কয়েকদিন ধরে অবিনাশ বিপদের মধ্যে আছে। একমাত্র পরম ভালোবাসার বউয়ের দেওয়া কোনও কাজকেই বিপদ ভাবা ঠিক না। বলা যেতে পারে… সমস্যা। ছোটো সমস্যা না। বড় ধরণের সমস্যা।
তার বউয়ের গুরুদেব আসবেন দিন দুয়েক বাদে।
অবিনাশ এমনিতে নাস্তিক ধরণের মানুষ। ফুল নাস্তিক না হলেও হাফ নাস্তিক তো বটেই। ভগবান, গুরুদেব কবচ মাদুলি আধিদৈবিক আধিভৌতিক … সবেরই মানামানি ওই আধাআধি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা দুর্গা পুজোর চাঁদা চাইতে এলে অল্প আপত্তি সহকারে চাঁদা দিয়ে দেয়, কেন না সেই ক্লাব বাবুদের মেজাজ খুব গরম। আর অমুক দাদা, তমুক দিদি, থানাপুলিশ এই সবের সঙ্গে যোগাযোগও খুব। কাজেই তাদের বেলা একরকম।
কিন্তু সেই অবিনাশই আবার চৈত্র মাসে গাজন সন্ন্যাসী কিম্বা সিঙ্গল রিড হারমোনিয়াম বা খোল করতাল বাজিয়ে কীর্তন গাওয়া পাব্লিকদের দরজা থেকেই বিদায় করে।
অবিনাশ এই ব্যাপারটায় যে একা তা নয়। এই রকমের বহু আছে। পাড়ায়… অফিসে…
ইউনিয়নের দুঁদে অতি বাম নেতা রাজশেখর তার আদর্শ। রাজের গালের ভেতর দিকের একটা সাদা ফুস্কুড়ি গত বছর জ্বালাতন করছিল খুবই। বায়োপসি করাতে হল। তখন দিন কতক খুব ‘হে ঠাকুর বাঁচাও’ মোডে থাকল। খুব বিপদে পড়লে কষে ভগবান-টগবানের নাম করতেই হয়।
রিপোর্ট যেই নেগেটিভ, অমনি রাজশেখর ক্যান্টিনে আর ইউনিয়ন অফিসে বসে বসে অঙ্ক করে ফের প্রমাণ করে দিল ঈশ্বর ইকোয়াল টু রুট ওভার মাইনাস ওয়ান।
অবিনাশের নিজের গুরুদেবটেব নেই, ওই হাফ নাস্তিকতার কারণেই। কিন্তু বউয়ের গুরুদেবটি তার নিজের গুরুদেব না হলেও শ্বশুরবাড়ির সূত্রে অর্জিত। আর সেই কারণেই তেমন ফেলনা নয়।
এর আগে কখনও এদিকপানে আসেননি। এবার যে আসতে রাজি হয়েছেন অবিনাশদের বাড়িতে এ নিশ্চয়ই পূর্বজন্মের অনেক সুকৃতির ফল। ওর বউ মালতী তো এই সৌভাগ্যে রীতিমত উত্তেজিত।
অবিনাশের শাশুড়ি মা ফোনে মেয়েকে বলে দিয়েছেন এই কদিনের কী কী আচার বিচার। সমস্ত নির্দেশও বলেছেন মেয়েকে। টেলিফোনেই ফিসফিসিয়ে বলেছেন, তোদের তো আবার মানামানি কিছুই নেই। শরীর মনের শুচিতা সংযম… জামাইকে বুঝিয়ে বলবি। মোটে তো দু তিনটে দিন। সামলে চলবি। এদিক সেদিক করবি না একটুও। বুঝলি তো, কী বলছি?
