সেলিব্রিটি না হলে খবরে আসা যায় না। সারা জীবন খবর শুনেই কাটিয়ে দিতে হয়। নেতা-মন্ত্রী, ফিল্ম আর্টিস্ট, খেলোয়াড়দের বাণী সহ খবরের কাগজে পাতা জোড়া ছবি বেরোয়। আমরা মনোযোগ দিয়ে সেই খবর পড়ি।
যখন খবরের অভাব ঘটে তখন সাধারণ মানুষকেও সেলিব্রিটি করার চেষ্টা হয়। তবে তার জন্য সাধারণ মানুষদের বড় বেশি মূল্য দিতে হয়।
কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হলে সর্বভারতীয় খবর হয়। তবে তা দিন দুয়েকের জন্য।
একজন অভিনেতার আত্মহত্যার ঘটনায় ঘন্টার পর ঘন্টা টিভিতে আলোচনা চলে। সঞ্চালক নিজেই রীতিমতো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে আঠাশ জন কৃষক আত্মহত্যা করলেও তাঁদের পরিবার ছাড়া কেউই চোখের জল ফেলেন না।
তবে ইদানিং আমাদের মতো অতি সাধারণ চিকিৎসকদেরও মাঝারি মাপের সেলিব্রেটি হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সৌজন্যে করোনা মহামারী ও ফেসবুক।
লকডাউনের মরশুমে রোগীর চাপ কম থাকায় নিয়মিত ‘করোনার দিনগুলি’ লিখছিলাম। কোনো কোনো লেখা হাজারখানেক লাইক পাচ্ছিল। দুশো- তিনশো শেয়ার। ফেসবুকের ছোটখাটো সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছিলাম। সরকার হঠাৎ করে লকডাউন তুলে নেওয়ায় রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। লেখালেখি মাথায় উঠেছে।
আজ থেকে কয়েক বছর আগে হলেও পুরো বিষয়টাকে বেশ উপভোগ করতে পারতাম। ইনবক্সে অনেক অচেনা মানুষ মহামারীর সাথে লড়াইয়ের জন্য এই পাতি চিকিৎসককে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বয়সটা বছর দশেক কম হলে হয়তো এই অভিনন্দনে খুশিই হতাম।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু ঠেকে শিখেছি। সেসব প্রকাশ করে অস্বস্তির কারণ হতে চাই না। তবে প্রশংসায় যে গলে যেতে নেই, এটাই সেই শিক্ষার মধ্যে প্রধান শিক্ষা।
আর কিসের লড়াই। আমি রোগী দেখছি যথেষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে এবং পয়সার বিনিময়ে। এই লকডাউন আমার অর্থনৈতিক অবস্থার উপর আদৌ বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বরঞ্চ বহু মানুষ কোনো রকম প্রতিরক্ষা ছাড়াই সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য মহামারীর সময়েও মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন। চিরকাল সোনার কাজ করা যুবক সাইকেলে আলু, পেঁয়াজ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরি করেছেন। যিনি পাড়ায় পাড়ায় মাছ বিক্রি করছেন, তাঁর মাছ কাটার মরিয়া চেষ্টা দেখে বোঝা গেছে তিনি এ ব্যাপারে এখনো শিক্ষানবিশ।
প্রতিদিনই শূন্য দৃষ্টি নিয়ে একাধিক মানুষ বাড়ি এসে বলেছেন, ‘কোন কাজ আছে? যে কোন কাজ। যা ইচ্ছে দেবেন।’
লকডাউন ওঠার পরও মানুষের মরিয়া প্রচেষ্টা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। সাইকেলে করেই বহু মানুষ রোজ কলকাতা যাচ্ছেন। যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রতিদিন পঞ্চাশ কিলোমিটার সাইকেল চালাচ্ছেন।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের নাইট ডিউটি। নিজেকে বঞ্চিতের, হতভাগ্যের দলে মনে করে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিলাম।
মেডিসিন ওয়ার্ডে রোগী কম। এমারজেন্সিতে গিয়ে ইন্টার্নদের সাথে গল্প করছিলাম। গল্পের বিষয়বস্তু বারবার ঘুরে যাচ্ছিল ডাক্তার হওয়ার কুফলগুলির দিকে। অষ্টমীর রাত্রে কলকাতার রাস্তায় জন সমুদ্র। আর আমরা গুটিকতক লোক প্রিয়জনদের থেকে দূরে হাসপাতাল সামলাচ্ছি।
আমার দুঃখ আরও বেশি। কারণ দশমীতে রোটেশনাল এডমিশন ডে। সেদিনও হাসপাতালে কাটবে।
একজন বলল, ‘এর থেকে স্কুল শিক্ষক বা অফিসের কেরানি হলে ভালো হতো। অন্তত লাইফ বলে কিছু থাকতো।’
গল্পে গল্পে রাত দেড়টা বেজে গেছে। একটি বছর-দশেকের ছেলে এমার্জেন্সিতে ঢুকলো। সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক লোক।
মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, একে একটু দেখে দিন। গরম জল পড়ে পা পুড়ে গেছে।’
দেখলাম ডান পায়ে বড় বড় ফোস্কা। ধূলি ধূসরিত খালি পা। বললাম, ‘গরম জল পড়ল কি করে?’
‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, আমার চায়ের দোকান। ওখানে পুজোর সময়ে ভিড় সামলানোর জন্য নিয়েছি। কিন্তু এমন ক্যাবলা ছেলে জানবো কি করে?’
‘আপনি এইটুকু বাচ্চাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন?’
লোকটি বিরক্ত ভাবে বললেন, ‘করাতে চাইনি ডাক্তারবাবু। কিন্তু ওর বাপ এসে এমন ভাবে ধরলো! মুর্শিদাবাদে বাড়ি। বাপটা কলেজ স্কোয়ারের পুজোর ঢাক বাজাতে এসেছে। ছেলেকে নিয়ে এসেছে সঙ্গে। হাতে পায়ে ধরে পাঁচ দিনের জন্য দোকানে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
‘কখন পুড়েছে?’
‘হয়েছে তো সন্ধ্যায়। কিন্তু তখন এতো ভিড়, আসবো কি করে! দোকানে একটু ভিড় কমতেই নিয়ে এসেছি।’
এমার্জেন্সির আলমারি থেকে সিলভার এক্স আর একটা নরমাল স্যালাইনের বোতল বের করলাম। নিজেই ড্রেসিং করতে শুরু করলাম। কিছুটা সময় কাটবে।
ছেলেটি কাঁদছে। মধ্য বয়স্ক ব্যক্তিটি বললেন, ‘কাঁদিস নে। তোকে আমি গ্যাস বেলুন কিনে দেবো।’
এভাবে গ্যাস বেলুনের লোভ দেখিয়ে কত কান্না যে বন্ধ করা হয়েছে জানিনা। শুধু এটুকু জানি গ্যাস বেলুন সামান্য আঘাতেই ফাটতে সময় লাগে না। আর এটাও জানি আমরা ডাক্তাররাও পুরোপুরি সেলিব্রিটি না হলেও আধা সেলিব্রিটি।
তবে অধিকাংশ মানুষ যাঁরা সেলিব্রিটি নন, তাঁদের মহামারী নেই। লকডাউন নেই। পুজো নেই। মৃত্যুভয় নেই। আছে শুধু জীবন যুদ্ধ।