২৭শে মার্চ, ২০২০
প্রথম দিনের অবিন্যস্ততা কাটিয়ে একটু একটু করে ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছিল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। কর্মীদের বাড়িতে যাতায়াতের বাসের রুটের সংখ্যা পাঁচ থেকে বেড়ে নয় হয়েছে।
ব্যারাকপুরের বাস আরও এগিয়ে নৈহাটি পর্যন্ত যাচ্ছে। দক্ষিণের বাসও যাচ্ছে সোনারপুর অবধি। ব্যবস্থা হয়েছে কর্মচারীদের দুপুর আর রাতের খাবারেরও। সাধারণ ডাল-ভাত-সব্জি-ডিমভাজা,কিন্তু সেইটুকুর চিন্তা অন্তত একটানা ডিউটিতে করতে হচ্ছে না, এটাও কম কথা নয়।
নতুন সময় সারণিতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলাম আমরা। চেষ্টাটা সহজ নয়।
যেমন সহজ ছিল না দেশের বিশাল অসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণীর জীবন ও জীবিকার উপর হঠাৎ করে লকডাউনের খাঁড়া নেমে আসা।
ওরাও হয়ত মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিল, চেষ্টা করছিল মেনে নিতে— খিদে, বেকারত্ব, আত্মীয়-বিচ্ছেদ। অনেক মন্বন্তর পেরিয়ে, দেশের সবচাইতে পিছিয়ে পড়া শ্রেণী আবার নতুন করে জানছিল, দরিদ্রের জুতোয় পা গলিয়ে, ঠিক তাদের সঙ্গে পা মিলিয়ে পথ হাঁটার জন্য কোনোকালেই কেউ বড় একটা ছিল না। আজও নেই।
করোনা রোগী এলে মেডিক্যাল কলেজের সুপার স্পেশালিটি ব্লকে ভর্তি হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল আমাদের। প্রতিদিনই নতুন নতুন অর্ডারের কথা পল্লবিত হয়ে কানে আসছিল— কোনটা যে সত্যি আর কোনটা শুধুই সরকারের প্রস্তাব, বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। মনে হচ্ছিল আমাদের হাসপাতালের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও আমাদেরই মতো বিভ্রান্ত— কেউ কিছু বুঝতে পারছেন না।
নাইসেড, আইসিএমআর, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক, বিভিন্ন মিডিয়া হাউস, বিদেশের কোভিড-গবেষণা রিপোর্ট— সব কিছুর মাঝে আমাদের যেন দিশেহারা অবস্থা। চিকিৎসার কোন গাইডলাইন মানবো, কোথায় কি ধরণের সুরক্ষা-পোশাক পরতে হবে, কোন মাস্ক ১০০% নিরাপদ, এই সব ব্যাপারে অন্ধকার হাতড়াচ্ছি সকলে— অজ্ঞানতার অন্ধকার।
এরই মধ্যে শোনা গেল, সব ডিপার্টমেন্ট থেকে লোকজন তোলা হবে, করোনা চিকিৎসার স্পেশ্যাল টিম তৈরি হবে এবার। ডিউটি শিডিউল এ রকম হবে— এক প্রস্থ লোকের এক টানা সাত দিন ডিউটি, তারপর হাসপাতাল নির্দিষ্ট নিভৃতবাসে চোদ্দ দিন আইসোলেশন। তারপর যদি সব ঠিক থাকে, মানে, সেই স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনার কবল থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তবে তারা সাতদিনের জন্য নিজের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পাবে।
রোস্টারের বিবরণ শুনে আমাদের সকলের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল।
দুপুরবেলার অবসরে, আমি আর ব্লাডব্যাংকে আমার এক যুগের সঙ্গিনী কৃষ্ণাদি বসে মোবাইলের স্ক্রিনে সংক্রমণ আর মৃত্যুর গ্রাফের উল্লম্ফন দেখছিলাম শঙ্কিত মুখে, এমন সময় গুটি গুটি আমাদের ঘিরে এসে দাঁড়াল ছোট ছোট টেকনিশিয়ান ছেলে মেয়েগুলি।
টুকরো টুকরো কথায় তাদের অসুবিধা দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তার আতংকের ভাগীদার হয়ে উঠলাম আমরা দুই প্রবীণ ‘ম্যাডাম’।
কত বিচিত্র সমস্যা আর উদ্বেগের কোলাজ যে আঁকা হলো ব্লাড ব্যাংকের আর্জেন্ট ল্যাবের ছোট্ট রাঁদেভ্যুতে—–
একটি তরুণ ল্যাব টেকনিশিয়ানের বাড়ি কাঁথি। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা, মে মাসের গোড়ায় ডেট দিয়েছেন ডাক্তার। যদি লকডাউন চোদ্দই এপ্রিলের পরেও না ওঠে, সে বেচারি স্ত্রীর কাছে পৌঁছবে কেমন করে, এই উৎকণ্ঠায় মুখ শুকিয়ে গিয়েছে তার।
আর একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাসদেড়েক হবে। বর মেদিনীপুরে কর্মক্ষেত্রে আটকা পড়ে গিয়েছে আর সে রয়েছে মা আর ভাইয়ের সঙ্গে এখানে—উদ্বিগ্ন হলে বা মন কেমন করলেও সে নিরুপায়।
সিনিয়র নার্সিং স্টাফ একটি তরুণী আর তার টেকনিশিয়ান স্বামী দুজনেই এই ব্লাড ব্যাংকে কর্মরত। দুটো বাচ্চা ওদের— ছোটটা নেহাৎ দুধের শিশু। দুজনের একটাই চিন্তা, যে ওদের দুজনকেই যদি কোভিড ডিউটিতে তুলে নেয় হাসপাতাল, বাচ্চা দুটোকে কে দেখবে?
