(এই পর্বে একটা চিঠি বিনায়কদার। কলকাতা থেকে আ্মাকে লেখা। বাকিগুলো আমার চঞ্চলাকে লেখা।)
১৫.১১.১৯৮১
কাল তোর পাঠানো money order টা পেলাম। কাল এখানকার সদ্য তৈরী cultural team-এর রাজহরায় প্রথম অনুষ্ঠান হল। রাত তিনটে পর্যন্ত দেখেছি। আজ আমি ছুটি নিয়েছি. আজ ইউনিয়ন অফিসে খেতে নাও পারি। সকাল দশটা বাজে। খুব ঘুম পাচ্ছে। আজ সারাদিন যা ইচ্ছে তাই করব। ইচ্ছে হলেই ঘুমিয়ে পড়ব। একটা ছবি আঁকারও ইচ্ছে আছে।
সাড়ে দশটা নাগাদ আনসার এখানে আসবে চান করতে। (জি এম আনসার –কবি/বুদ্ধিজীবী। বেশ কিছুদিন ছত্তিশগড়ে আছে। ইউনিয়নের বিভিন্ন কাজকর্ম করে।)
আনসার এসেছে। দুজনে কফি খেলাম, money order পেয়েই চল্লিশ টাকা ধার শোধ করলাম, আর চল্লিশ টাকা দিয়ে সাবান, পেষ্ট, কফি, চিনি ইত্যাদি কিনলাম। আজ হোটেলে খাব। কাল থেকে আবার ইউনিয়ন অফিসে। গতকাল সিংভুম থেকে Dr. Ann এসেছে। আলাপ হল, আজ চলে যাবে।
এখানে আসার সময় বেশ কিছু গল্পের বই নিয়ে আসিস।
২৬.১১.১৯৮১
বিনায়কদা—আমাকে
গতকাল আমি ভিলাই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। মিঃ চৌধুরীর সাথে কথা হল-হাসপাতালের যন্ত্রপাতির ব্যাপারে। উনি যন্ত্রপাতির দামের হিসেব দেবেন ওনার ফাইল ঘেঁটে। এর মধ্যে অনেকগুলোই surgical instruments, যেগুলো তোমাকেই finalise করতে হবে।
১৬.১২.১৯৮১
বালোদে দুবেজী উকিলের ঘরে বসে লিখছি। গত তিনদিন রোজ সকালে লছমনের সাথে চলে আসি বালোদে। (এই সময় ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক সংস্থা – নয়া অঞ্জোর। লছমন ছিল তার অগ্রণী নাট্যকার। সে অন্য শ্রমিকদের নিয়ে নাচ আর নাটক করতো। গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন অধিবেশনে ওরা অনুষ্ঠান করত। যদিও বেশ নাম করেছিল, নাচের মধ্যে ছত্তীশগড়ি কিছু দেখিনি। মুলত হিন্দি সিনেমার নাচেরই নকল। বেশ কিছুদিন পর লছমন ইউনিয়নের সঙ্গ ছেড়ে অন্ধ্রপ্রদেশ চলে যায় অন্য রাজনৈতিক ছ্ত্রছায়ায়। নয়া অঞ্জোরের প্রাণপুরুষ ছিল ফাগুরাম। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গায়ক ছত্তীশগড়িতে গান লিখতো, সুর দিত এবং গাইত। গান লিখে ও নিয়োগীর কাছে যেতো গানগুলো ঠিক করাতে। আমাদের সকলের প্রিয় এই গায়ক কয়েক বছর আগে হার্টের অসুখ জনিত কারণে মারা যান।) যেখানে মিটিং হবে তার আশেপাশের দেওয়ালে ছবি আঁকছি। (মিটিং মানে বীর নারায়ণ সিং দিবস পালন করা হবে। ছত্তিশগড়ে প্রথম বার)।
এখন পর্যন্ত তিনটে আঁকা হয়েছে। নিয়োগী আজ বালোদে এসে আমার আঁকা mural দেখে খুব অবাক হয়েছে। বার বার বলছে “you are a great artist. আমার কোন ধারণাই ছিল না, আপনি এত ভাল ছবি আঁকেন।“ আসলে ছবিগুলো মোটেই অত ভাল হয়নি। জানিস তো নিয়োগীকে। প্রচন্ড রোদে মাচায় উঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঁকতে হয়—মন দিতে পারি না। তাছাড়া চারপাশে স্কুলের বাচ্চাদের ভীড় হয়ে যায়—ঠেলাঠেলি। তাই আজ বালোদে থেকে গেলাম। কাল খুব ভোরে গিয়ে কাজ শুরু করে দেব।
এর আগে দুদিন অমিতের সাথে ঘুরেছি। (অমিত সেনগুপ্ত। দিল্লীতে থাকে। নিয়োগীর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গায়ক সুরকার। দিল্লীতে ট্রেড ইউনিয়ন করে।)
মিটিং এর প্রচারের জন্য কিছু কোরাস গান ও লিখেছিল। কোরাসে জোর করে আমাদেরও ঢুকিয়েছিল। পরশুদিন রাতে সারারাত জেগে টেপ করা হল। রিক্সায় মাইক বাজিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।
