টিভিতে অখাদ্য সিরিয়াল দেখার সময় লোকজনের ধৈর্যের অভাব দেখা যায় না। ধৈর্যের অভাব ঘটে ডাক্তারের চেম্বারে এলেই।
রোজকার মতোই চেম্বার চলছে। বাইরে সঞ্জয়দার সাথে রোগীদের বাক্য বিনিময়ের উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমি ঘাড় গুঁজে ঝটপট রোগী দেখছি। এটাই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
একজন মহিলা মাস্ক পরে আসেন নি। সঞ্জয়দা নাক মুখ ঢাকতে বলায় ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকেছেন। সঞ্জয়দা প্রতিবাদ করায় তিনি রীতিমতো ঝগড়া শুরু করেছেন। তাঁর বক্তব্য, তার জ্বর কাশি কিছুই নেই। কোমরে ব্যথা। ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকলেই যথেষ্ট।
সঞ্জয়দা ছাড়ার পাত্র নয়। তার বক্তব্য, ‘আপনার ওই মশারীর মতো ওড়নার ফুটো দিয়ে মশাও গলে যাবে। ভাইরাস তো নাচতে নাচতে ঢুকবে।’
একটি বছর পনেরোর মেয়ে বাবা- মায়ের সাথে ঘরে ঢুকল। বাবা- মায়ের বয়স প্রায় আমারই মতো। কলম বাগিয়ে বললাম, ‘কি হয়েছে বলুন।’
মেয়েটি যেন পাকা গিন্নী। মাথার ঝুঁটি- টুটি নেড়ে বলল, ‘আর কি হয়েছে! দিয়েছে বাইকে গুঁতো।’
বুঝলাম ওর মা গুঁতোটা খেয়েছেন। কারণ তিনি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঢুকেছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কোথায় লেগেছে?’
মহিলা ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটির ঝুঁটি আবার নড়ল। বলল, ‘মাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই ডাক্তারবাবু। মা- বাবা কেউ কানেও শোনেনা। কথাও বলতে পারে না।’
তারপর মেয়েটি হাত পা নেড়ে মাকে বুঝিয়ে দিল। মহিলা কোমরে হাত দিয়ে ব্যথার ভঙ্গি করলেন।
মেয়েটি বলল, ‘মাকে এতো বলি, তবু রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটবে। গাড়ির হর্ণ শুনতে পায় না। মাঝে মাঝেই গুঁতো খায়। আগে তবু লোকজনের ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝতে পারতো। বাজার ঘাট সবই করতো। এখন সবার মুখই মাস্কে ঢাকা।’
ইতস্তত করে মাস্ক নামালাম। রোগীর সাথে সরাসরি সংযোগ না করতে পারলে রোগী দেখা মুশকিল।
মহিলার চোখ উজ্জ্বল হলো। তিনি একাগ্র ভাবে চেয়ে রইলেন আমার ঠোঁটের দিকে।
এরপর আর সমস্যা হয়নি। ওনারা দিব্যি আমার কথা বুঝতে পারলেন। আমিও বুঝতে পারলাম ওনাদের সমস্যা।
ভদ্রলোক সরকারি চাকরি করেন। বেশ কিছুদিন আগে আমাকে দেখিয়ে গেছিলেন। ডায়াবেটিস আছে। এখন ভালো আছেন।
মেয়েটি বলল, ‘বাবাকে মনে না করিয়ে দিলে ওষুধ খেতে ভুলে যায়। দুপুরের ওষুধ অফিসে থাকলে আমি ভিডিও কল করে মনে করিয়ে দিই।’
যাওয়ার সময় মেয়েটি বলল, ‘মহামারীতে মা বাবার খুব সমস্যা হচ্ছে। সকলেই মাস্ক পরে থাকায় কারো কথাই বুঝতে পারছে না। সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে বাবার অফিসে। বাবা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। এই ঝামেলা যে কবে কাটবে? আমি অনেক বোঝাচ্ছি।’
মহিলা আমার হাতে একটা চিরকুট দিলেন। “ডাক্তারবাবু, মেয়েকে আশীর্বাদ করবেন। ও যেন আপনার মতো চিকিৎসক হতে পারে।”
চিকিৎসক হওয়ার কুফল নিয়ে অনেক কিছু বলার ছিল। সেসব কিছুই বলতে পারলাম না। মাস্কটা নিচে নামিয়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই ডাক্তার হবে। অনেক বড়ো হৃদয়বান ডাক্তার।’
একটাই আক্ষেপ রইলো। ওই পাকা বুড়ির ঝুঁটিটা নেড়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছিল। করোনা ভাইরাসের ভয়ে পারলাম না। উফ- এই করোনা যে কবে বিদায় নেবে!
ভালো লাগলো লেখা টা পড়ে। যেন ওদের তিন জনকেই দেখতে পেলাম।