আমি খুবই ভীতু মানুষ। তাই আর বিতর্কিত বিষয়ে যাব না। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্যকর্মীদের PPE নিয়ে গলা ফাটানোর জন্য এক ডাক্তারবাবুকে পুলিশের হাতে নাকাল হতে হয়েছে। অতএব আমি PPE নিয়ে কিছু লিখবনা। আমি চিকিৎসক। চিকিৎসা করতে গিয়ে টিবি, হেপাটাইটিস, করোনা সবকিছুতেই আক্রান্ত হতে পারি। সেটা অকুপেশানাল হ্যাজার্ড। তাতে আমার তেমন আপত্তি নেই। কিন্তু পুলিশ-টুলিশ আমার তেমন সহ্য হয় না।
এমনিতেও করোনায় না মরলেও পাবলিকের হাতে মরতেই হবে। দিল্লীতে এক হাসপাতালে করোনা রোগী সাতদিন ভেণ্টিলেশনে থেকে মারা যাওয়ার পরে রোগীর তথাকথিত আত্মীয়রা এক তরুণ ডাক্তারকে উদোম পিটিয়েছে। সম্ভবত ইন্দোরে জ্বরের রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করার সময় দুজন চিকিৎসক গণপিটুনি খেয়েছেন। তার মধ্যে একজন মহিলা চিকিৎসক। আমি এখনও সেই গণপিটুনি খাওয়ার ভিডিও দেখার সাহস অর্জন করতে পারিনি।
সেসব নিয়েও কিছু লিখবনা আমি। ঐ যে বললাম, প্রশাসনকে বড়ই ভয় পাই। পুলিশের সামনে নির্ভয়ে ডাক্তারকে চড় মারা যায়। কিন্তু সেই চড় খাওয়া নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেই প্রশাসন ডাক্তারকেই ধমক লাগায়।
জানিনা আমাদের এই অশান্ত সময়ে কি করা উচিৎ। কিন্তু ঐ যে ফাইনাল ইয়ারে সকলেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলাম, একটা বস্তাপচা হাজার বছরের পুরোনো সেন্টিমেণ্টাল প্রতিজ্ঞা, ‘সবসময় রোগীর ভালোর জন্য যা করার তাই করব। কোনো ভয়, ঘৃণা, এমনকি নিজের জীবনের ঝুঁকির জন্যও রোগীর অনিষ্ট কখনও কামনা করবো না।’ সেটা যে আমার কয়েকজন ভাইবোন একেবারে আত্তীকরণ করে ফেলেছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। শুধু আমাদের দেশ নয়, চীন, ইতালি, কিউবা এমনকি আমেরিকার মতো ধনতান্ত্রিক দেশেও। সেসব নিয়েও কিছু লিখব না আমি।
বরঞ্চ আজ মিষ্টি নিয়ে লিখি। মিষ্টি নিয়ে মিষ্টি লেখায় কোনও রিস্ক নেই।
ঘোলা থেকে রোগী দেখে ফিরছিলাম। সবই জ্বরের রোগী এবং সকলেই প্রায় নিঃসন্দেহ তাঁর করোনা হয়েছে। কারো জ্বরের সাথে গলা ব্যথা। কারো বুকে সাঁই সাঁই। কারো নাক দিয়ে লবণ জল গাড়াচ্ছে। কারো আবার জ্বর জ্বর ভাব। থার্মোমিটারে স্বাভাবিক তাপমাত্রা দেখাচ্ছে। কিন্তু রোগীর দাবী তাঁর জ্বর আসছে। থার্মোমিটারের পারদে ভেজাল আছে।
এধরণের জ্বরের চিকিৎসা করাই সবচেয়ে ঝামেলার। এই জ্বরের চিকিৎসা করার জন্য আমার নিজস্ব একটি পদ্ধতি আছে। কিন্তু যেহেতু এই লেখাটা আমার অনেক রোগীই পড়বেন, এবং সেই পদ্ধতির সাথে তাঁদের চিকিৎসা পদ্ধতির মিল পেলে মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন, তাই আর বিশদে লিখলাম না।
বরঞ্চ মিষ্টির গল্পে ফেরত আসি। ঘোলা থেকে ফেরার সময় সাজিরহাট ব্রিজের কাছে একটা মিষ্টির দোকান খোলা দেখে দাঁড়ালাম। জানি আট দিনের বাসী মিষ্টি। কিন্তু মিষ্টি তো।
গুটি গুটি পায়ে দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদার আমায় ভালোমতো চেনেন। আমারই রোগী। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভালো মিষ্টি কোনটা হবে?’
উনি আমায় দেখে কেমন থতোমতো খেলেন। বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আজই আটদিন বাদে প্রথম খুললাম। আজই মিষ্টি নেবেন?’
বললাম, ‘কেন? অনেকরকম মিষ্টিই তো আছে দেখছি।’
উনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, দোকানের ভেতরে আসুন। আপনার সাথে কথা আছে।’
গেলাম ভেতরে। দু মিটার দূরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘বলুন কি কথা?’
উনি ইতস্তত করে বললেন, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, সব মিষ্টিই আগের সোমবার বানানো। শুধু কাঁচাগোল্লাটাই গরম। তবে সব ফ্রিজে ভরে রেখেছিলাম। কিন্তু প্রাণে ধরে আপনাকে বাসী মিষ্টি দিতে পারব না। আপনি আমার রোজকার খদ্দের। তার উপর আমার ডাক্তার। আজ যদি ছানা জোগাড় করতে পারি, তাহলে কাল রসগোল্লা বানাব। কাল গরম রসগোল্লা নেবেন।’
আমি ততক্ষণে মোহনভোগ, ছানার জিলাপির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আহা, কতদিনের অদর্শনের পর দেখা। বললাম, ‘বাসী হোক, ও দুটো আমায় খান দশেক করে দিন।’
দোকানদার বললেন, ‘যদি অভয় দেন একটা কথা বলি। নেওয়ার আগে আপনি টেস্ট করে নেন। ভালো থাকলে তবে নেবেন।’
মোহনভোগ খেলাম, ছানার জিলাপিও খেলাম। দিব্যি আছে। দোকনদার বললেন, ‘জলভরাটাও একটা টেস্ট করেন। এটা কড়াপাকের। নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
জলভরা খেলাম। তারপর ক্ষীরকদম্ব। তারপর কালাকাঁদ। তারপর ক্ষীরের প্যাঁড়া, আমসত্ত্বের স্যান্ডুইচ মিষ্টি, চকলেট মিষ্টি, মিহিদানার লাড্ডু। বললাম, ‘সব ঠিক আছে।’
দোকানদারকে টাকা দিলাম। কিছুতেই নিলেন না। বললেন, ‘এবার নির্ভয়ে বিক্রি করতে পারব। কেউ কিছু বললেই বলব, স্বয়ং ডাক্তারবাবু এসে আমার মিষ্টি টেস্ট করে সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন।’
যাক , মিষ্টি নিয়ে দুশ্চিন্তা কমল । সাধু সাধু……