কোনো বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী ছিলাম না বলে একটা আফশোস ছিল বোধ হয় মনের কোণে, তাই নিয়তি আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল এই সঙ্কটকালের বৃত্তে— সারা বিশ্ববাসী সহনাগরিকদের সঙ্গে।
এই যুদ্ধেই মানবজাতির নির্বাণ, না ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জন্ম, আমি জানি না।
কিন্তু লিখে রেখে যাচ্ছি কিছু কথা, কিছু স্মৃতি—
যদি বেঁচে থাকি, ফিরে দেখব দিনগুলো।
আর যদি না থাকি, তবে—-
পর্ব ১
২৩শে মার্চ ২০২০
পুরো ব্যাপারটা আমার কেমন অবিশ্বাস্য ছেলেখেলার মতো মনে হচ্ছে।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছি। এই তো রাস্তায় লোকজন চলাফেরা করছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই। দোকান বাজারে ভিড় অবিশ্যি পাতলা। পথে গাড়ি চলাচলও বৌবাজার থেকে বেহালার দিকে যত এগোচ্ছি, তত ক্ষীণ হয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সে তো যে কোনো রাজনৈতিক বনধের দিনেও হয়।
কোথায় কোন দূর দেশে এক প্রায় অচেনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়েছে, তাই আমাদের এখন ঘরবন্দি হয়ে বসে থাকতে হবে?
মন বিদ্রোহ করে উঠল। মাথায় পরপর চিন্তার বিদ্যুৎ খেলে গেল মুহূর্ত কয়েকের মধ্যে— মাসের শেষ হয়ে আসছে, মায়ের ওষুধগুলো কিনে রাখা উচিত, মোবাইলের বিলটার লাস্ট ডেট দিন দুয়েকের মধ্যে, ইলেকট্রিক বিলেরও তাই।
এদিকে, উনবিংশ শতাব্দীর মেজাজি বনেদী বাসিন্দার মতো কোনো এটিএম কার্ড নেই আমার। শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয়জনদের শত অনুরোধ, উপরোধ, এমন কি হুমকির পরেও নেই। এখন, যদি সত্যিই বিল পেমেন্ট কাউন্টারগুলো বন্ধ থাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য, কি করে টাকা দেবো, ভাবতে গিয়ে ঘেমে উঠলাম।
ঘামতে ঘামতে আর মাথা ঘামাতে ঘামাতেই পৌঁছে গিয়েছি মাসকাবারি দোকানের সামনে। পাঁউরুটি, বিস্কুট, ডিম, এগুলো কেনার ছিল— সকালেই ফুরিয়েছে।
দোকানে ঢুকে হাঁ হয়ে গেলাম। পবনের দোকান ছোট হলে হবে কি, স্টক বেশ ভালো— এই মফস্বল ঘেঁষা শহরতলিতেও বিগবাজার আর স্পেন্সারিয় ব্র্যান্ডের মালপত্র তার পুঁচকে বিপণি আলো করে থাকে! সেই দোকানের প্রতিটি তাক খাঁ খাঁ করছে। ইতিউতি পড়ে আছে কিছু বিস্কুটের প্যাকেট আর বাসনমাজার ভিম বার!
ডিম পাঁউরুটি ব্যাগে ভরতে ভরতে পবন বলল— “ম্যাডাম, কিছু চাল,ডাল আটা নিয়ে রাখুন। দুদিন পরে দিতে পারব কি না জানিনা।”
আমি বললাম—“বাড়িতে যা আছে, মাস পয়লা অবধি চলেই যাবে, তারপর না হয় নেব।”
পবন একটু চুপ করে থেকে বলল—“তখন যদি দিতে না পারি?”
ওর গলায় এমন কিছু একটা ছিল, যাতে আমি থমকে গেলাম একটু।
আর, এই প্রথম বার আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিরশিরে ঠান্ডা পিছল অনুভূতি হিলহিল করতে থাকল— নিচে নামব নামব করেও নামল না শেষ পর্যন্ত।
আমি কি ভয় পেলাম? বিকেল থেকে যে হুড়োহুড়ি চলছিল ব্লাড ব্যাংকে, লকডাউনের খবর জানার পর থেকেই, ডাক্তার- টেকনিশিয়ানদের রোস্টার তৈরি, পিক আপ বাসের লিস্টের জন্য ফোনাফুনি, আপৎকালীন রক্ত স্টকে তুলে রাখা— এই প্রথম সেই সব কাজগুলোকে আর হুজুগ মনে হচ্ছিল না।
নিজের জন্য ঠিক ভয় পাচ্ছিলাম না। কার জন্য ভয় পাচ্ছিলাম, বুঝতে হলে গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন নেই।
চাল ডাল আটা তেল আর কিছু ফল সব্জি ভরা বাজারের থলেটা রান্নাঘরের সামনে নামিয়ে দিয়ে, সোজা ঢুকে গেলাম নিচতলার বাথরুমে। জল সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে হাতের চামড়া প্রায় তুলে ফেলতে ফেলতে মনে হলো—দুত্তোর চাকরি! যে চাকরি আমার আপনজনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে না, সে চাকরির দরকার নেই আমার! ছেড়ে দেব! কালই!
একতলার বাথরুম নিয়মিত ব্যবহার হয় না বহুদিন। বাবা থাকাকালীন, হতো। দেওয়ালের আয়নাটার কাঁচ বড্ড ঝাপসা হয়ে গেছে, ময়লা জমে জমে। মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে উপরে তাকাতেই ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে আমার বিকৃত প্রতিবিম্ব যেন মুখ ভেংচে উঠল আমাকেই— তুই না ডাক্তার? এত ভিতু তুই? আবার পাবলিকের সামনে বড় বড় জ্ঞানের কথা ঝাড়িস? এই ভয় বুঝি মানায় তোকে? ছিঃ!
পরিচ্ছন্ন হয়ে, পরিশ্রান্ত পায়ে দোতলায় উঠলাম।
টিভির সামনে উবু হয়ে বসে মা। মুখে নির্ভুল আতঙ্ক আর উদ্বেগের আঁকিবুকি!
“জানিস, এইমাত্র টিভিতে বলল, মেডিক্যাল কলেজকে নাকি করোনা হাসপাতাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সব ওয়ার্ড খালি করতে বলা হয়েছে। ওখানে শুধুই করোনা পেশেন্ট বা সন্দেহজনক রুগী ভর্তি হবে বলছে। হ্যাঁ রে, তোদের কি হবে?”
(চলবে)
লিখুন লিখুন আরো আরো লিখুন, আপ্নাদের কথাগুলো জানুক সবাই।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
এটা খুব ভাল হয়েছে। প্রয়োজন ছিল।