বিশ্বে এখন অবধি মোট ১.৪ কোটি মানুষ নোভেল করোনা ভাইরাস সংক্রামিত এবং ৫ লক্ষ ৯৭ হাজার জন মৃত। সারা পৃথিবীর মানুষ তাই অধীর আগ্রহে ভ্যাক্সিনের প্রতীক্ষায়।
এর মধ্যে, সোমবার (২০ জুলাই) ‘দ্য ল্যানসেট’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীদের তৈরি COVID-19 ভ্যাক্সিনের (ChAdOx1 nCoV-19) প্রাথমিক ধাপের ফলাফল। ব্রিটিশ-সুইডিশ ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে যৌথভাবে এই ভ্যাক্সিন তৈরি করেছে অক্সফোর্ড।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (অর্থাৎ, মানুষের দেহে প্রয়োগ)-এর প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ২৩শে এপ্রিল থেকে ২১শে মে অবধি ১ হাজার ৭৭ জন সুস্থ ও ১৮-৫৫ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবকের দেহে অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেটটি প্রয়োগ করা হয়েছিল।
মানবদেহে প্রথম ধাপের পরীক্ষায় ভ্যাক্সিনটি নিরাপদ এবং ইমিউন সিস্টেমের শক্তি বৃদ্ধি করে বলে জানিয়েছেন অক্সফোর্ড বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেখা গেছে, ভ্যাক্সিনটি পরীক্ষার ৫৬ দিন পর্যন্ত অ্যান্টিবডি ও কিলার টি-সেল উৎপাদনের মাধ্যমে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম। এদের মধ্যে কয়েকজনের উপর বুস্টার ডোজ প্রয়োগে দেখা গেছে, প্রত্যেকের দেহেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে।
তার মানে কী ভ্যাক্সিনটি ইতিমধ্যেই সফল? আমরা কি “করলো করোনা মুঠ্ঠি মে” বলার জায়গায় পৌঁছে গেছি?
উঁহু! করোনা প্রতিরোধে এই ভ্যাক্সিন শতভাগ কার্যকর তা কিন্তু এখনই বলা যাচ্ছে না। এখনও ‘লং ওয়ে টু গো’!! তৃতীয় পর্যায়ের ফলাফল না দেখে কিছুতেই বলা যাবে না করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই ভ্যাক্সিন আদৌ সফল হবে কিনা!
আসলে, যেকোনও ভ্যাক্সিন তৈরি এবং চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বছরের পর বছর এমনকি কয়েক দশকও লেগে যায়। মানব-স্বাস্থ্যের ইতিহাসে এত কম সময়ে এই ভাইরাস সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি এবং যে দ্রুতগতিতে ভ্যাক্সিন তৈরির চেষ্টা চলছে, তা অভূতপূর্ব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর খবর অনুযায়ী, এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবী জুড়ে ১৫০-এরও বেশি ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট ট্রায়ালের বিভিন্ন ধাপে দাঁড়িয়ে আছে। স্বভাবতই শুরু হয়েছে এক তীব্র রেষারেষি, কে ভ্যাক্সিন তৈরিতে ফার্স্ট হবে! আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। জুলাইয়ে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপ শুরু করে ১৫ ই অগষ্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের সময় ভ্যাক্সিন হাতে চলে আসা চাই, এ হেন রক্তচক্ষুকে সামনে রেখে আর যাই হোক, বিজ্ঞান গবেষণার মতো মহান কাজ হয় না! বিজ্ঞানের কোনও দায় নেই কারোকে খুশি করার বা চমক দেবার।
রাজনৈতিক নেতামন্ত্রীরা কতটা জানেন জানি না, তবে তাদের ধামাধরা সায়েন্টিস্টরা বিলক্ষণ জানেন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের নিয়মকানুনের ছাড় দেওয়ার কী বিপজ্জনক ফলাফল হতে পারে!
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগছে, সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
তাহলে, চলুন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিষয়টি একটু বুঝে নেওয়া যাক।
ফেজ ১ এবং ২-এ কতিপয় মানুষের ওপর দেখা হয় ভ্যাক্সিনের প্রয়োগে দেহের ইমিউন রেসপন্স এবং ভ্যাক্সিনের সাইড এফেক্ট।
এর পরের ধাপ, অর্থাৎ ফেজ ৩ টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই পর্যায়টিতেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর (যেমন, এশিয়ান, ককেশিয়ান, আফ্রিকান ইত্যাদি) ও বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে দেখা হয়, ভ্যাক্সিন নিয়ে মানুষ আসল সংক্রমণের মোকাবিলা কীভাবে করছে? ভ্যাক্সিন নিয়েও ভাইরাসের দ্বারা সংক্রামিত হচ্ছে, না কি সুস্থ হয়ে উঠছে?