শ্রী গুরুদেব কঠোর নিরামিষভোজী। আমিষের ছোঁয়াটুকু আছে এমন কিছুই তিনি গ্রহণ করেন না। গ্রহণ তো দূরের কথা স্পর্শ অবধি করেন না।
সেই গুরুদেবের ভোজনের জন্য কাজেই বিশেষ ব্যবস্থা। নতুন কেনা ব্যাগে সযত্নে নিরামিষ আর সাত্ত্বিক সমস্ত আনাজ পত্র আনা হচ্ছে.. আনা হবেও। অবিনাশের বউ মালতী রাঁধবে।
বাড়ির সবাই এই কদিন শ্রী গুরুদেবের প্রসাদ মানে তিনি যা খাবেন তাইই খাবে।
নিরামিষ মানে স্রেফ কচু ঘেঁচু নয়। রীতিমত দুধ, ছানা,পনির, গাওয়া ঘি সমৃদ্ধ। আর তার সবই নাকি হতে হবে ব্র্যান্ডেড।
অবিনাশ খুব চেষ্টা করেছে এই আমিষ নিরামিষের ধোঁয়াটে ব্যাপারটা মালতীকে বোঝাতে।
গোরুর দুধ কিম্বা যে কোনও দুধই আসলে প্রাণীটির এক রকমের এক্সোক্রিন গ্ল্যান্ড মানে অ্যাপোক্রিন গ্ল্যান্ড থেকে বের হয়। আর অ্যাপোক্রিন গ্ল্যান্ডে যে গোরুর ফ্যাট সেলই ভেঙে দুধ হয় এই তথ্য মাথায় রাখলে দুধ ঘি কিছুই যে তত নিরামিষ নয়, বলতে গেলে বিচ্ছিরি রকমেরই আমিষ, এইটি প্রমাণিত সত্যি।
এই সব তথ্য জুলজির ছাত্রী মালতী যে জানে না তা তো নয়। কিন্তু সে কিছুতেই বিজ্ঞান মানে না। আর ভাগ্যের দুর্বিপাকে ওই সব ছদ্মবেশী মহার্ঘ নিরামিষই বেশি বেশি করে কিনে ব্যাগ বোঝাই করতে হচ্ছে অবিনাশকে। গুরুদেবের নাকি তরি তরকারির চেয়ে ঢের বেশি পছন্দের ওই দুধ দই মাখন।
আমিস নিরামিষের দ্বন্দে ছোটোখাটো খটাখটি লাগছিলই। যেমন পোলট্রি ডিমের ব্যাপারটা। অবিনাশ বিজ্ঞানটা বোঝাচ্ছিল মালতীকে। বুঝলে তো, এগুলো আনফারটিলাইজড এগ। প্রাণের আভাস মাত্র নেই ওর মধ্যে। তোমার ধরো গে দুধও যেমন নিরামিষ… পোলট্রি ডিমও তাইই একরকম।
তা জুলজিতে এমএ পাশ মালতী এসব বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা মানলে তো!
এর মধ্যে আবার ঝামেলা পাকাচ্ছিল কন্যা তিতলি। মাকে আর বাবাকে একই প্রশ্ন করে জেরবার করছিল। – তোমরা গোরুদেব কে গোরুদেব বলছ কেন। হরিসাধন জেঠু যে বলে গেল গোরু হচ্ছে ভগবতী। তাইলে তো গোরুদেবী হবে।
সম্ভবত মা বাবার গোরু নিয়ে আলোচনায় তিতলি বেচারি বিভ্রান্ত হয়ে এখনও আবির্ভূত না হওয়া আরাধ্যটিকে গোরু ভেবে বসেছে।
সবচেয়ে মারাত্মক বোমাটা ফাটল শ্রী গুরুদেব আসার জাস্ট আগেরদিন সকালবেলা। শাশুড়ি মা ফোনে তাঁর কন্যাকে নির্দেশ পাঠিয়েছেন, রান্না করতে হবে, না গ্যাসে নয়, কেরোসিন স্টোভে বা হিটারেও নয়। রান্না করতে হবে বিশুদ্ধ নিরামিষ জ্বালানিতে। গুরুদেবের নির্দেশ।
শুনেই অবিনাশের আক্কেল গুড়ুম।
শ্রী গুরুদেবের মতে একমাত্র কয়লাই নাকি নিরামিষ। বিশুদ্ধ গাছগাছড়া থেকে উৎপন্ন।
কিন্তু খনিজতেল এলপিজি কিছুই নাকি সন্দেহের ঊর্দ্ধে নয়। এমনকি ইলেকট্রিক অবধি নিষেধ। আমাদের অবিনাশ শুনে অবধি বোমকে গেছে। সমস্যা থেকে উদ্ধার পেতে বউকে উইকিপিডিয়া খুলে দেখিয়েছে, এই দ্যাখো, স্পষ্ট লেখা আছে খনিজ তেল মানে ক্রুড পেট্রোলিয়াম অরিজিনেটস ফ্রম…
