আমার আউটডোর নিয়ে আমার স্টাফদের অভিযোগ অনেক| সকাল সকাল গল্প করি পেসেন্টদের সাথে| আর বিকেল বেলা ‘আর কত, আর কত’ বলে চিল্লাই-মিল্লাই করতে থাকি| টিকিট করার হরিপদদা খেপে যায়| খেপে যাবারই কথা| তাঁদের অভিযোগ তো মিথ্যে নয়| আমি গল্প করতে করতে রুগী দেখতে ভালোবাসি| এই যেমন ধরুন একপেড়ে পাড়ার টাক বুড়ি| তার ভাগের দু কাঠা জমিতে পুঁই শাকগুলি কতটা লকলকে হলো, বিপি মাপতে মাপতে জিজ্ঞেস করি আমি| বুড়িও তার বাড়িতে শেয়ালে মুরগী নিয়ে যাবার গল্প বলে| তার ফাঁকে ফাঁকে রুগী দেখাও চলে| কোন বৌমা দেখে কোন বৌমা কি বলে সেইসব অভাব অভিযোগ সাংসারিক টুকুর-মুকুর গল্পের ফাঁকে বুড়িও জিজ্ঞেস করে টমেটোম খেলে ইউরিক অ্যাসিড বাড়বে কিনা| এইভাবে সময় বয়ে যায়| ধৈর্য্যচ্যুত রুগীরা ফিসফাস করে| আমি আবার হাত চালাই| লাইনের লেজ বাড়ছে বাইরে|খবর শুনিয়ে যায় কেউ একটা|
অথচ আমার স্বভাব বদলাবার নয়| সুযোগ পেলেই গল্প জুড়ে বসি| সকাল থেকে দূর দূর থেকে হেঁটে আসা মানুষগুলির সাথে বকর বকর করি| ওষুধ খাচ্ছে না কেন সেসব নিয়ে ঝগড়া করি| আগডুম বাগডুম অজুহাত দেয় কেউকেউ| আমিও কপট রাগ দেখাই| বুঝি তো| এই যে মাঝেমধ্যে ওষুধটুকু বাদ দেওয়া, তার গল্পও তো কম কিছু নয়| কারও গরুর বাচ্চা হয়েছে| কয়েকদিন পরথেকেই ঘোষ এসে নিয়ে যাবে কেজি তিন| সেই ভরসায় বসে থাকে সালেমা বিবি| সুগারের ওষুধটা কিনবে| পঞ্চু খুড়োর তেজিয়াল বাঁশ ঝাড় থেকে বিক্রি হলেই পোয়াতি মাইয়াডার আলতাসনু হবে| আমি খুব মন দিয়ে এইসব শুনি| বাঁশগুলো দুদিন আগেই না হয় বেচো| খুড়ো হাসে| এই মাসে তো বেচতে নাই বাবু| মাস ফুরোক|
এই সব গল্পের সরুসরু কুঁচি আলপথ, তাঁদের বিশ্বাস অন্ধবিশ্বাস, সংস্কার কুসংস্কার আমার প্রেসক্রিপশন পাল্টে দেয়| থাক|এট্টুআদটু পাই তো ফুলেছে| আমি আম্লোডিপিনটাই রেখে দিই| সাপ্লাই আছে| পরের মাসে দেখবো খন|
করোনার সময় প্রথম প্রথম আউটডোরের ভিড় একটু কম ছিল| লোকজনের ভয় ছিল| অজানা একটা ভয়| এখন সেসব কেটেছে| মাথা ঝিনঝিন কিংবা পা কনকন নিয়ে দিব্বি লাইন দিচ্ছে লোকজন| লম্বা লাইনের মুখের কাছে দাঁড়িয়ে হাঁক দিচ্ছে সিনুদাঃ জাহানারা মন্ডল, বিন্দুবাসিনী হালদার, জিতেন সাধুখাঁ …টুকুস টুকুস রুগী কমছে| পেছনের লেজও বাড়ছে ঢিলিক ঢিলিক| কার আগে কার পেছনে সেই বিতন্ডার ফাঁকে বিপি মাপার হুস হাস, সুপ্রাচীন ফ্যানটার ঘটর ঘটর ..এমনকি গল্পগুজব এগুচ্ছে সবই|
