সময়টা নয়ের দশকের মাঝামাঝি। সদ্য ডাক্তারি পাস করেছি। ইন্টার্নশিপ, হাউসস্টাফশিপও শেষ। তখনো ডাক্তারদের সরকারি চাকরি নিয়ে এতো অনীহা তৈরি হয়নি। ফলে চটজলদি চাকরির বেশ আকাল। অথচ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে জায়গা করে নেওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার পাশাপাশি অর্থেরও প্রয়োজন। হঠাৎ শুনতে পেলাম বিদ্যুৎপর্ষদ ডাক্তার নিচ্ছে। খানপঞ্চাশেক প্রার্থী আর পাঁচটি ভ্যাকান্ট পোস্ট। রিইউনিয়ন মার্কা একটা ইন্টারভিউ শেষে জানা গেলো “চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা, সত্যি।” আর ওঠ ছুঁড়ি তোর বে’র মতো পোস্টিংও সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলাম। বিদ্যুৎপর্ষদের মূখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক চোখ নাচিয়ে বললেন “সাতদিনের মধ্যে জয়েন করতে পারলে থাকো, নয়তো প্যানেল থেকে নেক্সটম্যানকে নিচ্ছি।”
অগত্যা! রাম্মাম হাইডেল প্রজেক্ট, সিকিম বর্ডারে। বিদ্যুৎপর্ষদের সেলুলার জেল। লোকে এখানে ট্রেক করতে আসে, চাকরি করতে থোড়াই আসে। ফলে আমার আগে যেসব ডাক্তার এসেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই ডাক্তারি করার থেকে কিকরে আবার সমতলে ট্রান্সফার হওয়া যায় সেই চিন্তাতেই সময় কাটিয়ে দিতেন। নতুন ডাক্তার স্টেথোস্কোপ গলায় রীতিমত দুপাশে বই সাজিয়ে চিকিৎসা করতে শুরু করায় স্থানীয় লোকজন বেশ ঘাবড়ে গেল। অন্যান্য কর্মী ও ইঞ্জিনিয়াররা নতুন ডাক্তারের মাথার সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মোটকথা, আস্তে আস্তে স্থানীয় মানুষেরা ভালোবাসতে শুরু করলেও অধিকাংশ কর্মচারী আসতেন রেফার কিংবা রেস্ট লেখাতে।
আর বিরক্ত হয়েছিল লিনসেবং আর লোধামার দুই মেডিক্যাল ইউনিটের স্টাফেরা। তারা এতোদিন নিজেদের ইচ্ছে মতো আসতে যেতে পারতো। নিজেদের ইচ্ছে মতো চিকিৎসাও দিতো। তাতে দিব্যি নাকি মানুষ ভালো হয়ে যেতো। ডাক্তারবাবুরা তো শুধু ওষুধের হিসেবেতে সই করে দেবেন। ছোটখাটো বিষয়ে নাক গলানোটা নিচু রুচির পরিচায়ক। এতো নিচু মনের ডাক্তার আগে কখনো আসেনি। ছি! তবে দু’একজন স্টাফ ব্যতিক্রম ছিল। কদিনের মধ্যেই পক্ষে আর বিপক্ষের স্টাফেদের মধ্যে ধুন্ধুমার ঝগড়া লেগে গেলো।
এই পক্ষ-বিপক্ষ ব্যাপারটা প্রথমদিন থেকে বোঝা গিয়েছিল। আর প্রথমদিন থেকে বুঝতে পেরেছিলাম স্থানীয় ভাষা জানাটা ডাক্তারদের কাছে কত জরুরি। একদম সকালে এক পেশেন্ট হাজির। পাঁচ-ছয় বছরের একটি মিষ্টি বাচ্চা তার বাবা-মার সাথে। “খুট্টা কাটেয়ো”। কেলেংকারী করেছে! কুকুরে কামড়েছে? তড়িঘড়ি ফ্রিজ থেকে অ্যান্টি-র্যাবিস ভ্যাক্সিন বার করা হলো। ফার্মাসিস্ট নির্বিকারভাবে সাহায্য করে যাচ্ছেন। ইঞ্জেকশন নিয়ে যখন রেডি তখন সিস্টার হইহই করে তেড়ে এলেন। – “করছেন কি মশাই, খুট্টা কাটেয়ো মানে পা কেটে গেছে। নেপালী ভাষায় খুট্টা মানে পা।” মানে? কুত্তায় কামড়ায়নি? তবে যে ফার্মাসিস্ট সাহেব ইঞ্জেকশন বার করার সময় কিছু বললেন না?
