মনটা খিঁচড়ে ছিল। সকালে ডাঃ কৌস্তভ রায়ের ফোনটা পেয়ে ভালো হয়ে গেল।
ওনাকে কোনোদিন মুখোমুখি দেখিনি। বালিতে ওনার চেম্বারে বসে ফোন করছেন।
সাইক্রিয়াট্রির ডাক্তারবাবু। এই মহামারীর সময় দিব্যি ঘরে থাকতে পারতেন। তা না করে চেম্বার খুলে বসে আছেন। জ্বরের রোগী দেখছেন। বললেন, ‘সকাল থেকে দুজন রোগী দেখেছি। কেউই পয়সা দিতে পারেনি। এখন বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজছি।’
তারপরেই পীযূষদার ফোন পেলাম, ‘কিরে, বেঁচে আছিস? আমি এই চেম্বারে চললুম।’
বিষন্নতা পুরোপুরি কেটে গেল। আমার অনেক সিনিয়ার রা রোগী দেখে চলেছেন। অনেকেই নানা রকম স্পেশালিষ্ট। ডিগ্রী- টিগ্রী চুলোয় দিয়ে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জ্বরের রোগী দেখছেন। অথচ এ সময় একমাস বাড়িতে বসে থাকলে তাদের তেমন কোনো অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো না।
কাল থেকে বড়ো একা একা লাগছিল। দুই সিনিয়ারের সাথে কথা বলে একাকিত্ব পুরোপুরি কেটে গেল। তারপর আরও একটা ভালো করা খবর পেলাম, গত চব্বিশ ঘণ্টায় নতুন কোনো করোনার কেস ধরা পড়েনি।
মনটা যখন ভালোই হল, তখন একটা মন ভালো করা গল্পই শোনাই। গতকালই আমার অন্তিম হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতলটি শেষ হয়ে গেছে। স্যানিটাইজারের অভাবে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছি। একটা বড় বোতল স্পিরিট জোগাড় করেছি। তাই দিয়ে মাঝে মাঝে স্টেথো, বি পি মেশিনের হ্যাণ্ডেল মু্ঁছছি।
অনেক দিন বাদে স্পিরিট ব্যবহার করছি। এই জিনিসটাকে আমি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলি। কারণ আমার জীবনের প্রথম এমারজেন্সি নাইটে স্পিরিটের জন্য আমি প্রায় মরতে বসেছিলাম।
কি ভাবছেন, স্পিরিটে আগুন লেগে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল? সেসব কিছু নয়। তার থেকেও মারাত্মক। জীবনের প্রথম এমারজেন্সি নাইটেই আমি বুঝেছিলাম, ডাক্তার হওয়া মানেই রোজ আজব আজব ঘটনার সম্মুখীন হওয়া।
বরাবরই আমার উৎসাহ একটু বেশি। তার উপর সবে মাত্র ডাক্তার হয়েছি। এমারজেন্সিতে দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করছি। এই শ্বাসকষ্টের রোগীকে নেবুলাইজেশন দিচ্ছি, পরক্ষণেই পেটে ব্যথার রোগীকে ইনজেকশন দিতে ছুটছি। প্রস্রাব আটকে গেছে, আঠারো সাইজের ক্যাথেটার পরিয়ে দিচ্ছি। আটটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা অব্ধি দৌড়ে একটু নিশ্বাস ফেলার সময় পেলাম। সহযোগী কো-ইনটার্ন মেয়েটি আমার জন্য লুচি তরকারি বানিয়ে এনেছে। এর মধ্যে অনেকবার বলেছে, ‘ঐন্দ্রিল খেয়ে নে।’
খাওয়ার আগে হাত ধোয়া জরুরি। হাত ধুতে গিয়ে দেখলাম সাবান নেই। সিস্টার দিদি বললেন, ‘আগে স্পিরিট ঢেলে ভালো করে হাতের কনুই অবধি লাগিয়ে নিন। তারপর জল দিয়ে হাত ধোবেন।’ জামার দু-তিন জায়গায় রক্ত লেগে গেছিল। স্পিরিটে তুলো ভিজিয়ে সেগুলো মুছলাম। জামার নিচের দিকটা স্পিরিটে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। যাকগে, স্পিরিট উদ্বায়ী পদার্থ। কিছুক্ষণ বাদে উবে যাবে।
আমি খাওয়া শেষ করার পর সিনিয়র মেডিকেল অফিসার বললেন, ‘আমি একটু রেস্ট রুমে যাচ্ছি। খারাপ পেশেন্ট এলেই ডাক দিস।’
কো-ইনটার্ন মেয়েটি বলল, ‘আমি দশ মিনিটের মধ্যে স্বর্ণময়ীতে আমার ঘর থেকে ঘুরে আসছি। বাসন-পত্র গুলো রেখে আসি।’
