দেশজুড়ে প্রায় সবাই ঘরবন্দী হয়ে রয়েছি আজ বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। আর কতদিন থাকতে হবে সেটা কিছুটা অনিশ্চিত। এই অবস্থায় একটা অদ্ভুত ভয় আর আতঙ্ক গ্রাস করেছে গোটা সমাজকে। ভাল খেয়ে-পরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা শহর/আধাশহরের মানুষ থেকে শুরু করে চরমতম দুর্দশায় পড়া প্রান্তিক মানুষ, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকরা – কেউই কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে হবে। রাজা-প্রজানির্বিশেষে সবাই কুঁকড়ে যাচ্ছে একটা অজানা অদেখা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র “মৃত্যুদূত”-এর সামনে দাঁড়িয়ে, যার নাম কোভিদ-১৯। এ এক বিশ্বজনীন অসুখ এখন -যার উৎস নতুন ভাইরাস, যার সম্পর্কে সবকিছু ভালভাবে জানা নেই। ।
কিন্তু আশার কথা হল, এ নিয়ে সারা পৃথিবীব্যাপী এক অভূতপূর্ব গতি ও রীতিতে বৈজ্ঞানিক তথ্যের আদান প্রদান এবং আলোচনা-বিশ্লেষণ চলছে গত তিন মাস ধরে। প্রতিনিয়ত নতুন তথ্য উঠে আসছে যা সাধারণ মানুষের জানা এবং বোঝা জরুরী, বাঁচার তাগিদেই।
গৃহবন্দী পরিবারগুলোর এই মুহূর্তে জানা দরকার যে ঘরে থেকে তাঁরা ঘন ঘন সাবান জল দিয়ে হাত ধুয়ে পরিষ্কার করা ছাড়া আর কী করবেন। কারণ এটুকু করলেই আমরা মহামারীর প্রকোপকে একটা সীমার মধ্যে ধরে রাখতে পারব, এমন নয়। পরিস্থিতি সবার হাতের বাইরে চলে যাবে এবং একটা অবর্ণনীয় দুর্দশায় দেশটা পড়ে যাবে যেটা ইউরোপের কিছু কিছু দেশে হয়েছে। আমরা এই অবস্থায় চলে যাওয়া আটকানোর জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেও মানসিক স্তরে সমবেত হতেই পারি, নিজেদের এবং অন্যদেরও প্রাণ যথাসম্ভব বাঁচানর জন্য।
রোগটা প্রবল ছোঁয়াচে এবং অসুস্থ মানুষের থুতু কাশি কফ থেকে ছড়ায় সেটা সবারই প্রায় জানা আছে। যাঁদের এই অসুখ হয় তাঁদের একটা বড় অংশ (প্রায় ৮০%) খুব সামান্য উপসর্গে ভোগেন, মরসুমী সর্দি-কাশির মতই। অনেকে বুঝতেও পারেন না যে তাঁদের এই অসুখ হয়েছে। বোঝার আগেই সেরেও ওঠেন কয়েক দিনের মধ্যেই। কিন্তু মুস্কিল এখানেই যে না জেনেই তাঁরা আশপাশের লোকেদের সংক্রামিত করেন, তাঁরা আবার তাঁদেরও সংস্পর্শে আসা লোকেদের সংক্রামিত করে ফেলেন। এই ভাবে নিঃসাড়ে দুরন্ত গতিতে রোগের প্রকোপ ছড়ায় সমাজে। তাতেও তেমন কোনো ক্ষতি ছিল না যদি না এই রোগ বিশেষ কিছু মানুষের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী আকার ধারণ করতো। যাঁরা ষাটোর্ধ বয়স্ক মানুষজন, যাঁদের ফুসফুস ও হৃৎপিন্ডের অসুখ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্ত চাপ ছাড়াও আরও কিছু কিছু বিশেষ অসুখ রয়েছে তাঁদের সেজন্য বিশেষভাবে সাবধানে চলতে হবে। পরিবারের অন্যরা তাঁদের থেকে অন্তত দু’মিটার দূরত্ব বজায় রাখবেন, তাঁদের ব্যবহার করা বাসন-পত্র, পোষাক, তোয়ালে, ইত্যাদি আলাদা রাখবেন। বেশির ভাগ বাড়িতেই এই সবগুলো করা যাবে না হয়তো। কিন্তু যতটুকু সম্ভব করতে হবে– আমাদের আপাতত লক্ষ্যতো হাসপাতালে ভর্তি হবার মতো গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা কমানো।
