সেদিন সকাল থেকেই আকাশবরণ শাড়ি পরে নাচতে লেগেছিল মেয়ে| বইপত্তর রংপেন্সিল সব ফেলে সে মেয়ের খালি নাচ| নাচ খালি|
বুদ্ধি সাধারণের থেকে অনেকখানি কম| আজকের পড়া কালকে ভোলে| কথা অস্পষ্ট| এমনকি সে যে কথা বলছে মুখের কাছে কান না নিলে বুঝতেই পারবেন না| ডাক্তার বলেছেন — delayed learning problem| সব ভোলে কিন্তু নির্ভুল শব্দে বলে নিজের রোগের নাম| নাচে চমৎকার|
সেদিনের নাচের সাথে গানটি ছিল– মেঘের কোলে রোদ এসেছে / বাদল গ্যাছে টুটি| বোধহয় পরের দিন স্কুলে অনুষ্ঠান হবে, তারই মহড়া| অনুষ্ঠান যত ছোটই হোক মহড়া করে কিন্তু রাজকীয় মেজাজে| এমনকি ক্লাসঘরের মধ্যেও যদি অনুষ্ঠানটা হয়, তাও তার মনোযোগ অখন্ড| এও খেয়াল করে দেখেছি, গানের অর্থ তার মত করে বুঝিয়ে না দিলে কিছুতেই নাচতে রাজি করানো যায় না মেয়েটাকে| যদি বা রাজি হল, ভঙ্গি স্বচ্ছন্দ হয় না| নাচের সাথে মুখের হাসিটিও হয়ে থাকে তোরঙ্গে চাপাপড়া অনেক পুরোনো কাপড়ের মত|
সেদিনও বারবার বলে চলেছিলাম–“দ্যাখ, এ হলো গিয়ে মেঘ সরে আলো ঝরার গান| ভাব– একদিক দিয়ে মেঘ সরবে আর সরার সাথে সাথেই অন্যদিকে আলো গড়াবে মাটির পরে– মানুষের গায়ে| “মেয়েটা চুপ করে শুনলো| সত্যিকারের ধার্মিক যেমন নিবিষ্ট হয় পুজোর মন্ত্রে– অমনি একটা তন্ময় ভাব ফুটলো তার মুখে| এরকম ভাব ফুটলেই বুঝি, সে তার নাচমন্ত্র এবার বুঝতে পেরেছে| ভাবের ঘোর এইবারে ভরিয়ে দেবে তার গাবলু শরীর|
তাই হল| “মেঘের কোলে ” নাচতে নাচতেই বার দুয়েক দৌড়ে গেলো ক্লাসঘরের জানলায়| শিকের গায়ে নাক ঘষটে আকাশ দেখলো| আকাশে তখন লেশ নেই মেঘের| শুরু করলো ঘ্যানঘ্যান–“এরকম আকাশের গান দাও না মিস| মেঘ লাগবেই না| এমন গান দাও যে গানে আকাশ সবসময় থাকবে আলো আর রোদে| একদম full রোদের আকাশ| আমি নাচব চরাম চরাম| এ ছন্দ কেবল তার আর আমার| আমার মুখে চরাম চরাম শুনলেই নাচ যেন তার উপচে পরে শরীর বেয়ে|
বললাম– পরে দেব তোর রোদআকাশের গান| এখন নাচ| নাচ– চরাম চরাম| দেখি, ক্লাসঘরের বাতির তলায় দাঁড়িয়ে নিজের ছায়ায় লাথি মারছে সে| মেরেই চলেছে| ছায়া তো মরে না| একই থেকে যাচ্ছিল| ফুলবড়ি নাক তার কুঁচকে যাচ্ছিল| অপছন্দে আঁধার হচ্ছিল চোখ| আলো ছায়ার হাতাহাতি একদম পছন্দ হচ্ছিল না তার|
দরজা দিয়ে ছুটল বারান্দায়| আর তারপর স্কুলের ঠিক বাইরের ছোট গলিটায়|
একেবারে আচমকা| আচমকাই রোদের মধ্যে মেলে ধরলো আকাশী কস্টিউম| বনবন করে ঘুরছে মেয়ে| নীল আঁচল ঘুরছে বনবন| কানের কাছে এসে বললে– “ও মিস, ও মিস, কী বিউটিফুল| রোদও full| ওই আকাশে–‘|
কর দেখি চরাম চরাম| আবার শুনি–
ময়ূরীদেবী আপনাকে কুর্নিশ করি। এই ধরনের শিশুদের বোঝাতে গেলে এবং বুঝতে গেলে যে ভালোবাসা, বোধশক্তি ও ধৈর্য ধরতে হয় সবটাই আপনার আছে। আর এই ভালোবাসার বন্ধনের আনন্দ আমাদের সাথে ভাগকরা টা আমার খুব ভালো লাগে।
আমরা যারা নিজেদের মনে করি অনেক বোধের বুদ্ধিওয়ালা তারা এতটা অকৃত্রিম হতে পারি না। জীবন – সময়ের অনেকটাই অভিনয়ে ঢেকে রাখি। একরত্তির অপটু মস্তিষ্ক দেখ সত্য বোঝে।
আর তুমি, ময়ূরী , বোঝো অবুঝ মনগুলোকে। আমি যোযন দূরত্বে —