(ডিসেম্বর ৩, ১৯৮৪ ভারতবর্ষের সেই দুঃস্বপ্নের দিন। ভোপালের ইউনিয়ন কার্বাইড পেস্টিসাইড ফ্যাকটরী থেকে ৪০ টন মিথাইল আইসোসায়ানাইড গ্যাস লীক করে। শ্রমিক বস্তি থেকে শুরু করে রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে সরকারী তথ্য অনুযায়ী ৩৮০০ জন মানুষ মারা যান। হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়া আজও চলছে।
ধীরে ধীরে সারা দেশ থেকে বুদ্ধিজীবীরা ভোপালে এসে উপস্থিত হন। শ্রমিক বস্তিতেই তৈরী হয় জহরীলী গ্যাস কান্ড সংঘর্ষ মোর্চা। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সত্যু (সতীনাথ সারেঙ্গী) ও অনিল সদগোপাল। এই মোর্চার তরফ থেকে প্রমাণিত হয় মিথাইল আইসোসায়ানাইডের একমাত্র চিকিৎসা সোডিয়াম থায়োসালফেট। পরে সরকারী ব্যবস্থাতেও এই চিকিৎসা শুরু হয়। নিয়োগীজিও ভোপালে যান মোর্চার এই কাজের পাশে দাঁড়াতে। কলকাতা থেকে ডা. জ্যোতির্ময় সমাজদার, ডা. পুণ্যব্রত গুণ এবং আরো অনেকে যান। সেই সময় অনিল সদগোপাল এবং সুভাষ গাঙ্গুলী এই গ্যাস কান্ডের উপর একটা অত্যন্ত তথ্য–সমৃদ্ধ বই প্রকাশ করেন। পরে শৈবাল যায় এবং ভোপালে কিছুদিন থাকে এই কাজকর্মে সাহায্যের জন্য। শৈবাল ফিরে আসার পর চঞ্চলা যায় এবং কিছুদিন থাকে ভোপালে।
সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ (আর্থিক) ছাড়া মৃত ও অসুস্থ্ শ্রমিকের পরিবাররা কিছুই পাননি। আজও গ্যাসপীড়িতরা সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছেন। কারখানার মালিকদের কোন শাস্তি হয়নি। সত্যুর উদ্যোগে এখন সম্ভাবনা ট্রাস্ট বানিয়ে গ্যাসপীড়িতদের জন্য হাসপাতাল বানানো হয়েছে।)
১৫/১/১৯৮৫
শৈবাল (ভোপাল থেকে) আমাকে (রাজহরায়)
আজ দুদিন হল আমরা অর্থাৎ এবল ও আমি ক্লিনিকে যাচ্ছি। এখানে মোটামুটি সোডিয়াম থায়োসালফেট দেওয়া ছাড়া অন্য কাজ খুব একটা হয় না। সোডিয়াম থায়োসালফেটই নেওয়ার জন্য প্রচুর লোক আসে। তিন তারিখের জন্য প্রস্তুতি চলছে।
পুণ্য গতকাল চলে গেছে। এছাড়া বাইরের অন্য ডাক্তার যাদের আসার কথা ছিল তারা আসেনি, তাই DBT এখন হবে কিনা সন্দেহ। তবে ক্লিনিকটাকে চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
চঞ্চলার আসার ব্যাপারে সবাই খুব উৎসুক। সবাই চায় চঞ্চলা ২৯ তারিখের আগে এখানে আসুক। আমি সম্ভবত ২৯ তারিখেই ফিরে যাবো তবে রিজার্ভেশন এখনও হয়নি। এবল ২২ তারিখে যাবে। চঞ্চলা কবে আসবে টেলিগ্রাম করে জানাস।
আশা করি হাসপাতাল ভালোই চলছে। ভোপালের জন্য কিরকম প্রস্তুতি চলছে জানাবি। ভিডিও ফিল্মের একটাই কপি রয়েছে, তাই এখন পাওয়া সম্ভব না।
চঞ্চলাকে ঠিকানাটা সাথে করে আনতে বলবি। না হলে খুব অসুবিধা হবে। ফিরদৌস নগর ইউনিয়ন কার্বাইডের কাছেই।