ছোট ছোট ঘরে বন্দী হয়ে অলসভাবে দীর্ঘ দিন বসে থাকা আর অজানা ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগে ভুগতে থাকা একটা বিরাট জনগোষ্ঠীকে চূড়ান্ত মানসিক সমস্যার মুখে ঠেলে দিতে চলেছে। খুব শীঘ্র এর প্রতিকার না করতে পারলে একটা মানসিক রোগের মহামারী আমাদের গ্রাস করবে। অথচ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূল অস্ত্র হল আমাদের শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা যা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষভাবে নির্ভর করে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য অটুট রাখা অত্যন্ত জরুরি।
পড়াশোনা,নানা রকম সৃষ্টিশীল কাজ – লেখা, নাচ, গান,আঁকা থেকে শুরু করে রান্না করা অবধি, এই সবের মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারলে সেটা সম্ভব। এছাড়াও খুব জরুরি (মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও) নিয়মিত কিছু হালকা ব্যায়াম করা। বিশেষত যাঁরা ঘরের কাজকর্ম করছেন না। টিভি চ্যানেলে যদি এই ধরনের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয় এবং সবাই বাড়িতে থেকে অনুসরণ করতে পারেন তাহলে খুব ভাল হয়। এই সব করতে হবে স্রেফ সময় কাটানোর জন্য নয়. প্রতিরোধী চিকিৎসার অঙ্গ হিসেবেই। মনের জোরে শরীরের রোগকে জয় করার উদ্দেশ্যে।
ঘরে বসে থাকলেও যে কারুর এই অসুখ হবে না এমন নয়। ভাইরাস ইতিমধ্যেই অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে। এবং না জেনেই অনেকে সেটা বহন করে এনেছেন। তাতে ভয়ের কিছু নেই, বেশির ভাগই সহজে সুস্থ হয়ে উঠবেন মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকলেই।
আরেকটা অত্যন্ত জরুরি বিষয় হল ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস ঢুকতে দেওয়া। বদ্ধ ঘরে অনেক লোক জন, তাদের মধ্যে উপসর্গহীন অসুস্থ্ মানুষও থাকতে পারেন, এই পরিস্থিতিতে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের সংক্রামিত হবার সম্ভাবনা। তাই ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী রইলেও জানালা খুলে মুক্ত বাতাস বইতে দিন, দিনে বেশ কয়েক বার, নিয়ম করে। ছাদে উঠে, বারান্দায় বা বাড়ির দরজার সামনে একে একে বেরিয়ে একটু রোদ লাগিয়ে নিন সবাই। তাতে বিনা খরচে ভিটামিন-ডি তৈরি হবে ত্বকে, যা রোগ প্রতিরোধের জন্য খুবই জরুরি। আমাদের দেশের লোকের মধ্যে ভিটামিন-ডি’র অভাব খুবই বেশি দেখা যায় পর্যাপ্ত রোদ পেলেও (আবহ দূষণের কারণে, এই সর্বব্যাপী বন্ধের জন্য যেটা কমে গেছে ইতিমধ্যেই)।
এবার হাত ধোবার বিষয়টা একটু ভাল ভাবে খতিয়ে দেখা যাক। ভাইরাসকে অকেজো করতে গেলে অন্তত কুড়ি সেকেন্ড সাবান জলে হাত ঘষে ফেণা তৈরি করে তারপর হাত ধুতে হবে। এভাবে না করলে ঘন ঘন হাত ধোয়াই সার হবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না। ধৈর্য বজায় রেখে মন দিয়ে হাত ধোয়ার কাজটা করতে হবে। পরিষ্কার জলের অঢেল যোগান তো পাবেন না আমাদের দেশে বেশীরভাগ মানুষই। তাঁদের জন্য বার বার হাত ধোয়ার থেকেও জরুরি এটা বোঝা, যে হাতে থাকা ভাইরাস চোখ নাক মুখ দিয়ে যেন শরীরে না ঢুকতে পারে। সেজন্য সেইসব জায়গায় হাত না দেওয়ার অভ্যাস তৈরি করা দরকার। যখন হাত দিয়ে খাবেন বা নাক-মুখ জল দিয়ে ধোবেন তার আগে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিলেই হবে। ঘন ঘন হাত ধুতে হবে বাচ্চাদের বা যাঁদের চোখে নাকে মুখে অসতর্ক ভাবে হাত দেওয়ার অভ্যাস আছে তাঁদের। মোট কথা মনে রাখতে হবে যে হাতে ভাইরাস থাকতে পারে।
