দ্বিতীয় ঢেউয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই থার্ড ওয়েভের অশুভ হাতছানি। বাবা মায়েরা ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন কারণ এই থার্ড ওয়েভে নাকি বাচ্চারা বিশেষ ভাবে আক্রান্ত হবে। কারণটা হয়ত বাচ্চাদের জন্য Covid-এর ভ্যাকসিন এখনও বেরোয় নি। তাই হয়ত মনে হচ্ছে যে বাচ্চারা পরবর্তী কোনো ঢেউয়ে বেশি সংকটে পড়বে। কিন্তু বাস্তবটা কি?
দিল্লির AIIMS হাসপাতাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে যৌথভাবে একটি seroprevalence সার্ভে করেছেন এই প্রশ্নের উত্তর জানতে। এই সার্ভেতে দেশের চারটি রাজ্যের মোট ১০০০০ মানুষের rapid অ্যান্টিজেন টেস্ট করে দেখা হয় কতজনের রক্তে covid অ্যান্টিবডি পাওয়া যাচ্ছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে যাদের রক্তে সেই অ্যান্টিবডি পাওয়া গেলো তারা অন্তত সেই মুহূর্তে শরীরে Covid প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী। প্রাথমিকভাবে প্রথম ৪০০০ জনের sample নিয়ে যে রেজাল্ট প্রকাশিত হলো তা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
দেখা গেলো যে এই অ্যান্টিবডি বাচ্চাদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় একই শতাংশে উপস্থিত। ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের স্বাভাবিকভাবেই কারণ বাচ্চারা তো আর ভ্যাকসিন পায় নি। তার মানে ইতিমধ্যেই বাচ্চারা asymptomatic Covid-এ শুধু আক্রান্তই হয়েছে শুধু তাই নয়, রীতিমত অ্যান্টিবডিও প্রস্তুত করে ফেলেছে শরীরে।
সবচেয়ে মজার কথা দক্ষিণ দিল্লির একটি বস্তি এলাকায়, যেখানে ঠাসাঠাসি ভীড়, সেখানে বাচ্চাদের প্রায় ৭৫%-এরই রক্তে Covid অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। সার্ভে দলের প্রধান AIIMS-এর অধ্যাপক তো বলেই ফেলেছেন যে এই অঞ্চলে রীতিমত স্কুল খুলে দেওয়া যেতে পারে। সংক্ষেপে এই সার্ভে এমন কিছু পায়নি যাতে বলা যেতে পারে যে পরবর্তী কোনো ঢেউ এলে বাচ্চারা বেশি বিপদের মধ্যে পড়বে। সোজা কথায় বিপদ যদি আসে, সেটা সব বয়সের সমান ভাবে।
বিপদ সত্যি কতটা? বিশেষজ্ঞদের মতে এই প্রশ্নের উত্তর মূলত নির্ভর করছে ভাইরাস আবার কোনো নতুন মিউটেশন নিয়ে আসে কিনা যা আরো বেশি আক্রমণাত্মক বা আরো বেশি ছোঁয়াচে যা বর্তমান ইমিউনিটি দ্বারা প্রতিরোধ যোগ্য নয়। এর মধ্যেই কিন্তু আমরা দেখেছি Covid প্রথম ঢেউয়ে যে ভাইরাস প্রজাতি আক্রমণ করেছিল, দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই প্রজাতির বদলে মিউটেশন হওয়া সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে। এই নতুন প্রজাতি আরো অনেক বেশি ছোঁয়াচে, যদিও হয়ত মারণ ক্ষমতায় একই রকম ছিল। তাই দ্বিতীয় ঢেউয়ে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই যখন অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হবেন, তখন অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের অক্সিজেনের চাহিদা বেশি হবে বা অনেক বেশি মানুষের জীবনহানির আশঙ্কা ঘটবে। কিন্তু সার্বিক ভাবে দ্বিতীয় ঢেউয়ের নতুন প্রজাতি আরো বেশি প্রাণঘাতী, এমন প্রমাণ কিন্তু পাওয়া যায় নি।
স্বাভাবিক ভাবেই বিজ্ঞানের পক্ষে ভবিষ্যতবাণী করা অসম্ভব যে ভাইরাস আবার কোনো মিউটেশন ঘটাবে কিনা। তবে সেটা যদি না হয়, অর্থাৎ আগামি কয়েক মাসের মধ্যে যদি খুব মারাত্মক মিউটেশন না ঘটে তবে হয়ত আস্তে আস্তে এই মহামারী শেষ হয়ে আসবে। আবার কোনো ঢেউ দেখা গেলেও তা হবে ক্ষণস্থায়ী। এই প্রসঙ্গে হংকং-এর উদাহরণ খুব তাৎপর্যপূর্ণ। দেখা গেছে হংকং-এ প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ঢেউয়ে বাচ্চাদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে asymptomatic হবার প্রবণতা লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে। যদিও হংকং-এ যা হয়েছে তা ভারতবর্ষেও হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাও আশা করতে দোষ কোথায়?
মোটের উপর যা প্রমাণাদি এযাবৎ পাওয়া গিয়েছে তাতে তৃতীয় ঢেউ আসলেও বাচ্চাদের তাতে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই বলে মুক্তকচ্ছ হয়ে সব বিধিনিষেধ ছুঁড়ে ফেলার সময় মোটেই আসেনি বলাই বাহুল্য। তবে সময় নিশ্চয়ই এসেছে বাচ্চাদের স্কুল খোলা বা না খোলা নিয়ে একটা বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নেবার। হংকং-এ কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে বাচ্চাদের মধ্যে ৯০% ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়িয়েছে পরিবারের অন্য বড়দের থেকে যাদের জন্য বিধিনিষেধ অনেকটাই হয়ত শিথিল ছিল কখনো সখনো। বরং রীতিমত ৫০০০০ ছাত্রছাত্রী নিয়ে হংকং স্কুল বোর্ডের পরীক্ষাতে সেরকম কোনো সংক্রমণ ছড়ায়ই নি। অবশ্য কঠোর সুরক্ষাবিধি যেমন সার্বিক মাস্ক পরা, যথেষ্ট সামাজিক দূরত্ব, শরীরের উষ্ণতা মাপা অত্যন্ত নিয়মিত ছিল।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন এক আমেরিকান গবেষক প্রখ্যাত JAMA গবেষণা জার্নালের একটি প্রবন্ধে – স্কুল বন্ধ করে সংক্রমণ বন্ধ করার চেষ্টার সুফল আদতে এতটাই কম, যে শিশুদের ভবিষ্যত ক্ষতির তুলনায় তা পরতায় পোষায় না। কারণ সুরক্ষাবিধি মেনে চললে স্কুল থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় নগণ্য। বিশ্বজোড়া সব গবেষকের একই কথা – lockdown বা কঠোর বিধিনিষেধ থাকলে তা থাকুক বড়দের জন্যে। ছোটদের ভবিষ্যতের বিনিময়ে বড়দের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা শুধু ভুলে ভরা নয়, আখেরে চরম ক্ষতিকরও বটে।