হাওড়া জেলা সরকারীভাবে করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে রেড স্টার এলাকা ( Red* Zone) বলে ঘোষিত হয়েছে। উত্তর ও মধ্য কলকাতা রেড জোন।
দুটি ঘটনা বলি। শোনা বা পড়া নয়। হাসপাতালে নিজের দেখা রুগীদের কথা। সরকারী তথ্য ফাঁস করার উদ্দেশ্যে নয়, আপনাদের রেড এলার্ট দেবার জন্য। আজকাল অবশ্য কয়েকজন ইন্টেলেকচুয়াল বলতে আরম্ভ করেছেন, এই ভয় দেখানো নাকি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি শোষক রূপ। আবার একজন শিক্ষকের পোস্ট দেখলাম যে করোনার মৃত্যুহার তো মাত্র ৩% – পুরোটাই নাকি পুঁজিপতিদের ব্যবসায়িক ফন্দি। যাকগে, ওঁরা পণ্ডিত, হাতে এখন অঢেল সময়, ওঁদের গবেষণা নিশ্চয় মূল্যবান।
আমি অবিশ্যি রাজনীতি-সমাজতত্ব কিছুই বুঝিনা। রোগ-রুগী-চিকিৎসা সামান্য বুঝি বলে ডাক্তারী করে অন্নসংস্থান করি। সেই সূত্রে মানুষের সুখ-দুঃখ, আপদ-বিপদ বুঝি। সেই গোদা বোঝা নিয়েই ঘটনাদুটি লেখা।
সম্ভ্রান্ত, কয়েক পুরুষের ব্যবসায়ীদের যৌথ পরিবার। দুই তরুণ ভাইয়ের হঠাৎ জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্ট। কোনো দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, বিয়েবাড়ির, কোনো কন্ট্যাক্টের স্পষ্ট ইতিহাস নেই। দু ভাই একসাথে কলকাতার পাঁচতারা হাসপাতালে ভর্তি হলেন। দুদিন পরে করোনা পজিটিভ। সেই সন্ধ্যাতেই প্রোটোকল অনুযায়ী দু -ঘন্টার নোটিশে পরিবারের বাকী ১৩ জন সদস্য ও বাড়ীর ড্রাইভার একসাথে সরকারী হাসপাতালের কোভিড -১ আইসোলেশন ওয়ার্ডে। বয়স ৬ থেকে ৭০। যাঁরা নিদেনপক্ষে তিনতারা হোটেলের বা রিসোর্টের নিচে কোনদিন থাকেন বলে মনে হল না – তাঁদেরই সরকারী হাসপাতালের নন-এসি ওয়ার্ড, এজমালী বাথরুম, লোহার খাট, মোটা চালের ভাত-কুমড়োর তরকারি-ডিমের ঝোলে দিন যাপন। নিয়মমাফিক প্রত্যেকের করোনা টেস্ট হল। পরিবারের আরও চারজন পজিটিভ। দু ঘন্টার মধ্যে তাঁরা কোভিড- ৩ হাসপাতালে ট্রান্সফার। পাঁচদিনের মধ্যে একটি সুখী,স্বচ্ছল পরিবার করোনাহত হয়ে তিনটি আলাদা হাসপাতালে টুকরো টুকরো – বিচ্ছিন্ন, বিধ্বস্ত, আসন্ন ভবিষ্যতের আশঙ্কায় ত্রস্ত।
এবারে অন্য পরিপ্রেক্ষিত। গ্রাম্য নিম্নবিত্ত ছোট্ট পরিবার। কর্তা জ্বর-শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হলেন। এখানেও কোনো ভ্রমণ বা জমায়েত-এর স্পষ্ট ইতিহাস নেই। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় করোনা টেস্ট হল। পজিটিভ এবং কোভিড-৪ লেভেলে ট্রান্সফার। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আমার হাসপাতালের আইসোলেশনে। পরের দিন করোনা টেস্ট – তিনজনেই পজিটিভ। পরেরদিন তিনজনে আরেক হাসপাতালে – পরিবার টুকরো। জানিয়ে রাখি, কর্তার অবস্থা বর্তমানে অতি সঙ্গীন।
ধরে নিন, এঁরা প্রত্যেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু এই দুর্যোগ? চোদ্দ থেকে আঠাশ দিনের এই অসহনীয় মানসিক চাপ? অনিশ্চয়তা? অর্থ-সামাজিক অবস্থান-ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে এর কিন্তু কোনো ব্যতিক্রম নেই।
আপনার ঈশ্বর না করুন, একবার ভেবে দেখুনতো যদি রোগটা বাধিয়েই বসেন! আপনি এক হাসপাতালে। আপনার গোটা পরিবার, মায় গৃহসেবিকা সমেত তুলে নিয়ে যাওয়া হবে কোনো আইসোলেশন সেন্টারে টেস্ট এবং পরবর্তী পরিণতির জন্য। কেউ জানতেও পারবে না, জানলেও কেউ দেখতে আসতে পারবে না। এই চাপটা নিতে পারবেন তো! আপনার পয়সা আছে বলে চেন্নাই- ভেলোর তো দূরের কথা, পছন্দমতন পাঁচতারা হাসপাতাল-নার্সিংহোমেও যেতে পারবেন না। যে সরকারী হাসপাতাল দেখলে নাকে রুমাল চাপা,দেন, সেইরকম কোনো জায়গায় স্রেফ ঘাড় ধরে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। এসি কেবিন নেই, নরম গদি নেই, টিভি নেই, মেঝেতে মার্বেল নেই, নিজের বাথরুম নেই, পছন্দমত খাবার নেই। পারবেন তো!
আর তিন-চার শতাংশ মৃত্যুহার? ষাটের নিচে বয়স হলে, কো-মরবিডিটি (আজকাল সবাই এটার মানে জানে) না থাকলে মারা যাবার সম্ভাবনা কম – ওটা হাজার হাজার মানুষের একটা সংখ্যাতত্ত্ব মাত্র। আপনার নিজের হলে আপনি ৯৭-এর দলে না ৩-এর দলে পড়বেন – সেটা আগে থেকে বলার সাধ্য আপনার জ্যোতিষীর থাকতে পারে, আমাদের কারুর নেই, এইটুক বলতে পারি। মশাই, চিকিৎসাবিজ্ঞানে, মানুষের শরীরে ওরকম দুয়ে দুয়ে চার হয় না- আর হয় না বলেই চিকিৎসায় দুর্ঘটনা ঘটে, আর আমরা ঝাড় খাই। সেকথা এখন থাক।
টেস্টিং-এর হার বাড়ছে। আরও বাড়বে। কিন্তু সাবধানতার মার নেই। Prevention is better than cure.
অতএব, সাবধান হোন। অত্যন্ত সাবধান। স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা ভেবে নয়। আপনার নিজের গরজে, আপনার পরিবারের জন্য। লকডাউন, যে কদিন চলে, মানুন। সংস্পর্শে আসা প্রতিটি মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলুন – মাস্ক পড়ে, বার বার হাত ধুয়ে। আগেকার দিনের শুচিবাইগ্রস্ত দিদিমা- পিসিমাদের মত।
রোগটা কিন্তু সুবিধার নয়। ওই তিন শতাংশের মধ্যে পড়লে কিন্তু একেবারে প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়……