সারাদিনে অসংখ্য ফোন আসে। এই করোনা মহামারীর সময়ে বেশ কিছু অদ্ভুত ফোনও পাচ্ছি।
একটা ফোন পেলাম। ‘ডাক্তার বাবু, আপনার গাড়ি কি ভাড়া পাওয়া যাবে?’
শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম, ‘আপনি ভুল জায়গায় ফোন করেছেন। আমি ডাঃ ভৌমিক বলছি।’
ওপাশ থেকে উত্তর এল, ‘আমি আপনাকেই ফোন করেছি। আপনার গাড়িটা ভাড়া দেবেন ঘন্টা আটেকের জন্য? যা ভাড়া লাগে দেব।’
কি দিনকাল পড়েছে! মহামারীতে মনে হয় লোকজনের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার গাড়ি ভাড়া চাইছে! আমার সবেধন নীলমনি একটা স্কুটার। ওটা ভাড়া দিলে এই করোনার মরশুমে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখব কি করে?
আমি বললাম, ‘ভাড়া নিয়ে আপনি কী করবেন?’
উত্তর এল, ‘বর্ধমানে যেতাম। ওখানে আমার স্ত্রী লকডাউনে বাপের বাড়ি আটকে পড়েছে। তাকে নিয়ে আসতাম।’
আমি ব্যাপারটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। বড্ড রোমান্টিক। স্বামী আমার স্কুটার চালাচ্ছেন। নতুন বউ তার কোমর জড়িয়ে বসে আছেন। আহা.. এই পথ যদি না….
কিন্তু আমার ঝড়ঝড়ে স্কুটার অতটা সহ্য করতে পারবে? মধ্যমগ্রাম থেকে বর্ধমান কম দূর নয়।
বললাম, ‘স্কুটার চালিয়ে যেতে পারবেন অতো দূর? লকডাউনের ঠিক আগেই পেছনের চাকার তিনটে লিক সারিয়েছি। রাস্তায় কিছু হলে পরে আমাকে দোষ দেবেন নাতো?’
অন্যদিক থেকে হাহাকার শুনলাম, ‘সেকি, আপনার চারচাকা গাড়ি নেই? শুনেছিলাম ডাক্তারের গাড়ি দেখলে পুলিশ আটকায় না।’
অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে ফোন কেটে দিলাম।
আগেও এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত ফোন পেতাম। একাগ্রচিত্তে একজন শ্বাসকষ্টের রোগীর হৃদপিণ্ডে গ্যালপ আছে কিনা স্টেথো দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, এমন সময় বুকপকেটে ফোনের ভাইব্রেশনে নিজের হৃদপিণ্ডে গ্যালপ শুরু হল। ফোন ধরতেই অভিযোগের তীর ছুটে এল, ‘আমি বুড়ো মানুষ। না খেয়ে রয়েছি। সাড়ে ন’টা বাজে। রক্ত নিতে কখন আসবে?’
বললাম, ‘আপনি ভুল জায়গায় ফোন করেছেন।’
‘হুঁ, আমাকে ঠিক ভুল শেখাচ্ছো! তোমার মতো ইরেস্পন্সিবল ছেলে আমি দেখিনি।’
‘দেখুন আপনি ভুল করছেন…’
‘হ্যাঁ, ভুল আমি করেছি। তোমাকে দায়িত্ব দেওয়াই আমার ভুল হয়েছে। তোমার চেহারা দেখেই বোঝা উচিৎ ছিল।’
‘সত্যি সত্যিই আপনি ভুল…’
‘চোপরাও। আমি সুগারের পেশেন্ট। এতো বেলা অবধি উপোস থাকার ফলে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে তোমার বিরুদ্ধে মামলা করব।’
‘কি আশ্চর্য, আপনি তো আমার কথাটাই শুনছেন না।’
‘সাড়ে ন’টার সময় এখন কথা শোনানোর চেষ্টা করছ। ছোটোলোক, ইতর, লজ্জা করেনা তোমার?’
বাধ্য হয়েই ফোন কেটে দিলাম। পরক্ষণেই আবার ফোন। ধরলাম না। ফোন সাইলেন্ট করে দিলাম।
ঘন্টা দুয়েক রোগী দেখার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম ফোন এখনো সাইলেন্ট করা আছে। খুলে দেখলাম বত্রিশটা মিসকল। তার মধ্যে কুড়িটাই ওই ভদ্রলোকের। যার রক্ত আনতে যাওয়ার কথা সে যদি সত্যি সত্যি যায়, খবর আছে।
ইদানীং আরো অদ্ভুত অদ্ভুত ফোন পাচ্ছি। অনেকেই ফোন করে জানতে চাইছেন এসময় রোগীদের প্রেশার দেখছি কিনা।
প্রথম প্রথম অবাক হচ্ছিলাম। ‘প্রেশার দেখব না কেন?’
জবাব পেলাম, ‘প্রেশার দেখতে হলে আমাকে ছু্ঁতে হবে। এই মহামারীর সময়ে আপনি কি রোগীদের ছোঁবেন?’
মনে মনে হাসলাম। রোগের ভয়ে রোগীকে ছোঁবো না! জ্বরের রোগীর হাঁ করে গলা দেখব না? শ্বাসকষ্ট রোগীর বুকে স্টেথো চেপে ফুসফুসের শব্দ শুনব না? পেটে ব্যথা রোগীর পেট টিপব না?
চিকিৎসকের স্পর্শে রোগীরা যেমন ভরসা খুঁজে পান, তেমন রোগীর দেহ স্পর্শ করে একজন চিকিৎসকও পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। কোনো মহামারীই চিকিৎসক রোগীর এই সমীকরণ নষ্ট করতে পারবে না।
এই বিশ্বাস টুকু সম্বল করেই চিকিৎসকরা উপযুক্ত সুরক্ষা ছাড়াই এক ডেথ মিশনে নেমে পড়েছেন। সেই বিশ্বাস টুকু রক্ষা করার দায় কিন্তু আপনারও।