বয়স্ক ডাক্তারবাবুর চেম্বারে একজন মহিলা ঢুকলেন তাঁর ছেলের হাত ধরে। বেশ বড় ঘর। একপাশে দুটো কাঠের আলমারি। তাতে অসংখ্য বই ঠাসা। মেডিকেল সাইন্সের বই যেমন আছে, তেমনি আছেন শরৎ, বিভূতি, রবীন্দ্রনাথ।
মহিলার ডাক্তারবাবুর চেম্বারটি ঠিক পছন্দ হল না। চেম্বার হবে ঝাঁ চকচকে। ছোটো খাটো। এখানে রোগী শোয়ানোর যে টেবিলটা আছে সেটা মাঝারী খাটের সমান। একজন লোক শুয়ে স্বচ্ছন্দে ঘুমাতে পারে।
ডাক্তারবাবু একমনে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস পড়ছিলেন। মহিলার পায়ের আওয়াজে মুখ তুললেন।
মহিলা বললেন, ‘স্যার, আমার ছেলে খুব অসুস্থ।’
‘নামটা আগে বল মা।’
‘আজ্ঞে, মাধুরী সামন্ত।’
‘তোমার নাম নয় মা। ছেলের নাম আর বয়স?’
‘ওর নাম ত্র্যম্বক সামন্ত। বয়স ষোলো।’
‘কি নাম বললে? চুম্বক?’ বয়স্ক ডাক্তারবাবু থত মত খেয়ে মুখ তুললেন।
‘চুম্বক নয় স্যার। ত্র্যম্বক। স্যার ও খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়েছি। কিছুই উন্নতি হচ্ছে না।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কি হয়েছে কি?’
‘চারদিন ধরে জ্বর আর যা খাচ্ছে বমি করছে। জল ছাড়া আর কিছুই পেটে থাকছে না। আপনি ওকে সুস্থ করে দিন স্যার।’
ডাক্তারবাবু ছেলেটিকে শোয়ালেন। পেট টিপে দেখলেন। বুকে স্টেথো বসালেন। চোখের পাতা টেনে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘হুম…’
মহিলা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, ‘কি বুঝলেন ডাক্তারবাবু?’
‘পেচ্ছাপ কেমন হচ্ছে। রঙ কি?’
‘পেচ্ছাপ? মানে টয়লেট? একটু হলুদ।’
‘মনে হচ্ছে ত্র্যম্বক বাবুর ভাইরাল হেপাটাইটিস হয়েছে। ঐ যাকে তোমরা বল জণ্ডিস।’
‘জণ্ডিস? কিন্তু ডাক্তারবাবু জণ্ডিস হলে তো চোখ হলুদ হবে। ওর তো চোখ তেমন হলুদ মনে হচ্ছে না।’
‘মাধুরী মা, ঘরের কৃত্রিম আলোয় চোখের হলুদ বোঝা নাও যেতে পারে। সূর্যের আলোয় ভালো বোঝা যায়। তাছাড়া ভাইরাল হেপাটাইটিসে সব সময় চোখ হলুদ নাও হতে পারে। অনেক সময়ই চোখের হলুদ ভাব জ্বর- বমি আরম্ভ হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর হয়।’
‘তাহলে বোঝার উপায় কি?’
‘বোঝা যাবে রক্ত পরীক্ষা করলে। তার আগে বল তো তোমাদের বাড়ি কি অরবিন্দ পল্লী।’
মহিলা অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি কি করে জানলেন?’
ডাক্তারবাবু হাসলেন। বললেন, ‘আন্দাজেই বললাম। অরবিন্দ পল্লী থেকে রোজ তিন চারজন হেপাটাইটিস রোগী দেখাতে আসছে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো মা, ত্র্যম্বক বাবুর ভাইরাল হেপাটাইটিস হয়েছে এবং এক্ষেত্রে কালপ্রিট হেপাটাইটিস এ ভাইরাস।’
কিন্তু রক্ত পরীক্ষা ছাড়া আপনি কি ভাবে বলতে পারছেন?’
‘তার আগে বলো তো মা, তোমরা কোথাকার জল খাও।’
‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, কর্পোরেশনের। বাড়িতে একোয়াগার্ড আছে। তবে…’
‘তবে কি?;
‘তবে মাস খানেক আগে একোয়াগার্ড কয়েকদিনের জন্য খারাপ ছিল। তখন কয়েকদিন কর্পোরেশনের জলই খেয়েছি।’
‘ব্যাস দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল। হেপাটাইটিস এ’এর ইনকিউবেশন পিরিয়ড অর্থাৎ দেহে প্রবেশ করার পর থেকে রোগ সৃষ্টি করার মধ্যে সময়ের পার্থক্য ১৫ থেকে ৩০ দিন। আর একই অঞ্চলে পর পর হেপাটাইটিস এ’এর কেস পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ পানীয় জলের লাইন কোথাও ছ্যাদা হয়ে পয়ঃপ্রণালীর সাথে মিশছে। এক্ষেত্রে একজনের রক্তে যদি হেপাটাইটিস এ ভাইরাস পাওয়া যায়, তাহলে পরীক্ষা ছাড়াও বলা যায়, বাকি সকলেরও হেপাটাইটিস এ হয়েছে। তোমরা যেমন হাড়ির একটা চাল টিপেই বুঝে যাও সবকটা চাল ভাত হয়েছে কিনা। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু কিছু পরীক্ষা করান নি?’
