– না গো মা, তোমার নাতির রিপোর্টটা ভালো বুঝছি না। গম্ভীরমুখে জবাব দেন ডা. ঘোষ।
– কেন গ? রিপোটে কী বলছ্যা?
– পেচ্ছাবের ইনফেকশনটা বোধহয় কিডনি অব্দি ছড়িয়ে গেছে। রক্তের রিপোর্টও বেশ খারাপ।
– তাহলে কী করব বাপু? জ্বরটাও ত আজ এক হপ্তা হল..
– চিন্তা বাড়লো গো.. তার ওপর এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসা না করে শেকড়-বাকড় খাইয়ে বেড়িয়েছো..
– কী করব বলত বাপু? সবাই য্যামন বলল..
– যাক গে, যা করেছো করেছো.. এবার চটপট এই কাগজটা দেখিয়ে ভর্তি করো। দেখা যাক কী করা যায়..
– শুন না বাপু, একটা কথা বলব?
ডা. ঘোষ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকালেন।
– ওই য্যা কী একটা করনা না কী রোগ বেরাইছ্যা, ওউ রোগটা নয় তো?
দুশ্চিন্তার মধ্যেও মৃদু হেসে ফেলেন ডা. ঘোষ। – আরে না, না। এটা তার চাইতে অনেক খারাপ রোগ। তুমি এখন এসব চিন্তা ছেড়ে আগে ভর্তি করো তো দেখি..
– আচ্ছা। যাইহ্রি বাপু। লাতিটাকে ভাল কর্যা দও দেকিনি.. কদিনে যেন একদম.. বিড়বিড় করতে করতে বুড়ি বেরিয়ে যায়।
তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে ডা. ঘোষ বললেন — কী বুঝলি? করোনার মাতামাতিতে পৃথিবীতে যে আরও এতগুলো রোগ আছে এবং তাদের মধ্যে অনেকগুলোই যে করোনার চেয়েও আরও বহুগুণ মারাত্মক লোকে সেটা ভুলেই গেছে। কালকেই রাস্তায় একজনকে বলতে শুনলাম করোনা নাকি ক্যান্সারের চেয়েও ভয়ানক রোগ।
গীতাদি স্যারের স্টেথোস্কোপ আর চেম্বারের অন্য জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছিলো। চায়ের কাপটা সরিয়ে নিতে নিতে স্যারকে বললো – তবে স্যার ওই ব্যাপারটা আপনি একদম ঠিক বলেছেন।
– কোনটা বলতো?
– করোনা এমনিতে ভীষণ খারাপ রোগ, এমনটা বলা যাবে না। তবে বয়স্ক কিংবা দুর্বল অনাক্রম্যতার রোগী, প্রেশার, সুগার, কিডনির রোগ অথবা অন্যান্য দীর্ঘকালীন রোগ থাকলে এটাই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। আর ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে যদি ২-৩% মানুষও রোগাক্রান্ত হন, তাহলেই অনেককে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। বিনা চিকিৎসায়..
– হ্যাঁ রে, ভয়টা সেখানেই। সেজন্যেই সবাইকে বারবার করে দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোওয়ার কথাগুলো বলা হচ্ছে।
– তবে স্যার যে যাই বলুক, আমাদের দেশে কেউ কোয়ারেন্টাইন মানছে না। যাকে আইসোলেশনে থাকতে বলা হচ্ছে সে দিব্যি বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
– একটু ভুল বললি..
– মোটেই না স্যার। আপনি এক্ষুনি দেখবেন চলুন..
– আরে, বাইরে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা বলি নি। ‘কোয়ারেন্টাইন’ আর ‘আইসোলেশন’ দুটোর মানে আলাদা।
আমরা এতসব জানি না। আমরা তো দুটোর মানেই লোকজনকে ‘সরিয়ে রাখা’ বলে জানি। তাই দুজনেই একসাথে চমকে উঠে বললাম,- তাই নাকি?
– হ্যাঁ, রে। যদিও টিভি বল, খবরের কাগজ বল.. সব জায়গাতেই দুটো শব্দ এক করে দিচ্ছে। ‘কোয়ারেন্টাইন’ করা হয় আপাত সুস্থ মানুষকে। যাঁর এই মুহূর্তে কোনও রোগলক্ষণ নেই কিন্তু যিনি সন্দেহজনক রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন অথবা রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে এমন জায়গা থেকে সম্প্রতি ফিরে এসেছেন। আপাত সুস্থ মানুষের শরীরেও সংক্রমণ থাকতে পারে। তাই তাঁকে বাড়িতে আলাদাভাবে থাকতে বলা হয়। অপরদিকে ‘আইসোলেশন’ করা হয় প্রমাণিত রোগীর। খেয়াল করবি, ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ করা হয় আর হাসপাতালে ‘আইসোলেশন ওয়ার্ড’ রাখা হয়।
আমরা ততক্ষণে হাঁ করে শুনছি। এতবার ব্যবহার করেছি কথাদুটো, অথচ মানেই জানি না!! ডা. ঘোষ আবার বলতে শুরু করলেন — রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বা মারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছে এমন জায়গা থেকে মানুষের সরে আসার ধারণা আজকের নয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই আদিম মানুষ এসব করে আসছে। তাই এই ধারণার নির্দিষ্ট সময়কাল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে ‘কোয়ারেন্টাইন’ কথাটির উৎপত্তি ইতালীয় শব্দ ‘কোয়ারেন্টিনা’ থেকে যার অর্থ ৪০ দিন। মধ্যযুগীয় নাবিকরা সমুদ্রাভিযান শেষে দেশে ফিরলে তাঁদের শরীর থেকে রোগজীবাণু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সমুদ্রের ধারে তাঁদের ৪০ দিন আলাদা করে রাখা হতো। যাক গে, চল.. চল অনেক জ্ঞান দিলাম। এবার উঠি। একটা বাজে। খিদে পাচ্ছে..
ডা. ঘোষ স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহার করেন না। তাই তাঁর কথাগুলো তাঁর নিজের মুখ থেকে কেউ জানতেও পারেন না। আমাকে আজ বাড়ি ফিরেই লিখে ফেলতে হবে। কথাগুলো সবার জানা দরকার।