আমার হিন্দি একেবারেই সুবিধাজনক নয়।
দার্জিলিঙে মীমের হোম স্টে থেকে সিতং এর হোম স্টে তে যাচ্ছিলাম। সিতং থেকে ফোন করে জানতে চাইল দুপুরের খাবার আমরা ওখানে খাব কিনা। আমি আমার নিজস্ব হিন্দিতে উত্তর দিলাম, আমাদের পৌঁছাতে একটু দেরী হবে। এদিক ওদিক ঘুরে যাব। রাস্তায় টুকটাক খেয়ে নেব। তবে ওখানে পৌঁছে ভাত খাব।
বেলা চারটায় হা-ক্লান্ত হয়ে হোম স্টে-তে পৌঁছে দেখি আমাদের রান্না হয়নি। কেয়ারটেকার রোমান জানাল, আপনিই তো বললেন, রাস্তায় খেয়ে নেবেন।
নেহাত ছেলেটি ভালো। তাই সেই অবেলায় সে আবার ভাত বসাল। আমাদের খাওয়া জুটল।
আমাদের গাড়ি চালক হিন্দিতে বলেছিলেন, বাঙলা আমি ভালো বুঝি না। তবু আপনি বাংলাতেই কথা বলেন। আপনার হিন্দি আমি একেবারেই বুঝি না।
অথচ সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে তৃতীয় ভাষা হিসাবে আমার হিন্দি ছিল। এবং অদ্ভুত ভাবে ওই দুই বছরের অর্ধ-বার্ষিক এবং বার্ষিক মিলিয়ে চারটি পরীক্ষার প্রত্যেকবারই আমি হিন্দিতে ৬৭ পেয়েছি। অর্থাৎ এই দুই বছরে আমার হিন্দি জ্ঞানের উন্নতি- অবনতি কোনটাই ঘটেনি।
আমার এই অবস্থার প্রধান কারণ আমার বাবা ও মা। দুজনেই হিন্দি সিনেমা দেখা, হিন্দি গান শোনা ইত্যাদিকে অত্যন্ত খারাপ চোখে দেখতেন। তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল হিন্দি সিনেমা, হিন্দি গান- বখে যাওয়া ছেলে মেয়েরা দেখে। আমাদের ছোটো বেলায় দূরদর্শনে শনিবার সন্ধ্যায় হিন্দি ও রবিবার বাঙলা সিনেমা হতো। শনিবার সন্ধ্যেয় টিভি খোলা নিষিদ্ধ ছিল। রবিবার বাঙলা সিনেমা দেখার অধিকার ছিল। তবে বাড়িতে যে ছোটো সাদাকালো টিভিটা ছিল, সেটির ছবি স্থির থাকতো না। শুধু উপর নীচে ঘুরে যেত। টিভির উপরে থাবড়া মারলে সেই ঘোরা বন্ধ হত। তখন আবার ছবিটা পাশা পাশি ব্রেক ড্যান্স করত। বাধ্য হয়ে পাশে থাবড়া মারতে হত। এতো থাবড়া খাওয়ার পর টিভির ছবি এতটাই ঝির ঝির করত উত্তম কুমার, তরুণ কুমার, ছবি বিশ্বাস সকলকে একই রকম মনে হতো।
যাই হোক টিভির গল্প ছেড়ে আবার ভাষার গল্পে ফিরে আসি। ভালো হিন্দি না জানার জন্য আমার বিন্দুমাত্র হীনমন্যতা ছিল না। কারণ আমার ধারণা ছিল বাঙলা ভাষা আমি মোটামুটি ভালোই জানি। আর আমার অধিকাংশ রোগীই বাঙালী। দু-চারজন হিন্দিভাষী রোগী এলেও তাঁরা আমার ভাষাজ্ঞান সম্বন্ধে জেনেই আসেন ও সঙ্গে একজন দোভাষী নিয়ে আসেন।
সেই বাঙালী রোগী নিয়েও যে সমস্যায় পড়ব ভাবিনি।
দার্জিলিং থেকে ফিরে বাড়িতে প্রথম চেম্বার শুরু করেছি। পাঁচদিন খুপরি বন্ধ ছিল। ফলে কাতারে কাতারে রোগী চলে এসেছেন। বাড়ির সামনের রাস্তা মোটামুটি অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। আমি ঠাণ্ডার দেশ থেকে এসে ঘামতে ঘামতে রোগী দেখছি।
এক বুড়ি বেশ আয়েস করে সামনের চেয়ারে বসলেন। বসার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ইনি অনেকটা সময় লাগাবেন। থিতু হয়ে বসার আগেই এনাকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠাতে হবে। বললাম, বলুন ঠাকুমা, সমস্যা কী?