অবিনাশ এলেই ওকে ভোপালে পাঠিয়ে দিস। কারণ প্রদর্শনী বানাতে হবে।
১৩/৩/১৯৮৬
রঞ্জিত ভট্টাচার্য (সম্পাদক, অপনা মোর্চ্ ধমতরী) আমাকে (রাজহরায়)। (হিন্দি থেকে অনুবাদ)
প্রিয় কমরেড,
মোর্চার পাঠক মূলত বস্তাব অঞ্চলের। এজন্য আপনি গ্রাম, বনাঞ্চল বসবাসীদের স্বাস্থ্য, রোগ, ওষুধের ব্যাপারে যে কোন লেখা দিন—আমরা স্বাগত করব।
বিশেষ অংকের জন্য আপনার লেখা ভালো লেগেছে। এই দেশে প্রতিক্রিয়া, বিরোধ ব্যক্ত করার লেখা কমজনই লেখেন। বেশীরভাগ পাঠক এই লেখার উপর প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন না। এই নিয়ে চিন্তা করবেন না। লেখা পাঠিয়ে যান।
(এই সময় আমি অপনা মোর্চাতে প্রতি মাসে একটা করে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লেখা পাঠাতাম হিন্দিতে।)
২৭/৬/১৯৮৬
পুণ্য (ডা. পুণ্যব্রত গুণ, কলকাতা থেকে) আমাকে (রাজহরায়)
আশীষদা, আশা করি তুমি ভালোভাবেই পৌছে গেছ।
(আমি ১৯৮৬ সালে নিয়োগীজিকে জানাই আমি বেশ কিছু দিনের জন্য কলকাতা ফিরে যাবো। উনি জানতে চান কেন? আমি জানাই আমার বাড়ীর সমস্যার জন্য। কিন্তু মূল কারণটা ছিল অন্য। আমার নিজেকে নিম্ন স্তরের ডাক্তার মনে হত। কলেজ জীবনে শুধু রাজনীতিই করেছি। পড়াশোনা করিনি। কাজটা কঠিন ছিল। অনেক জুনিয়র ছেলেদের সাথে compete করে entrance পরীক্ষা দিয়ে post-graduation-এ chance পাওয়া। সেই চেষ্টা করতেই কলকাতা আসা।
তখন নিয়োগীজি বলেন, আপনার জায়গায় surgery জানে এমন একজন ডাক্তার দিন। তখন আমি আমার সাত বছরের জুনিয়র, মেডিকেল কলেজের ছাত্র আন্দোলনের নেতা পুণ্যর সাথে যোগাযোগ করি।)
আমি সেপ্টেম্বর–অক্টোবর নাগাদ তোমাদের ওখানে দিন কয়েকের জন্য যাবো ঠিক করেছি। আমার এই term নভেম্বর ২০ শেষ হচ্ছে। যদি আমার ওখানে গিয়ে কাজ করার scope আছে দেখি এবং তোমরা আমাকে নিতে রাজী থাকো তাহলে ডিসেম্বরের প্রথমে জয়েন করব।
এখন emergency করছি। পেসেন্ট খুব কম। কিন্তু একা house surgeon। তাই বেরোতে পারি না। সবসময়ই on call। কোন constructive কাজে সময়টা কাজে লাগাতে পারি না, তাই এক এক সময় খুব bore লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে। আবার নতুন নতুন অপারেশন কিছু কিছু শিখছি। মাস দুয়েকের মধ্যে kidney exposure ও prostatectomy পাব বলে মনে হয়। সেগুলো না শিখে যাবার কোন মানে হয় না।
এখনও অবধি যে কয়েকটা জায়গায় alternative health work-এর কথা শুনেছি বা দেখেছি তাতে কেবল তোমাদের ওখানেই আমার surgical training কিছুটা utilise করতে পারব। তাই senior housestaffship করার জন্য interest feel করছি।
