২৯শে মার্চ, ২০২০
চলেছি হাসপাতালে। আমার মোক্ষ, আমার নেমেসিস, আমার কর্মক্ষেত্রে। লকডাউনের মাঝে রবিবার সোমবার আলাদা করা দুঃসাধ্য, ঠিকই— তবু, এই বাধ্যতামূলক বন্দীদশা যে বেশ অভ্যাস হয়ে আসছে মানুষের, রাস্তাঘাটের হাল দেখে এমনটা আন্দাজ করা মুশকিল।
মুচিপাড়া বাজারের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলাম। কেনাকাটা চলছে, দরাদরিও। সাইকেল আর রিকসার জ্যামে দু এক মিনিট আটকেও পড়ল আমার বাহন। প্রয়োজনে মানুষ খাবারদাবার কিনবেন, এটা তো স্বতঃসিদ্ধ, কিন্তু যে ভাবে রসনাতৃপ্তির বিকিকিনির আয়োজন চলছে দেখলাম— ত্বরাহীন, মাস্কহীন, দূরত্বহীন, দুশ্চিন্তাহীন বেচাকেনা— যেন ল–ম্বা ছুটিতে ‘এঞ্জয়’ করার রসদ জোগাড় করতে নেমেছে মানুষ— দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। আতংকিত ততটা নয়। কেন যেন আমার সে রকম একটা ভয় করছিল না আজ।অবশ্য সকলেই যে এমনটি করছেন, তা নিশ্চয় নয়, এমন ভাবতে ভাবতেই গাড়ি পার হয়ে গেল বাজার এলাকা।
চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে নিজের মনের গভীরে একটু তলিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। এই রকম বেয়াড়া কাজ আমি সচরাচর করি না যদিও— কারণ সেয়ানা মনটা আমাকে বড্ড অস্বস্তিকর সব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় তখন। এটা তার একটা নিষ্ঠুর খেলা।
আজ অবশ্য আমি সেই অস্বাচ্ছন্দ্যের পরোয়া না করেই ডুব দিলাম মনের ভিতর।
কেন আমার ততটা ভয় করছে না আজ?
মায়ের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে আমার আর আগের মতো উৎকণ্ঠা নেই? আমি কি এই মহামারী নিয়ে খুব বেশি ভাবতে ভাবতে, ভাবনার শেষ সীমায় পৌঁছে ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়েছি?
নাকি আমার বেশির ভাগ চিকিৎসক-বন্ধুদের মতো “ধুর, যা হওয়ার হবে”– এই নীতিতে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি?
প্রশ্নগুলো আলোড়ন তুললই মনে, কারণ, আমি মানুষটা স্বভাবত বেপরোয়া নই। অনাগত আশংকায় সিঁটিয়ে যাওয়া আমার মজ্জাগত। তাহলে?
যখন প্রথম একটা ঝঞ্ঝার ঘূর্ণির মতো এই অচেনা রোগটা আমাদের যাপনের আঙিনায় এসে আছড়ে পড়েছিল, তখন ঐ চৈনিক যোগসূত্র আর বাদুড়-প্যাংগোলিনের ছোঁয়াচের আভাস বাদ দিয়ে রোগটা সম্পর্কে কিচ্ছু জানতাম না। আজও কি জানি? আমি তো কোন ছার, বিশ্বের বাঘা বাঘা হাসপাতালের কর্মকুশল ডাক্তার আর নামী দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানী গুণী বিজ্ঞানীরাও এর সম্পূর্ণ রহস্যভেদ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
তবে হ্যাঁ, জানাও গিয়েছে অনেক কিছু। এখনো প্রতিদিনই আসছে নতুন নতুন তথ্য, নানা পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল, একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কারের হাতছানি। রোজই একটু একটু করে কাটছে অন্ধকার— পুরোটা কেটে নির্মল ভোর আসতে আর একটু দেরি আছে, এই ভরসাতেই কি ভয়ও কাটছে আমার, একটু একটু করে?
এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই চটকা ভেঙে দেখলাম, গাড়ি ‘রাজ্যের একমাত্র করোনা হাসপাতালে’র ইমার্জেন্সি গেট দিয়ে ঢুকছে।
এই কি শহরের কেন্দ্রস্থলের ব্যস্ততম সরকারি হাসপাতাল? গেট দিয়ে ঢুকলে, ডান দিকে এম সি এইচ বিল্ডিং। ওখানেই মেল এবং ফিমেল মেডিসিন ওয়ার্ড। রয়েছে কার্ডিওলজি বিভাগ এবং আইসিসিইউও। ঐ তো সেই ঐতিহাসিক সিঁড়ি— ‘সাগরিকা’ ছবিতে তরতর করে যেটা দিয়ে নেমে এসেছিলেন উত্তমকুমার। ঐ ধাপগুলোতেই দিনের ব্যস্ত সময়ে গা ঘেঁষাঘেষি করে বসে থাকেন মুমূর্ষু রোগীর আত্মীয় স্বজন, যাঁদের পেশেন্ট ভর্তি রয়েছেন ঠিক উল্টো দিকের জরুরি বিভাগে।
সেই সিঁড়ি এখন জনমানবশূন্য— কয়েকটা ছাই ছাই রঙের গোলা পায়রা কি যেন খুঁটে চলেছে সিঁড়িগুলোয়। রোগীর আত্মীয়দের ফেলে যাওয়া বিস্কুটের টুকরোর গুঁড়ো খুঁজে চলেছে কি ওরা? পাচ্ছে না কিছুই? ওরাও তাহলে লকডাউনের কারণপ্রসূত ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজে’র শিকার?
