ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল শংকর পাণ্ডের হাত ধরে। ওদের বাড়ি বাড়ি খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেবার খবরের পাশে এক অপুষ্ট বাচ্চার খবর লেখা হয়। বারাসাতে। মুখার্জি পাড়ার কাছে। তখন সবে সবে লক ডাউন। লোকজন বেরোচ্ছেন। রাস্তায় ফাঁকা পীচ পথ শুয়ে থাকে খাঁ খাঁ। ঠিক করি হেলথ ক্যাম্প হবে। ওদের বাড়ির কাছে গিয়ে। সেই শুরু। তারপর থেকে অনেকগুলি হল।
বাড়ির কাছে গেলে রুগীদের বাড়ির লোক বাড়ির লোক লাগে। তাদের বেঁচে থাকা, দিন যাপন, ঘরের ছাদ, নড়বড়ে দেওয়াল, মলিন জলের গ্লাস ছাপ ফেলে ডাক্তারীতে। পাল্টে যায় অনেক কিছুই। কাছ থেকে, একেবারে ঘরের ভেতর থেকে দেখা যায় অসুখ, অসুখের উৎস। নিরাময়ের রাস্তা। তার অদেখা জটিলতার আনাচ কানাচ। এই যেমন ধান তলার সেই ছেলেটা, অ্যাকসিডেন্টে ভেঙে যাওয়া হাঁটুর নীচটা। অনেকগুলো অপারেশনের পরও অস্টিওমায়েলাইটিস খুবলে নিচ্ছে প্রতিদিন। ট্রেন চলছেনা। দিন আনি দিন খাই পরিবারের সামর্থ্য নেই গাড়ী ভাড়া করে জহরলাল যায়। অপেক্ষায় দিন গুনছে ক্রমশই বাড়তে থাকা লক ডাউনের শেষ হবার। যেন অলৌকিক সেই ভোরে স্বাভাবিক পৃথিবীর স্বাভাবিক আউটডোরে আবার দেখাবে সে। ততদিন কত কি হয়ে যেতে পারে! সে হয়তো বোঝেও। তবুও অপেক্ষা করে। লকডাউন শেষ হবার।
এই কদিনে এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের খুব আকাল। ট্রেনে করে আসতেন যাঁরা, আসতে পারছেন না। অতএব যা হয়। কার্ডিওলজি থেকে গাইনোকলজি সব কেস এসে ভীড় করে ক্যাম্পে। সামান্য বিদ্যে নিয়ে যত্ন করে দেখি। যতটুকু বুঝি পরামর্শ দিই। মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধবদের, দাদাদের ফোন করে জ্বালাই।
এই যেমন আমাদের পাড়ার ছেলেটি। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস। নীলরতনে চিকিৎসা নিয়ে ভালোই ছিল। কিন্তু হকার বাবার ট্রেন না চললে ইনকাম ফক্কা। হাসপাতাল থেকে পাওয়া ইনসুলিনের ভান্ডার শেষ হতেই ধুঁকতে বসেছে সে।
কদিন আগে এরকমই এক ক্যাম্পে বসেছিলাম, গলদঘর্ম। হঠাৎ খবর এল একজন অজ্ঞান হয়ে গেছে। পাশেই। যদি একটু যাই। পাশেই। তা গেলাম। গিয়ে দেখি বছর ত্রিশের এক গৃহবধূ। ইনফার্টিলিটির চিকিৎসা চলছিল কলকাতায়। এসেও ছিল ইস্যু। তিনমাস। কয়েকদিন আগে হঠাৎ মিসক্যারেজ। সেই আমার অজ্ঞান হওয়া পেসেন্ট।
দেখলাম। আপাতত ভয়ের কিছু নেই। আসলে মানসিক অবসাদ চেপে ধরেছে তাকে। তার বিছানার পাশে ডাঁই করা ওষুধ। ফলিক অ্যাসিড। ভিটামিন। মাদার্স হরলিক্স। এসব কিছুই আর দরকার নেই। যার জন্য এতকিছু সেই আর নেই। মূর্তিমান হতাশার মত সব কিছু শেষ হবার পরও সেগুলি স্পর্শহীন রয়ে গেছে। এসব দেখি। কিছুই করতে পারি না। ঘুমের ওষুধ, ডিপ্রেশনের ওষুধ লিখি। সান্ত্বনা দিয়ে চলে আসি। ‘এখনও বয়েস যায়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
অথচ ঠিক হয় না কত কিছুই। সেই মাকেই বা সান্ত্বনা কি করে দেব আমি, যার রেফার হওয়া সন্তান মারা গেছে মায়েরই কোলে। ইন্টেস্টিনাল অবস্ট্রাকশন । সামাজিক দূরত্বের ভয়, ভয় দিনকালে অর্থ জোগাড়, গাড়ী জোগাড়, তারপরও কত শত বিপত্তি থাকে! তবু সে গেছিল। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। হয়তো এসব না থাকলে গাড়ি জোগাড় হত তাড়াতাড়ি। রাজস্থানে আটকে থাকা ছেলেটার বাবা বাড়ি থাকলে চটপট জোগাড় হত সব। হয়তো… হয়তো… প্রতিটা দিন একগাদা হয়তো-র অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়া একটা মাকে কিভাবে সামলাবো আমি। আমার সামান্য চিকিৎসাবিদ্যা কিভাবে সামলাবে এইসব এত এত যন্ত্রণার অভাবের ইতিহাস! পারি না। তবুও বসি। ক্যাম্পের সামান্য কিছু ওষুধ আর বিনিপইসার পাশকরা ডাক্তার দেখাবার জন্য প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ভীড় করা মানুষগুলোর বিপি মাপি, গল্প শুনি।
একগাদা কিচ্ছু না করতে পারা অপরাধ বোধের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে দু একটা শুকনো চোখ জলে টস টস মা। কেরালার সেই হাতিটার মতন …
অসাধারণ