জানি তোমার অনেক কাজ। এর মধ্যে একটু সময় করে আমাকে জানিও কলকাতা থেকে তোমাদের ওখানে যাওয়ার exact route-টা কি। আমাকে তোমাদের ওখানকার কাজের report পাঠাবে লিখেছিলে। পাঠিও। একটু অন্যান্যদের সাথে কথা বলে জানিও আমার শহীদ হাসপাতালে join করার scope কতটা ।
তুমি, চঞ্চলাদি, শৈবালদা, বিনায়কদা ও অন্যান্যদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
২৯/৭/১৯৮৬
পুণ্য-আমাকে
তোমার পাঠানো “টট্টি উল্টি কে বারে মেঁ সহি জানকারি প্রাপ্ত কিজিয়ে” ও “শহীদ হাসপাতাল-স্বাস্থ্য কে রাস্তে পর নয়া কদম” পেয়েছি। দ্বিতীয় ইস্তাহারটি পড়ে শহীদ হাসপাতালের কাজকর্মের সাথে কিছু পরিচয় হল। আগেই অবশ্য অনেকের মুখে কিছু কিছু শুনেছিলাম।
ডিসেম্বরের প্রথমে আমার তোমাদের ওখানে কাজ শুরু করার ইচ্ছা। কিন্তু এদিকে আবার নতুন একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ভোপালে নতুন করে health camp organize করার একটা প্রয়াস বেশ দানা বেঁধে উঠেছে। সত্যুরা একলব্যের সহায়তায় দুমাস ধরে ভোপাল নিউজ লেটার বার করছে। স্মরজিতদা (ডা. স্মরজিত জানা) ও সুজিতদা (ডা. সুজিত দাস) কিছুদিন আগে কিশোর ভারতীতে মিটিং করে এসেছেন। ২৬ তারিখে স্বরূপদা (ডা. স্বরূপ সরকার), স্মরজিতদা আর জ্যোতি ওয়ার্ধা যাচ্ছে epidemiological survey-এর ব্যাপারে All India meet-এ অংশ নিতে।
ওই কাজে DAF (Drug Action Forum) অংশ নেবে। কিন্তু DAF-এর activist-রা হয় চাকরী করে বা housestaffship করছে। আমিই মোটামুটি available। এই অবস্থায় একদিকে জ্যোতি, স্মরজিতদা, স্বরূপদার কাছ থেকে আবার অন্যদিকে সত্যুর কাছ থেকেও ডাক আসছে—ভোপালে long term কাজ করার জন্য।
একটা কথা তোমাকে frankly বলছি। যদিও প্রচলিত অর্থে established হতে চাইনা,তাহলেও একটু settled হতে হবে বলে feel করছি। Settled অর্থে long time কাজ করা যায় এমন কোন খানে কাজ শুরু করা। ভোপালের অবস্থাটা সেদিক থেকে অনেকটাই uncertain।
তাহলেও ভোপালের প্রতি একটা প্রচন্ড দায়িত্ববোধ থেকেই যাচ্ছে, তাই বেশ মানসিক দোটানার মধ্যে আছি।
যাই হোক October-এ পাঁচ দিনের জন্য তোমাদের ওখানে যাবো ঠিক করেছি। সঙ্গে আমার এক বন্ধু যাবে। Reservation হয়ে গেলে তোমাকে জানাবো।
২৮/৯/১৯৮৬
পুণ্য-আমাকে
আশীষদা, আমি ৭ তারিখে বোম্বে মেলে টিকিট কেটেছি। আমার রুমমেট আমার সাথে যাবে। পাঁচদিন থাকব।
ভোপালের ব্যাপারে জানো নিশ্চয়। জ্যোতি ভোপাল গিয়েছিল। দু-তিনদিন আগে ফিরেছে। অনিল, সত্যু No More Bhopal Committee-র meeting-এর জন্য ২৩ তারিখে এসেছিল, ফিরে গেছে।
(পুণ্য ওর বন্ধুকে নিয়ে এসেছিল। কদিন থাকার পর সিদ্ধান্ত নেয় শহীদ হাসপাতালেই কাজ করবে।
