আজ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্যানিক এটাকের রোগী দেখলাম। গতকাল ১০ নম্বর ওয়ার্ড কে পুরোপুরি আইসোলেটেড করার পর মধ্যমগ্রামের মানুষের মধ্যে ভীতি আরও বেড়েছে।
অদ্ভুত ভাবে প্যানিক এটাকের বেশির ভাগ রোগীই কম বয়সী ছেলে মেয়ে। কারো বুকে চাপ ব্যথা, বুক ধড়ফড়ানি। কারো গলা বুজে আসছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
অনেক রোগীই রোগীদের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসতে চাইছেন না। তাঁদের বসার জন্য জোর করছি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখে দিচ্ছি। দুয়েক জন রোগী বলেই ফেললেন, ‘ডাক্তার বাবু, দূর থেকেই দেখুন। ছোঁয়ার দরকার নেই।’
কয়েকজন রোগীর দাবি তাঁদের সবসময়ই জ্বর আসছে। কিন্তু বাড়ির থার্মোমিটার খারাপ থাকায় তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রী ফারেনহাইটের বেশি দেখাচ্ছে না।
এর মধ্যেই এক অবাঙালি পরিবার এলেন। এঁরা মাঝে মাঝেই আসেন। স্বামী গেঞ্জি কারখানায় কাজ করেন। স্ত্রীর গ্রেড থ্রি ম্যালনিউট্রিশানে ভোগা চেহারা। আঠাশ বছর বয়েসে ওজনও আঠাশ কেজি। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভোগায় অমন চেহারা হয়েছে।
ওনারা সঙ্গে চার বছরের মেয়েকেও নিয়ে এসেছেন। আমি বললাম, ‘একে নিয়ে এসেছেন কেন?’
পুরুষটি বললেন, ‘কার কাছে রেখে আসব ডাক্তারবাবু?’
তারপর তিনি তাঁদের দুঃখের সাত কাহন শোনালেন। গেঞ্জি কারখানার মালিক গত মাসের অর্ধেক বেতন দিয়েছেন। তাতে অবশ্য পুরুষটি বিশেষ দোষ দেখেন না। মালিকেরও আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। তার উপর চৈত্র সেলের সময় ব্যবসা ভালো হবে ভেবে ধার দেনা করে অনেক কাঁচামাল তুলেছিলেন।
মহিলা ভালো বাংলা জানেন না। তিনি এক জগাখিচুড়ি ভাষায় জানালেন গত দুই সপ্তাহ ইনসুলিন বন্ধ। এখন শরীর অত্যন্ত দুর্বল। হাঁটতে গেলে মাথা ঘুরে পরে যাচ্ছেন।
গ্লুকোমিটারের গোটা দুই স্ট্রিপ অবশিষ্ট ছিল। তাই দিয়ে সুগার মাপলাম। পাঁচশো বত্রিশ। বললাম, ‘ইনসুলিন না নিলে তুমি শিওর মারা পড়বে।’
ছোট্ট মেয়েটা মায়ের বাহু ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার ছোটো মেয়ের বয়সী। এর আগে যতবারই এঁরা এসেছেন বাচ্চাটাকে আদর করেছি। এমনই পরিস্থিতি ছোটো মেয়েটাকে আদর করাও সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিন মানুষের অসহায়তা দেখতে দেখতে আমার অনুভূতি গুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। সেই আমিও বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।
পুরুষটি বললেন, ‘ডাক্তারসাব, পনেরো তারিখে লকডাউন উঠলেই বাড়ি ফিরব। হাতে টাকা পয়সা নেই। খাওয়া জুটছে না। বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বের করে দেবে বলেছে। তার আগে যমুনাকে খাড়া করে দিন।’
একজন সহৃদয় মানুষের সাহায্যে এক ভায়াল ইনসুলিনের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু মহিলা যে ডোজে ইনসুলিন নেন, তাতে খুব বেশি দিন চলবে না।
তাতেই তাঁরা খুব খুশি। বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, যদি আচ্ছে দিন সত্যিই আসে, তাহলে আবার দেখা হবে। তখনও আমরা কেউই জানিনা লকডাউন ৩০ শে এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
যেতে যেতে মহিলাটি আবার ফিরে এলেন। আমায় অবাক করে ছেঁড়া চটের ব্যাগ থেকে একটা নতুন হেলথ ড্রিংকসের কৌটো বার করলেন। যেটার বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয় এটা খেলে বাচ্চার তিনগুণ বেশি বুদ্ধি ও শক্তি হবে।
মহিলা তাঁর বিচিত্র ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যদি এটা রোজ দু-চামচ করে মেয়েকে খাওয়াই, তাহলে মেয়ের এই মহামারীতে কিছু হবে না তো।’
আমি গালাগালি দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। কাকে গালি দেব? সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখতে চাওয়া ওই অশিক্ষিত মা-কে?
এ কদিনে বহু উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিও বহুবার জানতে চেয়েছে এই মহামারীর সময়ে কোন হেলথ ড্রিংকস, প্রোটিন পাউডার বা মাল্টি ভিটামিন খেলে ইমিউনিটি বাড়তে পারে।
তাঁদের বহু বোঝানোর চেষ্টা করেছি, ‘ওই সব ছাই পাঁশ খেয়ে ইমিউনিটি বাড়ে না। বরঞ্চ ধূমপান ছাড়ুন, দু’বেলা একটু শরীর চর্চা করুন। তাতে অনেক উপকার হবে।’
তাঁদের মুখ দেখে বুঝেছি কেউই আমার কথায় সন্তুষ্ট হননি। ডাক্তারের কথা কেউ বিশ্বাস করেন না।
এই patient দের জন্য কিছু করা যায়? আমরা যারা বাড়িতে বসে আছি এবং তেমন অসুবিধা এখনো ভোগ করিনি তারা যদি কিছুকিছু অর্থ সাহায্য করতে পারি। এরকম কিছু কি করা যেতে পারে?