এই রকম নানা বিপন্নতার খণ্ডচিত্রে ভরে উঠল মনের ক্যানভাস। ভালো লাগছিল না কিছুই।
যেহেতু করোনা-সন্দেহভাজন ব্যতীত অন্যান্য রোগী ভর্তি একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমাদের হাসপাতালে, ব্লাডব্যাংকে রক্তের প্রয়োজনে রোগীর আত্মীয়দের আনাগোনাও প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল। একটি দুটি অতি রক্তাল্প থ্যালাসেমিয়া রোগীর বাড়ির লোকই কেবল এসেছে সকাল থেকে।
এর মধ্যে, সরকারি মাস্কের সাপ্লাইয়ের আকাল দেখে, আমাদের দুই সহকর্মী দাদা হানা দিয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের একটিমাত্র অবারিত দ্বার ওষুধের দোকানে। গুজব, সেখানে নাকি থরে থরে বিকোচ্ছে হীরের চেয়েও দুষ্প্রাপ্য এন নাইনটিফাইভ মাস্ক!
খানিক বাদেই,হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো মুখ করে ফিরল তারা। মাস্ক এনেছে। নিজেদের জন্য তো বটেই— আমাদের কয়েকজনের জন্যও। আমরা সওদা দেখার জন্য হামলে পড়লাম সদ্য কেনা প্যাকেটের উপর!
ও হরি! এগুলো তো মোটেই এন নাইনটিফাইভ নয়! তাহলে যে সাড়ে তিনশ টাকা করে দাম নিল একেকটার? দাদারা বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বললো— দোকানদার নাকি বলেছে, ঐ হলো! এন নাইনটিফাইভ না হোক, তার “মতো”ই তো! কাজ নিশ্চয় হবে!
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এলো। বদ্ধ ব্লাড ব্যাংকের ঘষা কাঁচের জানলার বাইরে রোদ মরে এলো, বুঝতে পারলাম। রাত্রের জন্য স্টক রেডি করে রাখতে হবে। কাজ গুছিয়ে যেতে হবে পরের শিফটের জন্য। তারপর বাড়ি ফেরার পালা।
চেয়ার ঠেলে উঠতে যাবো, এমন সময় আজহার বলে উঠল—“ম্যাডামরা, এত চুড়ি, বালা, গয়না এখন পরতে বারণ করছে কিন্তু। আপনারা নিজেদের সেফটি-র জন্যই এগুলো আর পরবেন না প্লিজ!”
আমরা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। মহম্মদ আজহারউদ্দিন আমাদের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের সবচাইতে স্বল্পবাক, নম্রভাষী পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি— গত দু’বছরে ওকে একসঙ্গে এতগুলো কথা বলতে এই প্রথম শুনলাম আমি।
হাতে অলংকার পরতে একটু ভালবাসি আমি — বেশি না, একটা বালা কি দু’গাছি চুড়ি, এই আর কি! এগুলো আমি বড় একটা খুলি না হাত থেকে। এমন কি বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলেও খুলিনি কখনো। জনান্তিকে বলি, এই অলংকার প্রীতির জন্যই সম্ভবত আমার সার্জারি বা গাইনি প্র্যাক্টিস করা হয়ে ওঠেনি কোনোকালেই!
বাড়ি ফিরে, ঘড়ি, চশমা, চুলের ক্লিপের সঙ্গে চুড়ি-বালাগুলোও খুলে ফেললাম বাথরুমে। নিজের নিরাভরণ হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল আমার।
এই রুক্ষ, রিক্ত জীবন শত দুঃখেও যে হাতকে এতদিন নিরলঙ্কার করতে পারেনি , দূরদেশের এক অচেনা ভাইরাস এসে তাকে এত সহজে এমন নিঃস্ব করে দিয়ে যাবে, কোনোদিন ভাবতে পেরেছিলাম কি?
(চলবে)
ম্যাডাম পরের লেখনীর জন্য অপেক্ষায় থাকলাম….