নীলিমা সন্ন্যাসীর সমস্যা অনেক| প্রাগৈতিহাসিক অন্নপ্রাশনের পর শুরু হওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য ছাড়াও তার মরদই তার সবচেয়ে বড় সমস্যা| মালের দোকান বন্ধ| ৪০০ টাকায় ব্ল্যাকে আনছে ভাগযোগ করে| মেয়ের খুচরো জমানো ঘট, নীলিমার লুকিয়ে ঢুকিয়ে রাখা বিপদ আপদের সঞ্চয় উপড়ে নিচ্ছে সব| আমি এসবও শুনি| তার কোষ্ঠকাঠিন্য আর পেটঘুরঘুরের দীর্ঘ ইতিহাস এবং পিজি হাসপাতালের ধুলোজমা কাগজপত্তরের ভেতরে মানসিক চাপের দীর্ঘমেয়াদি হতাশা খুঁজেখুঁজে পাই| ডিপ্রেশনের ওষুধ খেয়ে মন্দের মধ্যে ভালো থাক সেও| লক ডাউনের ৩ কিলোমিটার পয়দল পার হয়ে ধূলিমাখা মুখে প্রায় পাতলা হয়ে আসা মাস্কের ভেতর থেকে সে হাসে| ভালো আছি বাবু| তাইলে কি আর ওষুধ লাগবে! আমি চমকে উঠি| না না| এখনই বন্ধ করো না কিন্তু| জানি একটু ভালো থাকলেই বন্ধ হবে ওষুধ| তারপর আবারো তিন কিলোমিটারের পায়ে চলা ঘাম আঁচলে মুছতে মুছতে সে আসবে|পেটটা আবার কিরাম কিরাম করে বাবু|হজম হয় না| আমি এসব দেখি| অবসরে বারান্দায় রাতের নিস্তব্ধ হাসপাতাল দেখতে দেখতে হিসেব কষি, কতটুকু এর শরীরের রোগ কতটুকুই বা সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা ভাবি| সমাধানের তল পাই না| তখনি ডাক আসে| বিনয় কবিরাজ|
তার সমস্যাও তো কম কিছু নয়| প্রেসার আছে| হাঁপের টান আছে| দিন আনে দিন খায়| লোকের বাড়ি জঙ্গল সাফ করা| মাঝে মধ্যে রাজমিস্তিরির জোগালি| কাজ তার অনেক| আজ অবধি সে কখনও আউটডোরে টাইমে আসেনি| টিকিট ফিকিট গুছিয়ে নিয়ে হরিদা যখন সারা দিনের খাটুনির পর সবে একটু উঠি উঠি করছে, আমিও বিপি টিপি গুছিয়ে স্টেথস্কোপ গুছিয়ে ফেলেছি ব্যাগে, তখনি তিনি আসেন| হেলতে দুলতে| গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে আকর্ণ হাসেন| পিসারের ওষুধ তো ফুরায় গেছে বাবু|
হরিদা রাগ করে| আমি চেঁচাই| প্রতিদিন এসময় তোমার টাইম হয়! অথচ আগে আসলে তার যোগালদারী, মুনিশের কাজ চলবে কি করে| তাই সে ঐসময়েই আসে| রাগ করতে করতে দেখে দিই আমি| নতুন করে হিসেবে বসে হরিদা| কয়েকটা আম্লোডিপিন, কয়েকটা ডেরিফাইলিন নিয়ে সে দোকানে যায়| খোশমেজাজে| ওভারটাইম খেটে এসে ইনহেলার কিনতে পারবে আজ|
আমিও ব্যাগ গোছাই| গ্ল্যামার-এর কিক স্টার্ট দিয়ে বিকেলের ঢালু রোদ মাখতে মাখতে বাড়ি যাই| কিংবা কোনও চেম্বারের দিকে|দুপাশে বাড়ি ঘর| শুনশান ফুচকা মোড় |একা একা দাঁড়িয়ে থাকা গান্ধী মূর্তি| রাস্তায় লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল আল্পনার মত পরে থাকে|একাকী|
এইসব ঘাম, অভাবী আউটডোর, নিঃসঙ্গ নির্জন বিকেল, মানুষের হতাশা, তারই মধ্যে ভালোলাগা, ভালো থাকা এক ঘোর ঘোর কোলাজের মধ্যে ডুবিয়ে নেয় আমায়|
রেল লাইনের ওপারে দিগন্ত লাল করে সূর্য ডোবে| যেভাবে ডুবতো| রোজ| পৃথিবীর নিজের নিয়মে||
Sontu kaka aya ki tomar blog web dhoroner kono site