এই পরীক্ষাটি করার সময় জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ পান সত্যি ভ্যাক্সিনটি (true candidate), আর কিছু মানুষকে ভ্যাক্সিনের বদলে দেওয়া হয় শুধুমাত্র স্যালাইন (প্লাসিবো)। ভলেন্টিয়ারদের কিন্তু জানানো হয় না কে সত্যি ভ্যাক্সিন পেলেন আর কে পেলেন না। এমনকি যাঁরা তাঁদের শারীরিক অবস্থার পরীক্ষা করে নথিবদ্ধ করেন, তাঁরাও জানতে পারেন না কে ভ্যাক্সিন গ্রুপের আর কে প্লাসিবো গ্রুপের! বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয়, ‘প্লাসিবো কন্ট্রোল্ড ডাবল ব্লাইন্ড র্যান্ডমাইজড ট্রায়াল’।
এর আগের দুটি পর্যায় অবধি পরীক্ষাগুলি কিন্তু ‘সিঙ্গল ব্লাইন্ডেড’ প্রকৃতির অর্থাৎ, ভলেন্টিয়াররা জানবেন কিন্তু তাঁদের পরীক্ষকরা জানবেন না। পরীক্ষার ফলাফলে বায়াসনেসের প্রভাব এড়াতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
থার্ড ফেজে, ভ্যাক্সিন/ প্লাসিবো নিয়ে ভলেন্টিয়াররা মহামারী পরিস্থিতিতে মিশে যান সাধারণ জনগোষ্ঠীতে। উদ্দেশ্য এটা দেখা যে, যারা ভ্যাক্সিন পেয়েছেন তাদের মধ্যে সংক্রমণ, যারা প্লাসিবো পেয়েছেন তাদের তুলনায় রাশিবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে উল্লেখযোগ্য ভাবে কম কি না।
এইবার, এইখানে অনেকগুলো অবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা।
১. প্লাসিবো আর ভ্যাক্সিন গ্রুপের মধ্যে কারোরই সংক্রমণ হলো না: গোষ্ঠীতে অতিমারির প্রকোপ কমে গেছে। এক্ষেত্রে, ভ্যাক্সিনের ক্ষমতা পরীক্ষিত হতেই পারলো না।
২. প্লাসিবো আর ভ্যাক্সিন গ্রুপের মধ্যে সমান সংক্রমণ: পরীক্ষিত ভ্যাকসিনটি ব্যর্থ।
৩. ভ্যাক্সিন গ্রুপের চেয়ে প্লাসিবো গ্রুপে সংক্রমণের হার বেশি: পরীক্ষিত ভ্যাকসিনটি সম্পূর্ণ সফল।
৪. প্লাসিবো গ্রুপের চেয়ে ভ্যাক্সিন গ্রুপে সংক্রমণের হার বেশি হলো, এমনকি তাদের প্রাণ সংশয় অবধি হয়ে গেল! শুনতে অবাক লাগলেও এরকমটাও হয়। আর এটাই ভ্যাক্সিন ডেভেলপমেন্টের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একে বলা হয় Antibody Dependent Enhancement (ADE) effect। অতীতে বহুবার এরকমটি ঘটেছে— Ebola , HIV, SARS, MERS ইত্যাদির ক্ষেত্রে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমনটি হয় ?
কারণ, ভ্যাক্সিনের প্রয়োগে আমাদের শরীরে দুইধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১. Neutralizing এবং
২. Non-Neutralizing অ্যান্টিবডি।
Non-Neutralizing অ্যান্টিবডি তার Fc চেইনের সাহায্যে আমাদের শরীরের প্রতিরোধক কোষের গায়ে আটকে থাকে।
শরীরে ভাইরাস ঢুকলে Non-Neutralizing অ্যান্টিবডি তার একটি চেইনের মাধ্যমে ভাইরাসকে ও আরেকটি চেইনের মাধ্যমে মানব কোষের Fc রিসেপটরকে আঁকড়ে ধরে
ভাইরাসকে কোষের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে কিন্তু তার সংক্রমণ রুখতে পারে না। ফলত: এই ধরণের অ্যান্টিবডি ভাইরাস-কে নিষ্ক্রিয় করার বদলে তাকে উল্টে সাহায্য করে এন্ডোসাইটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহকোষের ভিতরে প্রবেশে। এধরণের কমপ্লেক্স গঠন সাইটোকাইনসের (শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেহ নির্গত এক রাসায়নিক) মারাত্মক রকমের ক্ষরণকে উদ্দীপিত করে যাকে বলা হয় ‘cytokine storm’ ; যা শরীরের জন্য প্রবল ক্ষতিকর, এমনকি এর থেকে মৃত্যু অবধি ঘটে যেতে পারে।
ভ্যাক্সিন প্রয়োগের ফলে দেহে Neutralizing অ্যান্টিবডির চেয়ে Non-Neutralizing অ্যান্টিবডি বেশি তৈরি হলেই এ সমস্যার সূচনা হয়। উপরের ছবিতে Neutralizing (A) এবং Non-Neutralizing অ্যান্টিবডি (B)-র মেকানিজম টি এঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম।
এছাড়াও আরও কিছু বিষয় যেমন, ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতার স্থায়িত্ব, বয়স্ক, কোমর্বিডিটিতে আক্রান্ত এবং শিশুদের মধ্যে ভ্যাক্সিনটির প্রভাব এগুলোও দেখতে হবে।
সুতরাং, এ মুহূর্তে এটাই বলা যেতে পারে যে, ভ্যাক্সিনটির প্রাথমিক ফলাফল যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। পরবর্তী পর্যায়েও সাফল্য বজায় থাকলে হয়তো আমরা এ বছরের শেষের মধ্যেই ভ্যাক্সিন পেয়ে যেতে চলেছি।
প্রসঙ্গত, অক্সফোর্ড COVID-19 ভ্যাক্সিনটির দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা এখনও চলছে এবং তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার জন্য ইতিমধ্যে UK তে ১০ হাজার, USA তে ৩০ হাজার ও ব্রাজিলে ২ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ভারতে সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া অক্সফোর্ডের এই ভ্যাক্সিনটির উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্বে। প্রতিষ্ঠানের সি ই ও জানিয়েছেন, অগাস্ট থেকে ভারতেও শুরু হবে ভ্যাক্সিনটির হিউম্যান ট্রায়াল।