রাখো তোমার গুগল আর ইন্টারনেট। গুরুদেব মাকে বলেছেন, সমস্ত ভুলভাল লেখা থাকে ওতে। গুরুদেব ধ্যানযোগে জেনেছেন যতসব প্রাচীন প্রাণী… ডায়নোসর তিমি ম্যামথ এই সব মাটি চাপা পড়ে চাপে তাপে তেল হয়েছে। গুগলে যা আছে সব মিছে কথা। মায়ের ডাক্তারও মাকে বলেছে, অসুখের ব্যাপারে গুগলের ভুলভাল কিছু বিশ্বাস না করতে।
ডাক্তার কি ভুল কথা বলবে, বলো? আমার ওই কয়লাই চাই, গুরুদেবের রান্নার জন্য। নইলে বেল কাঠ।
অবিনাশের স্পষ্ট মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা। কয়লা কেনা হত মন দরে। বাড়িতে কাজের লোক রাখবার সময় প্রথমেই কাজের আইটেম মানে শর্ত, যা যা বলা হত তার মধ্যে কয়লাও থাকত। অর্থাৎ ঘর পোছা, বাসন মাজা, কাপড়কাচা ইত্যাদির সঙ্গে অবশ্যকর্ম হিসেবে বলা হত কয়লা ভাঙতে হবে। আর গুঁড়ো কয়লা জমে গেলে গুল দিতে হবে। সেই কয়লাভাঙা হাতুড়ি আর ভাঙা কয়লা রাখা হত সিঁড়ি ঘরের নীচে। তোলা উনুনে রাঁধত মা।
এই ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে হেল্পারি করে অবিনাশেরও কেমন একটা এক্সপার্টাইজ এসে গেছিল। তোলা উনুনে লোহার শিকের ওপরে ঘুঁটের একটা লেয়ার। ঘুঁটে ভেঙে ভেঙে সাজাতে হত। তার ওপরে সেই আধাচূর্ণ করা কয়লা। একটু নৈবেদ্যের মত উঁচু করে। এইবারে শিকের তলার কম্পার্টমান্টে আগুন। অধিকাংশ সময়েই একটু কেরোসিনে ভেজানো ভাঙা ঘুঁটে দেশলাই মেরে জ্বালিয়ে ধূমায়মান চুলাটিকে বাইরে রেখে আসা হত। মিনিট দশ পনেরো পরে ধোঁয়া কমে আসত। কৃষ্ণবরণ কয়লার নীচে অরুণবরণ আঁচ। লোহার বালতি কেটে বানানো তোলা উনুনটিকে হ্যান্ডেল ধরে রান্নাঘরে নিয়ে আসা হত।
ঠিক কবে থেকে মনে নেই, কয়লার বদলে কেনা হতে লাগল রেডিমেড গুল। বস্তা করে। পাড়ায় একটা গুল ফ্যাক্টরি ছিল। কবেই উঠে গেছে সেটা, সেখানে আলিশান ফ্ল্যাটও উঠেছে একটা। তবু লোকে জায়গাটাকে এখনও বলে গুল ফ্যাক্টরি। জ্বালানীর এই গুলবাজি অবিশ্যি বেশিদিন চলেনি। মাত্রই কয়েকবছর। তারপরে মধ্যবিত্ত ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ল এলপিজি গ্যাস।
মহা আতান্তরে পড়া অবিনাশ মনেই করতে পারল না তার এই মফস্বল শহরে কয়লা ঠিক কোথায় পাওয়া যেতে পারে।
সেই কবে বাবার কাছে শুনেছিল, বাবা তখন সালারে পোস্টিং। সালার প্যাসেঞ্জার বলে একখানা ট্রেন ছিল। স্টিম ইঞ্জিনের যুগ তখন। কাটোয়ায় কয়লা উঠত ইঞ্জিনে। সেই ট্রেনটা সালারে পৌঁছেই নাকি ঝপাঝপ কয়লা ফেলত। যাদের পয়সা দেওয়া থাকত তারা সেই কয়লা কুড়িয়ে সামান্য একটাকা দুটাকায় বিক্রি করত গেরস্থদের। সেই যুগ থাকলে স্টেশনের সাইডিংয়ে গিয়েই জোগাড় করে ফেলা যেত, দু তিনদিনের কয়লা যা লাগে।
আর ঘুঁটে? তাও কি কোথাও পাওয়া যেতে পারে?
