পথ চলা শুরু
ছাত্র জীবনে অনেক ভালো মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলাম যাঁরা মানুষ হিসেবে সমাজের প্রয়োজনে কিছু কাজ করার জন্য উদবুদ্ধ করেছিলেন। কাউকে দোষ না দিয়ে, নিষ্ঠা নিয়ে নিজের মত করে সেই কাজগুলো করে যাওয়ার চেষ্টা করেছি এতকাল। কিছু করব এই বোধ বা নতুন কিছু করার তাগিদ সব সময়ই তাড়া দিয়েছে পেছন থেকে। ছাত্রাবস্থায়, জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে যেসব দার্শনিক গুরু ও রাজনৈতিক বন্ধুদের পাশে পেয়েছিলাম তাঁরাই আমাকে শিখিয়েছেন সাধারণ মানুষের পাশে কিভাবে দাঁড়ানো যায়। নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবনের জলে-জঙ্গলে, কোলিয়ারি এলাকায়, বাউল সম্প্রদায়ের মাঝে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মানুষ কত কষ্টে থাকে। মাটির সঙ্গে মিশে মানুষের কাজ করার জন্য নিজেকে তৈরি করেছি। সার্জারি, এনেস্থেসিয়া সব ধরনের কাজ শিখেছি।
কাজ করতে গিয়ে ব্যথার অচলায়তনকে প্রথম অনুভব করেছিলাম। দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতায় বারবার উপলব্ধি করেছি মানুষের ব্যথা সারানোর চেষ্টা করা হয় না অথবা ব্যথার অনুভূতিকে বড্ড হালকা ভাবে নেওয়া হয়। কোমরের ব্যথা বা রোজকার মাংসপেশীর ব্যথা, এমনকি ক্যান্সার পেশেন্টকে শেষ জীবনে যে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তার কোনোটারই উপশমের চেষ্টা করা হয় না। কোন সাধারণ ওষুধই এ সময় কাজ করে না। আসলে সবাই হয়তো ধরেই নেয়, আর কিছু করার নেই- তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে সেই রোগীকে ফেলে সবাই হাত তুলে নেয়- নিতে বাধ্য হয় আর কি! ইএসআই হাসপাতালে এসে দেখলাম অসংখ্য মানুষের কোমরের ব্যথার চিকিৎসা হিসেবে ট্র্যাকশন ব্যবহার করা হচ্ছে। দীর্ঘ সময় রোগীকে বিছানায় শুইয়ে ওজন ঝুলিয়ে দেওয়া আছে। অনেকেই মাসের পর মাস এভাবে শুয়ে থাকলেও ব্যথা কমছে না।
এরপর আসে সেই সময় যখন আমি নিজেই ট্র্যাকশন নিয়ে শুয়ে থাকতে বাধ্য হই। হঠাৎ করে প্রায় বিনা নোটিশে আমাকে দুর্গাপুর ইএসআই হাসপাতালে ট্রান্সফার করা হয়েছিল। সম্ভবত কিছু সহকর্মী রেগে গিয়ে আমাকে বিপদে ফেলার জন্য এই কাজটা করিয়েছিল। সত্যিই এই ট্রান্সফারের জন্য খুব বিপদে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম চাকরিটাই ছেড়ে দেব। কিন্তু ডিরেক্টর ডা. অসীম বর্ধন রাজি হলেন না। এক রকম অনিচ্ছা নিয়েই দুর্গাপুর হাসপাতালে জয়েন করলাম। কলকাতা থেকে যাতায়াত শুরু করার পর থেকেই ব্যাক পেইন শুরু হয়। অসহ্য ব্যথায় প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি। পরিস্থিতির ফেরে আমিও ট্র্যাকশনের শরণাপন্ন হই। আসলে তখনো পর্যন্ত আমাদের এখানে ট্র্যাকশন দিয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া কোমরের ব্যথা কমানোর অন্য কোনো চিকিৎসা ছিল না।
এই তীব্র ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে অনেক রোগী কোমরে অপারেশন করান। কিন্তু অপারেশনের পরে বেশিরভাগেরই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে, এসব দেখে আমারও অপারেশনের প্রতি একটা ভয় তৈরি হয়েছিল। সেই ভয় থেকেই আমিও অপারেশন করাতে চাইনি বরং যখন যেরকম প্রয়োজন হয়েছে, চিকিৎসকের নির্দেশ মত এক সপ্তাহ বা একমাস শুয়ে থেকেছি।
প্রস্তুতি
এর মধ্যেই হঠাৎ করে সুযোগ এলো। খবর পেলাম দিল্লিতে অর্থোপেডিক ডাক্তারদের একটি ওয়ার্কশপ করা হবে, ওজোন থেরাপি নিয়ে। সারা বিশ্ব থেকে, যেমন ইতা্লি, জার্মানী, জাপান—এইসব জায়গা থেকে ডাক্তাররা এসে ডেমোনস্ট্রেট করবেন কিভাবে ওজোন (Ozone) প্রয়োগের মাধ্যমে স্লিপ ডিসকের সমস্যা তাঁরা কমাতে পেরেছেন। এই ওয়ার্কশপের খবর শুনে আমি খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম। অনেকদিন ধরেই শিরদাঁড়ার ব্যাথা কমানোর আরও অন্য উপায় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। আমার সহকর্মী ও সিনিয়র অর্থোপেডিক সার্জেনও ওই ওয়ার্কশপে গিয়ে বিষয়টি চাক্ষুষ করার কথা বলেন। সেটা ২০০৫ -২০০৬ সাল।
