিরিক্ত নজর রাখা হচ্ছে।
- দীর্ঘ সময় বাড়িতে থাকার ফলে বাচ্ছার বিরক্তি, খেয়াল খুশি করা, বেশী জিনিস দাবী করার প্রবণতা বাড়তে পারে, বেশীরভাগ সময় এ ধরণের ব্যবহার বাবা মায়ের মনোযোগ পাওয়ার জন্য কিংবা নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য হয়। চেষ্টা করবেন দিনের কিছু সময় আলাদা করে সম্পূর্ণ মনোযোগ বাচ্ছাকে দিতে, আর যে ব্যবহারগুলি ঠিক নয়, সেগুলির সময় তাকে পুরোপুরি ভাবে অগ্রাহ্য করুন। ওর বিরক্তি বা রাগ কমানোর জন্য কখনওই যন্ত্র ব্যবহার করবেন না।
অবশেষে, মনের খেয়াল রাখুন, সুস্থ থাকুন।