আগামী পঁচিশ তারিখ পর্যন্ত এই রকমই চলবে। একটুও সময় পাচ্ছিনা। গতকাল প্রচুর গেস্ট এসে গেছে। মনটা খুবই ভালো আছে। রুগী দেখা আপাতত বন্ধ। বিনায়কদা রুগী দেখছে।
১৯.১২.১৯৮১
(বীর নারায়ণ সিং দিবস প্রথমবার পালিত হল বালোদে। সে এক বিশাল আয়োজন। একটা বিরাট মাঠ আর তার আশেপাশের রাস্তা লোকে গিজ গিজ করছে।
আর সমস্ত মানুষের জন্য খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ভান্ডারা। দায়িত্বে ছিলেন ছবিলালজী—ইউনিয়নের মহামন্ত্রী। বিরাট চেহারা, শান্ত শিষ্ট মানুষ।
ভাত, ডাল, সবজি। বেশ কিছুদিন ধরে ইউনিয়ন অফিসে কৃষকেরা চাল আর বিউলির ডাল জমা করছিল। ভান্ডারাতে কয়েকটা ভাতের পাহাড় তৈরী হল। তারপর হাজার হাজার শ্রমিক কৃষক খেতে বসলো। আমিও বসে গেলাম।
আদিবাসীদের মধ্যে যে এত জাতপাতের সমস্যা আগে জানতাম না। এখানে এক লহমায় সেটা মুছে গেল। সবাই একসাথে খেতে বসল। চারিদিকের বিশাল আয়োজন দেখে স্পার্টাকাস সিনেমার একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ছিল।)
২১.১২.১৯৮১
কুড়ি তারিখে রাজহরায় মহিলা মুক্তি মোর্চার মিটিং হল। আয়েশা (অমিতের স্ত্রী), ইলিনা সেন (বিনায়কদার স্ত্রী), শীলা চক্রবর্তী (প্রফুল্ল চক্রবর্তীর স্ত্রী) বক্তব্য রাখল। তুই থাকলে তোকেও রাখতে হতো।
একুশ তারিখে আগের চেয়ে চুপচাপ। গেস্টদের সাথে আলোচনা। একসাথে নাস্তা। বাইশ তারিখে ভিলাই এ mass meeting হল। নিয়োগীর suggestion এ আজ শহীদ দিবসের একটা evaluation meeting হবে সাত আটজনকে নিয়ে।
২৩.১২.১৯৮১
যত এখানকার কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছি তত নিজের দোনামনাগুলো কমেছে। গতকাল অমিত আমাকে দিয়ে গান গাওয়াল আর প্রচুর প্রশংসা করল। বন্ধুত্বটা দৃঢ় করার চেষ্টায় বোধ হয়। 22nd গভীর রাতে কুরিয়নের ঘরে হঠাৎ নিয়োগী সবাইকার সামনে বলে বসল “আমাদের মধ্যে দিনরাত সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করেছে ডাঃ কুন্ডু।“ সেরকম কিছু করিনি –এত বিচ্ছিরি লাগছিল শুনতে, আসলে সবাই এত খেটেছে এতদিন –রাতের পর রাত ঘুমায়নি। আমাকে তো জানিস, রাত একটু হলেই না ঘুমালে চলে না।
আমার মুহল্লা্র কাজ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এছাড়া পত্রিকার (মিতান) কাজে একটু একটু involved হয়ে পড়েছি। অমিত, আয়েশা 2nd/3rd পর্যন্ত আছে। আয়েশা মহিলা মুক্তি মোর্চাকে সংগঠিত করার কাজ করছে। অমিতের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আর সাত আট দিনের মধ্যে dispensary চালু হয়ে যাবে।
২৪.১২.১৯৮১
এই কটা দিন ঝড়ের মত কেটে গেল। সকাল ছটায় জীপে ভিলাই থেকে এসেছি। তারপর সারাদিন ঘুম।
গত কয়েকদিন ছোটখাট কাজকর্মের দায়িত্ব নিয়ে কাজে লেগে গিয়েছিলাম, থাকা খাওয়া ঘুম সবই উল্টোপাল্টা হয়ে গেছিল।
বাইরে থেকে এসেছিলেন মন্মথনাথ গুপ্ত (যাঁর অনেক বই আছে, ভগৎ সিং এর সাথে লড়াই করেছেন), এ.কে.রায়, পিয়ুস টির্কি, স্বামী অগ্নিবেশ, আর এসেছিলেন কল্পনা যোশী (দত্ত) যিনি সুর্য সেনের সহযোগী যোদ্ধা ছিলেন। এছাড়া কলকাতা দিল্লী থেকে অনেকে এসেছিলেন। গতকাল সবাই চলে গেছেন।
Programme হল 19th বালোদে। সে এক বিশাল মিছিল আর এক বিরাট মিটিং। দেখবার মত জিনিস। আবার থাকা খাওয়ার আয়োজন। সাথে একটা extension—শহীদ মেলা। মন্মথনাথ গুপ্ত, কল্পনা যোশী বলছিলেন যে কাজ গান্ধীজি পারেন নি তা নিয়োগীজি করে দেখিয়েছেন। পঞ্চাশ হাজার মানুষকে মদ ছাড়িয়েছেন।
(শেষ পর্যন্ত ১৯৯১-এ মদ ব্যবসায়ীদের ভাড়াটে আততায়ী নিয়োগীজিকে খুন করল।)
(চলবে)