এই ওয়ার্কশপে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আমার চোখ খুলে যায়। অপারেশন না করেই একটি সি-আর্ম যন্ত্র দিয়ে কিভাবে স্লিপড ডিস্কের উপর ওজোন প্রয়োগ করে মানুষের কোমরের ব্যথা কমানো যাচ্ছে!! আমি দারুণ প্রভাবিত হই, সামনে একটা নতুন দিগন্ত খুলে যেতে থাকে। দিল্লিতে যারা এই কাজগুলো করেছিল তাদের ইতিমধ্যে প্রচুর পাবলিকেশন ছিল। আমি সেগুলো পড়ে বিষয়টি সম্পর্কে আরো জানার চেষ্টা করি। তখনই খবর পাই দিল্লিতে ডা. জি.পি. দুরেজা বলে একজন পেইন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। কিন্তু আমাদের দেশের ওই একই সমস্যা, কেউ ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহ নিয়ে কোন কাজ করলে ম্যানেজমেন্ট থেকে বাধা আসবেই। ডা. দুরেজার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, ভদ্রলোক সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি পেইন ইনস্টিটিউট তৈরি করেছিলেন। সেখানে পেইন ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং দেওয়া হত। খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমি এই ট্রেনিংটা নেব। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। আমি ফিরে এসেই শ্রম দপ্তর কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখি, পেইন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ওঁরা দিল্লিতে কি ধরনের কাজ করছেন তার একটা প্রাথমিক ধারণা নিয়ে আসার জন্য আবেদন করি। অনুমতি পাই।
ওখানে গিয়ে প্রথম উপলব্ধি করি কত ধরনের পেইন আছে! এই ভাবনা আগে কখনো আসেইনি! কারো হাত এমপুট হয়ে গেছে, কারো স্লিপড ডিস্ক হয়েছে, কারো ক্যান্সার হয়েছে, কারো নার্ভের যন্ত্রণা—এইরকম নানান রোগীকে মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে, কোথাও বা নার্ভরুটে ইঞ্জেকশান দিয়ে ব্যথা কমানো হচ্ছে। ব্যথা জর্জরিত মানুষগুলো আরাম পাচ্ছেন, সম্পূর্ণ ভাবে ব্যথা মুক্ত হয়ে উঠছেন কেউ কেউ।
পেইন ম্যানেজমেন্টের এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আমাকে দারুণ উৎসাহিত করেছিল। সেই সঙ্গে মনে একটা প্রশ্নও ওঠে! এমন জিনিস কেন আমরা আমাদের এখানে চালু করতে পারবো না?
আমি কলকাতায় ফিরে এসে ডিরেক্টর ডা. অসীম বর্ধন সাহেবকে সম্পূর্ণ বিষয়টা জানাই। উনিও সবটা শুনে খুব উৎসাহিত বোধ করেন, এবং আমাকে ট্রেনিংএ যাওয়ার অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে এটাও বলেন- “ট্রেনিং নিয়ে এসে কিন্তু এখানেই কাজ করতে হবে”। সত্যি কথা বলতে কি আমি ওনার এই কথা শুনে দারুণ খুশি হই—আমি যেমন ভবিষ্যতে পেইন নিয়ে কিছু কাজ করতে চাইছি উনিও তেমন ভাবেই ভাবছেন। বর্ধন সাহেবের এই কথা আমাকে সাহস যুগিয়েছিল।
কাজের সুবিধার জন্য আমি পেইন ম্যানেজমেন্টের একটি সংস্থা ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর স্টাডি অফ পেইন-এর মেম্বারশিপ নিই। বিষয়টিকে গভীরভাবে জানার জন্য সেই সময় পেইনের প্রতিটা ন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। গিয়ে দেখতাম শ্রোতা হিসেবে বড়জোর ১০০ থেকে ১৫০ জন উপস্থিত থাকত। হয়তো অনেকেই উৎসাহ পেত না। ওই কনফারেন্সগুলোতে গিয়ে আমার পেইন মানেজমেন্ট সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার পরিধি অনেক বেড়ে গেল। পেইন নিয়ে কাজ করার বিষয়টি আগে থেকেই আমার মাথায় এসেছিল, এই ট্রেনিং নেওয়ার ফলে পেইন নিয়ে ভবিষ্যতে কি কি কাজ করা যায় তার একটি আবছা অবয়ব দেখতে পাচ্ছিলাম। আসলে ততদিনে পেইন ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বড় সমস্যা হল আমাদের দেশে পেইন নিয়ে পড়াশোনার কোন জায়গা নেই- না আছে কোন কোর্স- না আছে সিলেবাস। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ব্যথা কমানোর জন্য যে আলাদা চিকিৎসা হয়—এ দেশে চিকিৎসকদের মধ্যেই তা নিয়ে স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। এখানে তখনও এই বিদ্যার স্বীকৃতিই ছিল না।
চলবে…
অনুলিখন: শুক্লা সরকার ও পিয়ালী দে বিশ্বাস