সর্বঘটে কাঁঠালি কলা শ্রীমান জয়দীপ মিশ্র। ভাইয়ের মত প্রায়। অবাঙালি কিন্তু বাংলায় বহুদিন থেকে বাঙালিই হয়ে গেছে।
ওকে লোকাল এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যেতে পারে একরকমের। কয়লার খোঁজে তাকে ফোন লাগাল অবিনাশ।
হ্যাঁ দাদা, উয়ো কোয়লা পাওয়া যায় বই কি! বিধান মার্কেটে চিত্ত দাসের দুকানে। কিন্তু দাদা শুনলাম ও নাকি কদিন গোলা বন্ধ রেখে মন্দারমনি ঘুমতে গেছে। ব্যবসায়ী সমিতির হেড তো ওই চিত্তই। কোয়লা তো হোবে না এখুন।
কয়লা হবে না? তবে গুল। গুল কোথায় পাওয়া যায়?
আরে দাদা, সেও তো ওই বিধান মার্কেটেই। তারাও তো ঝাঁপ বন্ধ করে ওই মন্দারমনি।
তবে উপায় কী, জয়দীপ?
অবিনাশের মুখে বিপদের বিবরণ শুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপত্তারণ জয়দীপ।
উপায় একটা ঢুণ্ডতেই হোবে। ভাবিজির কেস যখুন। নীলগঞ্জ চলুন। বাইকে লিয়ে যাচ্ছি। উখানে ইট্ভাঁটায় কয়লা দিয়ে ইট পোড়ায়। চাইলে এক দু কিলো দেবেই। সে অবিশ্যি কাঁচা কয়লা। ধুমা উঠবে খুব। সে হোক। ভাবিজির কাম চোলিয়ে যাবে।
রোদে পুড়ে বাইকের পেছনে বসে সেখানে গিয়ে জানা গেল, সবে ভাঁটায় আগুন দেওয়া হয়েছে। পুড়তে পুড়তে বেশ কদিন। আবার নতুন করে কাঁচা ইট সাজিয়ে আগুন দিতে দেরি হবে দশ পনেরো দিন। কয়লা আসবে তখন।
অতদিন পরে পেলে কি চলবে? শুধোলো ইটভাঁটার অতি অমায়িক ম্যানেজার।
নেক্সট কী করণীয়? মহা উদ্যমী জয়দীপকে শুধোলো রোদে পুড়ে ঝামা হয়ে যাওয়া প্রৌঢ় অবিনাশ।
কুছ পরোয়া নেই দাদা। ভাবিজি বোলিয়েসে, কাঠ তো চলবে। কাঠের মত নিরামিষ আর কী আছে বাতান? টাউনে কাঠগোলা অনেক আছে। আপনি তো টায়ার্ড। কি, তাই তো?
তবে?
কোই ফিকর নেহি। ফিরবার রাস্তায় শ্মশান পড়বে। উখানে হামার চিনা ডোমের কাছ থেকে এক মন কাঠ লিয়ে লিব। বেল কাঠ। পবিত্তর মতলব উমদা চিজ। অর্ডিনারি অন্য গোলায় ই চিজ মিলবেক নাই।
তাই করা হল। বাইকে ফেরার পথে ওই শ্মশান থেকেই একমন বেল কাঠ কেনা হল। জয়দীপের বাইকের পেছনে মহা যত্নে বেঁধে দিল শ্মশানের ডোম।
বিজয় গর্বে উজ্জ্বল অবিনাশ বাসে করে ফিরছে।
গুরুদেবকে নিরামিষ আগুনে সৎকারের ব্যবস্থা করা গেছে, এই অনেক। চিতাটা, ইয়ে উনুনটা বাড়ির উঠোনে সাজিয়ে দেওয়া যাবে এখন। গুরুদেবের সৎকার বলে কথা।
আজ্ঞে না সেই সৎকার নয়, অতিথি সৎকারের সৎকার!
পেঁয়াজ আর পেঁয়াজকলি উভয়ই কি আমিষ?