শুনশান ইডেন বিল্ডিংকে ডান দিকে ফেলে, গাড়ি দাঁড়াল ব্লাডব্যাংকের নিচে।
স্বাভাবিক অবস্থার গমগমে ব্লাড ব্যাংকের সামনে এখন অখণ্ড নিস্তব্ধতা।
আচ্ছা, লোকে কেন শ্মশানের স্তব্ধতার উপমা দেয় সবসময়? আমি একবারই ওতপ্রোতভাবে শ্মশান চিনেছি— বাবা চলে যাওয়ার সময়। শব্দের কোনো অভাব শুনিনি তো— ডোম আর কর্পোরেশনের লোকজনের হাঁকডাক, পুরোহিতের মন্দ্র মন্ত্রোচ্চারণ, শ্মশানবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বিয়োগব্যথা ভারাক্রান্ত স্বজনের কান্না— কে বলে শ্মশান নিস্তব্ধ?
নিস্তব্ধতা এখানে, এইখানে, যেখানে আমার মোক্ষ, আমার মুক্তি।
পায়ে পায়ে দোতলায় উঠে দেখলাম, সেখানে সকলে বেশ উত্তেজিত। একজন জুনিয়র টেকনিশিয়ন একটু দ্বিধায় আছে— সম্ভাব্য করোনা রোগীর PCR টেস্টের নমুনা সংগ্রহের কাজ যদি দেওয়া হয় তাকে, কি ভাবে করবে— কারণ তার তো প্রশিক্ষণ নেই। অপেক্ষাকৃত সিনিয়র এক দাদা তাকে বোঝাচ্ছে কি করে নিতে হবে নেসোফ্যারিঞ্জিয়াল সোয়াব আর কি করেই বা সংক্রমণের সম্ভাবনা এড়িয়ে করতে হবে সেই পরীক্ষা।
উৎসাহী কোনো ল্যাব-কর্মী আবার ঝুঁকে পড়েছে হাতের স্মার্টফোনের স্ক্রিনের উপর— সেখানে হোয়াটস্যাপের খোলা পাতায় কোনো লিংকের ক্লিকে খুলে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরণের করোনা পরীক্ষার হাল হকিকত।
আজ আমার রাত সাড়ে আটটা অবধি ডিউটি। সচরাচর এতক্ষণ ডিউটি থাকলে সন্ধ্যের মুখে আমি চা আনতে পাঠাই কোনো গ্রুপ ডি দাদাকে। চায়ের সঙ্গে কিছুমিছু মুখরোচক ‘টা’ও থাকে— কোনোদিন পুঁটিরামের সিঙাড়া, কোনোদিন মুড়ি বেগুনি বা ঝাল আলুর চপ— যেদিন যা পাওয়া যায়।
তবে আজ তো অন্যরকম— তাই বেকারি বিস্কুট আর চা দিয়েই বিকেলের টিফিন সারছিলাম সবাই। গতকাল মেডিক্যাল কলেজের কোভিড ১৯ চিকিৎসার স্পেশ্যাল টিম ‘তন্তুজে’র ছাপ মারা ছেঁড়া রেনকোট পেয়েছে পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্টের অঙ্গ হিসেবে, এই নিয়ে বেশ চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে— এইসব আলোচনা চলছিল চা আর বিস্কুট সহযোগে।
হঠাৎই আমার সেই হোয়াটস্যাপ বিলাসী সহকর্মী চিৎকার করে উঠল, তার চোখ তখন মোবাইলের স্ক্রিনে। “ম্যাডাম, কমান্ড হসপিটালের এক ডক্টর, বোধ হয় অ্যানাস্থেটিস্ট, করোনা পজিটিভ হয়েছেন! এবিপি আনন্দে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে! বেঙ্গলে এই প্রথম কোনো ডক্টর পজিটিভ হলেন ম্যাডাম—”
সকালবেলার নির্ভীক প্রশান্তি কোন এক ভয়ংকর ঝড়ের ফুঁয়ে উড়ে গেল যেন।
আমার কানে বাজল দূরাগত কোনো অশ্বারোহীর ঘোড়ার খুরের আওয়াজ— অস্পষ্ট, কিন্তু নিশ্চিত।
আসছে, সে আসছেই তাহলে। কপট নিশ্চিন্ততার কপাট, হাট করে খুলে দিয়ে এইবার তার মুখোমুখি হওয়ার সময় আসছে।
সকলকে ডাকি— আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।
(চলবে)