ঠাকুমা হেসে জানালেন, সমস্যা কি একটা রে বাবু? তবে এখন প্রধান সমস্যা হাত পায়ে টাস লেগে যায়।
-কী লেগে যায়? হাত পায়ে ব্যথা করে?
-না না। ব্যথার কথা কখন বললাম। শুধু টাস লেগে যায়।
-তাহলে কী হয়? ঝিন ঝিন করে? ঝিঁ ঝিঁ ধরে?
-না রে বাবা, ওসব কিচ্ছু হয়না। বললাম না- টাস লেগে যায়।
-হাতে পায়ে খিঁচ ধরে? অবশ হয়ে যায়? হাত পায়ের চামরা মোটা মোটা লাগে?
-ওসব কিছু নারে বাবু। বলছি তো শুধু টাস লেগে যায়।
পরাণ আনজ্বালা করা, শরীর অ্যালব্যাল করা- এসব তবু বুঝি। টাস লাগাটা বুঝতে পারলাম না। একেবারে না বুঝেই চিকিৎসা দিলাম। দেখা যাক ঝড়ে বক মরে কিনা?
তাঁর পরের রোগী আবার খিটখিটে এক বুড়ো। ঢুকেই বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, একমাস ধরে কী ওষুধ খাওয়াচ্ছেন? আমার তো ক্রমশ অবনতি হচ্ছে?
বললাম, কীসের অবনতি হচ্ছে?
-আরে, টয়লেট তো একেবারেই চেপে রাখতে পারছি না। একটু বেগ এলেই কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যাচ্ছে।
মনে পড়ল ইনি মাস-খানেক আগে এসেছিলেন। বক্তব্য ছিল, টয়লেট চাপতে পারছেন না। বারে বারে পাচ্ছে, আর সাথে সাথে বাথরুমে দৌড়াতে হচ্ছে। একটু এদিক ওদিক হলেই কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যাচ্ছে।
এই বুড়ো বয়সে টয়লেট নিয়ন্ত্রণে না থাকার প্রধান কারণ প্রস্টেট বড়ো হওয়া। ওষুধ দিয়ে বলেছিলাম পারলে পেটের আলট্রাসোনোগ্রাফি করে রাখবেন। তাহলে সঠিক কারণটা বোঝা যাবে।
বুড়ো ভদ্রলোক বলেছিলেন, ওসব ফটো টটো তুলতে অনেক খরচ। ছেলের সংসারে থাকি। বউমা ভয়ানক দজ্জাল। ওষুধ দিয়ে একবার দেখেন।
পনেরো দিন বাদে এসেছিলেন। বললেন, অবস্থার তো কোনো উন্নতি হচ্ছে না। দিনে পনেরো- কুড়ি বার বাথরুমে ছুটতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক হবে। কিন্তু হচ্ছে একটু একটু। তাও অর্ধেকটা কাপড়েই লেগে যাচ্ছে। বউমা ওই সব কাচবে না। সারাদিন ধরে কাপড় ধুচ্ছি। এভাবে পারা যায়?
আমি বলেছিলাম, একটু ধৈর্য ধরুন। এসব ক্ষেত্রে ওষুধ কাজ করতে সময় লাগে। সব অসুখ তো ম্যাজিকের মতো সারানো যায় না।
পনেরো দিন বাদে এসেছেন, কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে মেজাজ বেশ গরম। আবার বললেন, একমাস ধরে ওষুধ খেলাম, একটুও উন্নতি হবে না? এ কেমন চিকিৎসা করছেন?
বললাম, আসলে এতো তাড়াতাড়ি… আরেকটু সময় দিন।
আরো সময় লাগবে? বুড়ো মানুষটি রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। বললেন, আগে তবু টয়লেট একটু শক্ত হতো। গত সাতদিন ধরে একেবারে পাতলা…
টয়লেট শক্ত, পাতলা? আমি হতবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, আপনার সমস্যা ঠিক কী বলুন তো?
-ওই যে টয়লেট কন্ট্রোল করতে পারি না?
মরিয়া হয়ে বললাম, দয়া করে শুদ্ধ বাঙলায় বলুন কোনটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না? পেচ্ছাপ না পায়খানা?
বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, ‘পেচ্ছাপ কেনো হবে! আমি টয়লেট… ইয়ে পায়খানার কথা বলছি।
সেই থেকে যতো রোগী এসে বলছেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমার বাথরুম পরিষ্কার হয়না’ বা ‘টয়লেট করতে জ্বালা করছে’- আমি বলছি, ‘বাংলায় বলুন- পেচ্ছাপ না পায়খানা? ওসব টয়লেট, পটি, বাথরুম আমি কিচ্ছু বুঝিনা।’
বাঙালীদের কথাবার্তাও দেখছি দিন দিন বেশ জটিল হয়ে উঠছে।
অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়লাম। ভালো লাগলো।