লকডাউনটাও যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। এই মহামারী নিয়ে ঘর করাটাও।
একদম প্রথম দিকের যুদ্ধ যুদ্ধ মনোভাবটা উধাও হয়ে গেছে? কিসের যুদ্ধ? কার সাথে যুদ্ধ? শত্রু কি শুধু একটাই?
করোনা ছাড়া আর কোনো রোগ নেই? একটা ছেলে রোজ চেম্বারে আসছে বোনের জন্য। আঠারো উনিশ বছরের মেয়েটি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। রোজই জ্বর আসছে। চোখের পাতা টেনে দেখলাম কাগজের মতো সাদা। বেশ কয়েকদিন বকাঝকার পর রক্ত পরীক্ষা করিয়েছে। হিমোগ্লোবিন পাঁচের নীচে। টোটাল কাউন্ট অনেক বেশি। ছকে বাধা নিউট্রোফিল, লিম্ফোসাইট কাউন্ট দেখে সন্দেহ হচ্ছিল আদৌ বাদবাকি রিপোর্টটা অথেনটিক তো?
অনেক ল্যাবরেটরিই বন্ধ। এক ওষুধের দোকান থেকে রিপোর্ট করিয়েছে। আরও কিছু রিপোর্ট করা উচিৎ ছিল। করাতে পারেনি। ছেলেটি একটি শপিং মলে কাজ করে। মার্চ মাস থেকেই সেটা বন্ধ। কবে খুলবে জানে না। খুললে কাজ থাকবে কিনা তাও জানে না।
আমি বারবার বলছিলাম, রক্ত দিতে হবে। গত পরশু বারাসাতে ভর্তি করে দু-বোতল রক্ত দিয়ে এনেছে। রক্ত দেওয়ার পর থেকেই মেয়েটির দুই পা ফুলতে শুরু করেছে। বারাসাত থেকে মেয়েটিকে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজি ডিপার্টমেন্টে রেফার করেছে। প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে এনআরএস বোনকে নিয়ে যাওয়া ওর দাদার পক্ষে অসম্ভব। আমায় বারবার বলছে তিন তারিখ অবধি বোনটাকে কোনোভাবে সুস্থ রাখতে। যেন চার তারিখ আসলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
এমন অনেকেই চেম্বারে আসছেন যারা সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভর করেই এতদিন বেঁচেছিলেন। অন্যসময় তাঁদের হাতে দুটো পয়সা থাকে। কিন্তু মাস দেড়েক উপার্জনহীন হয়ে সেটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। হাসপাতালের ওষুধ ফুরানোয় আমার কাছে এসেছেন। ওষুধ লেখার সময় বারবার মনে হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধগুলির এতো দাম কেন?
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এক বৃদ্ধ প্রেসক্রিপশন নিয়ে কিছুক্ষণ বাদে ফেরত এলেন। বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আরেকটু কম দামের ওষুধ হয় না?’
কি উত্তর দেব? আমি আমার জ্ঞান মতো সবচেয়ে কম দামের ওষুধই লিখেছি। অনেকেই দেখাতে এসে দুঃখের সাতকাহন শোনাতে চাইছেন। আমি আর শুনতে চাইছি না। বলছি, ‘কি সমস্যা বলুন?’
এই প্রথম চিকিৎসক হওয়ার জন্য অসহায় বোধ করছি। মনে হচ্ছে অন্য কিছু হলে রোজ রোজ এতোগুলো বিপন্ন মানুষকে জবাবদিহি করতে হতো না।
যুবক ছেলেরা ভ্যানে করে রাস্তায় রাস্তায় সব্জি বিক্রি করতে শুরু করেছে। এতো সবজি কে কিনবে? একেকজন সাময়িক সব্জি বিক্রেতার উপার্জনে কতগুলো খালিপেটে খাবার পড়বে? কত জন স্ট্রোক, হার্টের রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবা মায়ের চিকিৎসা চলবে? একজন বৃদ্ধা আসক্ত শরীরে বেল আর কাঁঠালি কলা বিক্রি করতে এসেছিলেন। এই বৃদ্ধার বাড়িতেও কি কেউ অপেক্ষা করে আছে?
একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে নিয়ে তাঁর ছেলে বিকেলে এসেছিল। বৃদ্ধের ডানদিক তিনদিন ধরে অসাড় হয়ে গেছে। বাড়ির লোক তিনদিন ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। বৃদ্ধের প্রেশার প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। একটা সিটি স্ক্যান করতে পারলে হতো। সাগর দত্ত বা বারাসত হাসপাতালের এমারজেন্সিতে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো বিনা পয়সায় হতো। ছেলেটিও একই কথা বলল, ‘লকডাউনটা মিটুক। তারপর করাব। এ কটা দিন ওষুধপত্র দিয়ে কোনো ভাবে কাটিয়ে দিন।’
প্রেশারের ওষুধ লিখে বৃদ্ধকে বিদায় করলাম। বললাম, ‘কাউকে দিয়ে একটু ফিজিওথেরাপি করাতে পারলে ভালো হয়।’ ওনার ছেলে বলল, ‘আপনি ব্যায়াম দেখিয়ে দিন। আমিই যেটুকু পারি করাব।’
তবে মহামারীর মধ্যেও ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি ফেরত আসছে। পাড়ার বন্ধুরা আবার একজোট হয়েছে। সেই ছোটবেলার মত। সকলে চাঁদা তুলে চাল, ডাল, তেল কিনে বেছে বেছে পৌঁছে দিচ্ছে হতদরিদ্র মানুষগুলির হাতে। এই বন্ধুগুলোর জন্যই এই অকালেও বেঁচে থাকতে ভালো লাগে।
ঘোলা বাসস্ট্যান্ডে এক জায়গায় চেম্বার করতাম। আজ তার ঠিক পাশেই একজনের করোনা ধরা পড়েছে। আজ থেকে সেই চেম্বার বন্ধ। করোনা মহামারী আস্তে আস্তে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে। পরপর বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আমার ভাইয়েদের, বোনেদের করোনাতে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। আমার দ্বিতীয় বাড়ি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অবস্থা তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। করোনা আক্রান্ত চিকিৎসক ও সিস্টারের সংখ্যা রোজই সেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ডাঃ বিপ্লব কান্তি দাশগুপ্ত নামে একজন চিকিৎসক মারা গেছেন। পশ্চিমবঙ্গের করোনা যুদ্ধের প্রথম চিকিৎসক শহীদ। আমাদের এতটাই দুর্ভাগ্য, যে মানুষটি অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করলেন, রিপোর্ট পজিটিভ আসা সত্ত্বেও তিনি কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর স্বীকৃতি পেলেন না। বিশেষজ্ঞ কমিটি এখন তাঁর মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখবেন। খতিয়ে দেখা হবে তাঁর অন্য কোনো শারীরিক অসুবিধা ছিল কিনা।*
করোনাকে আর আমার বিশেষ ভয় লাগছে না। বরঞ্চ আমি ভয় পাচ্ছি ক্রমশ নিজের পরিবর্তন দেখে। এতো দারিদ্র, এতো অসহায়তা দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে আমার অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। মনখারাপের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য শামুখের মতো খোলসে গুটিয়ে যাচ্ছি। নচিকেতার ‘ও ডাক্তার’ গানের এতো প্রতিবাদ হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সেই কসাই’ই হয়ে যাব নাতো?
* ডাঃ দাশগুপ্তের মৃত্যু করোনা মৃত্যুর স্বীকৃতি পেয়েছে।