অন্য পেশায় স্থানীয় ভাষার ওপর তেমন দখল না থাকলেও চলবে, কিন্তু ডাক্তারদের সাধারণের মুখের ভাষা জানতেই হবে। প্রতিটা জায়গাতে নিজস্ব কিছু কথা থাকে। কলকাতা থেকে যত দূরে যাওয়া যায় ততই নতুন কিছু অভিধানের বাইরের শব্দ কথায় যোগ হয়। থাকতে থাকতে সেই অচেনা শব্দ জিবে সড়গড় হয়ে যায়। পরে নদীয়া জেলায় এসে নতুন কিছু শব্দের সাথে পরিচয় ঘটেছে। যেমন “হ্যাদ ক্যাদ নেই” মানে যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে সে সেরকম স্মার্ট নয়। কিংবা পাটাকে ‘ষাট’ করা মানে সোজা করা বোঝায়। প্রথমদিকে হাসপাতালের ওপিডিতে পা ভাঁজ করানোর জন্য একটা পেশেন্টকে সরল মনে পাটাকে ‘তিরিশ’ করার কথা বলে বেশ হাসির খোরাক হয়েছিলাম। কথার মানেও বদলে যায় – “আড্ডা করা” মানে গল্প করা নয়, ইয়ার্কি মারা।
পাহাড়ে প্রথম পোস্টিংয়ের গল্প হচ্ছিল। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া সবাই ডাক্তারদের ভালবাসে, ভরসা করে – সেটা কয়েকদিনের মধ্যে বুঝে গিয়েছিলাম। আর সেই জন্য থাকার কোয়ার্টারের বদলে মেডিক্যাল ইউনিটের ভেতর বইয়ের সংখ্যা বাড়ছিল। বেশি সময় কাটছিল ওখানে। বিভিন্ন ধরনের রোগী আসতো। অবশ্য গাইনি,ওবস নিয়ে আমার চিরকাল একটু আতঙ্ক ছিল। তার কারণ নিয়েও একটা মজার গল্প আছে। থার্ড ইয়ার বোধহয়, নর্মাল ডেলিভারি পড়াচ্ছিলেন সিনিয়র এক দিদি। প্লাসেন্টা বার হ’ল, সাথে বেশ কিছুটা রক্ত। গা গুলিয়ে উঠলো, আশপাশের দৃশ্য আস্তে আস্তে চারের দশকের সিনেমা। সাদা-কালো হতে হতে ঝিকমিক তারা আর তারপর ঘন অন্ধকার। শেষ মুহূর্তে শুনতে পেলাম কেউ একজন চেঁচিয়ে বলছে – “ভেসোভেগাল হয়েছে ছেলেটার।” একরাশ লজ্জা নিয়ে জ্ঞান ফেরা। তারপর থেকে বন্ধুবান্ধব আমার ওপর বিরক্ত হলেই বলতো – ” চল, গায়নাকোলজি আর অবস্টেট্রিক্স পড়তে ওয়ার্ডে যাই।” জোঁকের মুখে নুন দেওয়ার অবস্থা। ফলে সাবজেক্টটায় আমার পুঁথিগত বিদ্যা ভরসা। ইন্টার্নশিপেও যথেচ্ছ ফাঁকি দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
তো… এক রাতে পালে বাঘ পড়লো। প্রাইমিগ্রাভিডা, প্রথম মা হতে যাচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে লেবারে আছে – এমন একটি রোগিণী রাতদুপুরে হাজির। এপিসিওটোমি দিয়েও বেবি আউট করতে না পেরে ফরসেপ দেওয়ার ডিসিশন নিলাম। তখন কোথায় ইউ টিউব আর কোথায়ই বা মোবাইল ফোন। ফলে থ্রি ইডিয়টসের আমীর খান হওয়ার সম্ভাবনা ছিলনা। পাহাড়ের ওপর, শীতের রাতেও ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে সফল একটা ডেলিভারি করালাম। তবে দুজন সিস্টার খুব সাহায্য করেছিল।
ঠিক একবছরের মাথায় ট্রান্সফার অর্ডার এলো। অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গায়। পোস্টগ্র্যাজুয়েশনে র্যাঙ্ক হয়েছে শুনে সিএমও সাহেব খুব অবাক – “সেকি! তুমি তো তাহলে পড়াশোনা করো!” অষ্টম আশ্চর্য দেখছেন এরকম একটা মুখ করে জানালেন – “তাহলে তোমায় ভালো জায়গায় সরাতে হবে, যাতে পড়াশোনাটা বজায় থাকে।”