আমি একা এমারজেন্সিতে। হঠাৎ একদল লোক হইহই করতে করতে ঢুকল। ‘ডাক্তার কই, ডাক্তার কোথায় গেল। শিগগিরী আসুন, খুব সিরিয়াস পেশেন্ট।’
একজন বছর পঁচিশের যুবতী ট্রলির উপর দা্ঁতে দাঁত আটকে হাত-পা টান টান করে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে চোখের পাতা কাঁপছে। আনার আগে জল চিকিৎসা চলেছে। যুবতীর জামা-কাপড় ভিজে চুপচুপে।
আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। পেশেন্ট আমার সিলেবাসের মধ্যে পরে গেছে। কনভার্সন রিয়াকশনের টিপিক্যাল কেস। সাধারণত ঝগড়াঝাটি করার মাঝখানে কমবয়সী মেয়েরা এরকম চোখ টোখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে যায়। তাকে নিয়ে আসে একদল স্বঘোষিত ঠাকুরপো। এইসব ঠাকুরপোদের মেজাজ অত্যন্ত উচ্চগ্রামে বাঁধা থাকে। আমি একটু আগেই এরকম একটি কেস দেখেছি ও নিজ হাতে চিকিৎসা করেছি। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের চাল চলনে একটুও কনফিডেন্সের অভাব দেখলেই ঠাকুরপোরা মাথায় চড়ে বসবে।
হেলতে দুলতে ট্রলির পাশে দাঁড়ালাম। প্রথমে স্টারনাম অর্থাৎ বুকের একদম উপরের হাড়ের উপর চাপ দিয়ে দেখি। না হলে এমোনিয়াম ক্লোরাইড শোঁকাব।
স্টারনামে জোরে চাপ দিতেই যুবতীটি লাফিয়ে উঠলো। আমি আবার হেলতে দুলতে চেয়ারে এসে বসলাম। বউদিকে উঠে বসতে দেখে দেওররা হতভম্ব হয়ে গেছে। একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, একটু অক্সিজেন দিলে হয় না?’
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, ‘অক্সিজেন দেওয়া যাবে না। তাহলে অক্সিজেন ওভার স্যাচুরেশন সিন্ড্রোম হয়ে যাবে।’
দেওরটি মাথা নেড়ে আবার বৌদির পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেছে। ওরা বিদায় নিচ্ছে না কেন? বউদি তার দেওরদের কিছু বলছে। তারা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে।
একজন ষণ্ডামার্কা দেওর এগিয়ে এলো। বলল, ‘ছি, ছি, আপনার লজ্জা করেনা?’
আমি অবাক ভাবে বললাম, ‘লজ্জা পাওয়ার কি আছে? এই রোগে এভাবেই… ‘
‘রাখুন মশাই। আপনি কি আদৌ ডাক্তার? মেডিকেল কলেজের এমারজেন্সিতে মদ খেয়ে ডিউটি করছেন?’
মদ? আমি আকাশ থেকে পড়লাম। লুচি তরকারি খেয়েছি। মদ আবার কোত্থেকে এল?
দেওরপো এবার সরাসরি তুইতে নেমে এলো। বলল, ‘জবা বউদি বললো তোর গা থেকে ভুর ভুর করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। শালা দুনম্বরী ডাক্তার, মদ খেয়ে তুই মেয়েছেলের গায়ে হাত দিয়েছিস। পিটিয়ে তোর ছাল ছাড়িয়ে দেব গাণ্ডু।’
চিতকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম চোখে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার উঠে এসেছেন। আমাকে প্রায় দশজন মারমুখী দেওর ঘিরে ধরেছে। তিনি পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে টাকে হাত বোলাচ্ছেন।
গোলমাল শুনে বয়স্ক সিস্টার দিদিমণি এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ‘তোমাদের মতো মাথামোটা গর্দভ খুব কমই দেখা যায়। মদ নয়রে হতভাগারা, ওটা স্পিরিটের গন্ধ। এই নে স্পিরিটের বোতল, শুঁকে দেখ।’
সেই থেকে স্পিরিট ব্যবহার করতে ভয় পেতাম। ওয়ার্ডে স্যাভলন ব্যবহার করতাম। করোনার কল্যাণে এতদিন বাদে আবার স্পিরিট ব্যবহার করছি।