‘হ্যাঁ, এই যে।’
‘এই দেখ মা, লিভার ফাংশন টেস্টে এস জি পি টি ১৮০০ ইউনিট হয়ে গেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এটা ৪০ এর নীচে থাকে। এস জি পি টি এবং এস জি ও টি এরা লিভার এনজাইম। হেপাটাইটিসে এগুলি অন্তত ১০ গুণেরও বেশী বাড়ে। কিন্তু যদি বিলিরুবিন দেখ, সেটা ততো বাড়েনি। মাত্র ১.৮।’
‘তাহলে স্যার রোগ যখন ধরা পড়েছে, তখন ওষুধ দিন। ছেলেটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে।’
‘ওষুধের তো দরকার নেই মা। এই রোগ এমনি এমনিই সারে।’
‘ছেলেটা এতো কষ্ট পাচ্ছে, আপনি ওষুধ দেবেন না। তাহলে আর রোগ নির্ণয় করে কি লাভ হল!’
‘এটুকুই লাভ হল যে আমি এখন নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি ত্র্যম্বক বাবুর কোনও ভয় নেই। হেপাটাইটিস এ তে কেস ফ্যাটালিটি রেট অত্যন্ত কম। এই রোগ সেলফ লিমিটিং। নিজে নিজেই সেরে যায়।’
মাধুরী দেবী বললেন, ‘তবে যে শুনি হেপাটাইটিস বি অত্যন্ত ভয়ংকর রোগ। এর থেকে লিভার ফেলিওর হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।’
‘ঠিকই শুনেছেন। কিন্তু হেপাটাইটিস এ থেকে হেপাটাইটিস বি সম্পূর্ণ আলাদা। হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি দীর্ঘ সময় শরীরে থেকে যেতে পারে এবং প্রাণঘাতীও হতে পারে। কিন্তু এরা রোগীর মল আর জলের মাধ্যমে ছড়ায় না। এরা রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়। হেপাটাইটিস বি কখনও বহুলোকের এক সাথে হয় না।’
মাধুরী দেবী বললেন, ‘তাহলে কি কোন ওষুধই খাওয়ানোর দরকার নেই?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘খুব বমি হলে বমির ট্যাবলেট লিখে দিলাম। আর ও আর এস খাওয়াবেন। জ্বর এলে প্যারাসিটামল। আর পায়খানা যদি না হয়, এই ওষুধটা। তবে খাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে লিভার আমাদের দেহের রান্নাঘর। রান্না ঘরে যখন মূল গণ্ডগোল তখন খাওয়া দাওয়া করতে হবে তেল মশলা ছাড়া। হালকা মাছের ঝোল চলতে পারে। কিন্তু ভাজা ভুজি একদম নয়। বরঞ্চ রোগীকে হাই কার্বোহাইড্রেট খাবার খাওয়াতে পারেন। যেমন আখের রস, চিনির জল। তার সাথে রোগী যত পারবে বিশ্রাম নেবে। তাতে দেহের মেটাবোলিজম কমবে। লিভার বিশ্রাম পাবে। এভাবে চললেই দেখবেন আর দু তিনদিনের মধ্যেই ত্র্যম্বক বাবুর বমি, জ্বর কমে গিয়ে খিদে ফেরত আসবে।’
‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু, ওকে একবার ঝাড়িয়ে আনব কি? শুনেছি ঝাড়ালে জণ্ডিস নেমে যায়।’
ডাক্তার বাবু বললেন, ‘তাহলে এতক্ষণ কি শুনলেন! অধিকাংশ ভাইরাল হেপাটাইটিস নিজে নিজে সারে। ঝাড়ালে সাতদিনে সারে, না ঝাড়ালে এক সপ্তাহ সময় লাগে।’
মাধুরী দেবী পেসক্রিপশন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ফেরত এসে বললেন, ‘স্যার, একটা খুব ভালো ভিটামিন লিখে দিন না। ছেলেটা একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমন ভিটামিন দিন যাতে ছেলেটা শরীর মনে স্ফূর্তি ফিরে পায়।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ভিটামিন? আচ্ছা প্রেসক্রিপশনটা দিন।’
খস খস করে তিনি প্রেসক্রিপশনে কিছু লিখে ফেরত দিলেন। মাধুরী দেবী দেখলেন, প্রেসক্রিপশনের নীচে লেখা বাংলায় লেখা আছে, “সুকান্ত সমগ্র। রোজ অন্তত দুই পাতা পড়বে”।
একটু হেসে বয়স্ক ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ওর বয়সের ছেলেদের জন্য এর থেকে ভালো ভিটামিন আর হয়না।’
দারুন লেখা, অসংখ্য ধন্যবাদ, আরো এই রকম লেখা চাই
Excellent.
?