রাম্মাম থেকে চলে যাচ্ছি খবর পেয়ে প্রচুর লোক এসেছিল দেখা করতে। স্থানীয় মানুষেরা উত্তরীয় ( ওদের ভাষায় ধাগা) দিয়ে সম্মান জানিয়ে যাচ্ছিল। এক ট্রাঙ্ক ভর্তি ধাগা পেয়েছিলাম। সমস্ত কিছু বাঁধাছাঁদা করে যখন বেরিয়ে আসছি তখন দেখি দুজন স্বামীস্ত্রী একটা মাসদশেকের বাচ্চা নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। ছোট্ট মেয়েটির হাত দিয়ে আমার গলায় তারা ধাগা পরিয়ে দিল। আমি বাচ্চাটাকে আদর করে নেপালীতে জিজ্ঞেস করলাম যে নাম কি রেখেছে ওর।
“চিনতে পারছেন না ওকে? ওকেই তো আপনি পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন। ওর নাম রেখেছি জানা, জানা তামাং।”
ফিরে যাওয়ার পথে ধোতরেতে সেদিন বছরের প্রথম তুষারপাত হয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে এসে ধবধবে সাদা পেঁজা তুলোর মতো তুষারের মধ্যে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঠান্ডা বরফের সাথে আমার দুচোখ বেয়ে নেমে আসা গরম জল মিশিয়ে দিতে দিতে ভাবছিলাম আমার কান্না সাথের ড্রাইভার না দেখে ফেলে।
It’s lovely experience story sir, galpo ta porte porte sab jyano chobir moton dekhte pacchilam….
Aro anek ei dharoner sundor avigyotar jhuli theke galpo porte chaai Sir. Respect…?
অনেক ধন্যবাদ। সম্পাদক অনুমতি দিলে চাকরি /, ডাক্তারি জীবনে হেঁটে আসা পথটা নিয়ে বেশ কয়েক মাস লিখতে পারি।
আপনার হাত থেকে কেউ কলম কাড়বে না। লিখুন যতখুশি। তবে ডাক্তারিটা ছাড়বেন না প্লিস।
?❤ ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটা, আপনার জীবনের ঘটনা জেনে ভালো লাগলো,গল্পের মাধ্যমে আরো অনেক ঘটনা জানার অপেক্ষায় থাকলাম ।
ধন্যবাদ স্বাতী। এখন ফেলে আসা সময় নিয়ে ভাবতে বসলে গল্পই মনে হয়। সবার জীবনই ছোটছোট গল্প নিয়ে তৈরি হওয়া একটা মালা।
ধন্যবাদ, শুভরাত্রি।
Khub valo hoyeche lekhata…pore bhalo laglo…ei vabei likhe jan…???
ধন্যবাদ নূপুর।
Very well composed, love to read many more….. Very pleasant time spent as I was going through your personal experience as a doctor. This beautiful expression describes the mixture of emotion and technical expertise…….. Not only a very good doctor……… altogether an excellent human being….. Keep it up ????????
Thanks a lot, Dr PalChowdhury. ❤
অসাধারণ । ভাগ করে নিলাম ।
ভালো ডাক্তারবাবুরা মনে হয় ভালো লেখকও হন… আরো লিখুন আরো পরি.. এমনিতে বই পড়ার অভ্যেস চলে গ্যাছে… তবুও পরি… ভালোবাসা নেবেন
খুব সুন্দর গল্পটা ।গল্পটা জেনে খুব
ভালো লাগল।?