আ্যলকোহল-ভিত্তিক স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে সেটা যেন অবশ্যই সত্তর পার্সেন্টের বেশি হয় এবং হাতে ভাল ভাবে ঘষে নেওয়া হয় যাতে ভাইরাসকে অকেজো করে দেওয়া যায়।
হাতের পরে যা আসে তা হল মুঠো-ফোন যা থেকেভাইরাস/জীবাণু ছড়াতে পারে। এটা বাচ্চাদের অতি প্রিয় খেলনার বস্তু আজকাল। মুঠো-ফোন একেবারেই দেওয়া চলবে না তাদের হাতে,যতই আবদার করুক। নিজেদের জন্য স্পিকার ফোন ব্যবহার করলে ভাল, তাতে মুখের সংস্পর্শে আসবে না ফোন।
অনেকেই টাকা পয়সা থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয়ে এগুলি ধুতে শুরু করেছেন। টাকা না ধুয়ে বরং টাকা ধরবার পর হাত ধুয়ে ফেলুন। বেরোবার সময় অনেকেই একবার-ব্যবহারযোগ্য মুখোশ ব্যবহার করছেন পথে ঘাটে অসতর্ক কারোর হাঁচিকাশি থেকে বাঁচার জন্য।এই গরমে মোটা সূতি কাপড়ের দু-তিন স্তর যুক্ত মুখোশ (বাড়িতেই তৈরি করে নিতে পারেন যে কেউই) ব্যবহার করলেই চলবে। সেটা একবার ব্যবহার করে সাবান জলে ভাল করে কেচে রোদে শুকিয়ে নিলেই হবে। ব্যবহার করা মুখোশের সামনের দিকটায় ভাইরাস লেগে থাকবে, এটা মনে রেখে সামনে হাত দেবেন না। এই ভাবে চললে আমরা অপ্রয়োজনে মুখোশ নষ্ট না করে ডাক্তার ও নার্সদের জন্য সেগুলো বাঁচিয়ে রাখতে পারব যাঁরা অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে অনেক কাছে থেকে রোগীদের চিকিৎসা করছেন। ইতিমধ্যেই সারা পৃথিবীতে চিকিৎসার জন্য জরুরি এই সব জিনিষগুলোর আকাল চলছে, আমেরিকার মত দেশেও। যাঁরা আমাদের বাঁচাবেন তাঁদের স্বাস্থ্য ও প্রাণ বাঁচানোটা আমাদের জন্যই জরুরি।
শেষ কথা: যে সব হাসপাতালে কেবল কোভিদ-১৯ রোগীদের চিকিৎসা হবে সেখানে অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে যথাযথ দূরত্ব বজায় রেখে চিকিৎসা করতে হবে। ১৯১৮’র স্প্যানিশ ফ্লু’র অতিমারীর সময় দ্বিতীয়বার যে তীব্রতর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল, অনেক বিজ্ঞানী এখন মনে করেন সেটা হাসপাতালে ও যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ভীড়ের কারণে। এই স্প্যানিশ ফ্লু’র অতিমারীর ইতিহাস আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। রোগের মহামারীর তীব্রতা কমাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপকারিতা থেকে শুরু করে এই প্রত্যয় যে – মহামারি-জনিত অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে মানব সভ্যতা অতীতেও পড়েছে, তারপর প্রলয়কাল কাটিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে আবার হাতে হাত ধরে থেকে, মনে মনে।
Well presentation of precautions for Convid-19.
ওপরের সব পরামর্শের সাথে আরেকটি কথা যোগ করলে ভাল হয়। ঘুমের ঘোরে চোখে মুখে হাত চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই রাতে শুতে যাবার আগেও সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে নেওয়া দরকার।