তবে এর মধ্যেই একটা ছোট দুর্ঘটনা ঘটে। ওরা দুই বন্ধু সাইকেলে করে ঘুরছিল। সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পুণ্যর ভুরুর কাছে একটা গভীর ক্ষত হয়। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে আমিই সেলাই করি। আমার শল্য চিকিৎসায় নিপুণ কাজের নমুনা হিসেবে পুণ্যর ভুরুতে সেই বিচ্ছিরি দাগ আজ এত বছর পরেও অটুট আছে।)
সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ তারিখ নেই
এই ইস্তাহার বিলি করা হয়। (হিন্দি থেকে অনুবাদ—সংক্ষিপ্ত)
ইস্তাহার
ছত্তিশগড়ের এক লাখ কিসান মজদুর নবযুবক রায়পুরে মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে।
ইলেকশান যত কাছে আসছে ছত্তিশগড়ের সব নেতারা টিকিট পাওয়ার আশায় দিল্লী ভোপাল দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ছত্তিশগড়ের আকাল নিয়ে কারোর কোন চিন্তা নেই। এ বছরে কম বৃষ্টি হওয়ার জন্য ধানের ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ছত্তিশগড়ের সমস্ত নদী এবং বাঁধের জল উদ্যোগপতিদের হাতে চলে গেছে। ভিলাই-এর স্টীল প্ল্যান্ট, কোরবার-বিলাসপুরের-বালোদের সিমেন্ট কারখানা, রাজারাম মেজ ফ্যাক্টরি, কেড়িয়া ডিস্টিলারী—এরা ছত্তিশগড়ের জল শুষে নিচ্ছে না, এদের প্রদূষিতও করছে।
গংগরেল, খরখরা, গোঁদলী, তান্দুলার জল একেবারে শুকিয়ে গেছে, এ বছর পান করার জলের যে কষ্ট, তাতেও শিওনাথ, মহানদী, আরপা, ইন্দ্রাবতীর জলকে বাঁধ দেওয়ার কোন কাজই হয়নি।
ছত্তিশগড়ের কান্না কে শুনবে? ছত্তিশগড়ের মানুষকে এর বিকল্পের কথা ভাবতে হবে।
আমরা ২ অক্টোবর গান্ধী জয়ন্তীর দিনে এক লাখ কৃষক মজদুর মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপালের কাছে এর সমাধান চাইবো।
২/১/১৯৮৭
শৈবাল—আমাদের
আশীষ/চঞ্চলা,
আশা করি তোরা ভালভাবেই পৌঁছেছিস। আমরা এখানে ভালো আছি। ৩১ নভেম্বর থেকে হাসপাতালের দোতলার কাজ শুরু হয়েছে। এদিকে আন্দোলনের অবস্থা আগের মতোই। আগামীকাল প্ল্যান্ট বন্ধ করা হবে।
এদিকে spirit আর morphine-এর order এসেছে। তোদের কাছে পাঠাচ্ছি। Bengal Chemical থেকে নিতে হবে। প্রায় ১৫০০ টাকা লাগবে (অনুমান)। আর Lucky Bharat Garage-এ মাল পাঠাতে বলবি। যদি সম্ভব হয় তোরা নিয়ে আসবি। কারোর কাছ থেকে ধার করতে হবে। Exact amount জানালে আমরা পাঠিয়ে দেব।
রমেশের অবস্থা আগের মতোই। আজ ২/১/১৯৮৭ সকালে আমাদের মজদুরদের উপর C.I.S.F. লাঠি চার্জ করে। আজকে রাজহরা বন্ধ ছিল। ম্যানেজমেন্ট জোর করে bunker চালায়। হিরামন, গনেশ, পরদেশী সহ অনেকে আহত হয়েছে। সকাল থেকেই পুণ্য ভিড়ে রয়েছে।
চলবে……
অনেক ধন্যবাদ এমন তথ্যগুলোর জন্য।