মানুষের স্বভাবই হচ্ছে যে, ল্যাজে আগুন না লাগলে তার ঘুম ভাঙে না। তেহট্টে কোভিড-19 রোগী পরিবার ধরা পড়ার পরে, ভয়ে গ্রামের লোকে খাবার কিনতেও ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। অথচ দুদিন আগে দল বেঁধে বিলেত ফেরত যুবকের বাবার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে, তাস খেলেছে, অনুষ্ঠান বাড়িতে গেছে। কোনো নির্দেশ মানে নি। পায়ে হেঁটে, সাইকেল চড়ে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীন জনস্বাস্থ্যের হাল বদলে দেওয়া আশাকর্মীদের পাত্তাই দিচ্ছে না কেউ কেউ। অথচ সরকার পই পই করে বলে চলেছে যে, অন্য রাজ্য বা অন্য দেশ থেকে আসা মানুষজনকে বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। কে শোনে কার কথা! লকডাউন ভেঙে অকারণে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো বাইক আরোহী যুবকদের বাধা দিয়ে অনেক সুনাগরিকই চুড়ান্ত হেনস্থার শিকার হচ্ছেন।
এই যে গণ পি-পু-ফি-শু আচরণ, উন্নতদেশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকরাও এতে আক্রান্ত। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন এই নভেল করোনা আফ্রিকার ইবোলা অথবা মধ্যপ্রাচ্যের মার্স-এর মত তৃতীয় বিশ্বের দেশেই আটকে থেকে খেল দেখাবে। গরীব দেশের মানুষ কয়েকটা মরবে না হয়! নভেল করোনা ভাইরাস-এর ‘এস’ প্রোটিন যে তাঁদের অভিজাত শরীরের কোষে কোষেও গেঁথে বসে যেতে পারে, দূরাগত কল্পনাতেও একথা তাঁদের মনে আসেনি।
বৌ-এর করোনা না হলে কি জাস্টিন ত্রুদোঁ এত তাড়াতাড়ি কানাডার বর্ডার ক্লোজ করে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে 20 বিলিয়ন ডলারের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতেন! তা সে যতই টরন্টো, ভ্যাঙ্কুভারে রোগটা ছড়াক না কেন!
সিয়াটেলে বৃদ্ধাবাসে, ক্যালিফোর্নিয়ার বিলাসী ক্রুজ জাহাজে করোনা ছেয়ে গেছে এক মাস আগেই। সেন্ট কীটস্ ইত্যাদি দুর্নীতি-গ্যাদগেদে দেশে রেজিস্ট্রি করা ক্রুজ জাহাজের মুনাফাখোর মালিকরা দিনের পর দিন বিজ্ঞাপন দিয়ে গেছে, ‘জাহাজে চড়ে গরম ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে যান, করোনা থেকে বাঁচুন।’ বোকা ধনী লোকেরা তাই বিশ্বাস করেছে আর জাহাজ জুড়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।
বৃদ্ধেরা পটাপট মরেছে, ট্রাম্পের তাতে ঘুম ভাঙে নি। তিনি তো চুয়াত্তর বছরের যুবক! তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসা ও পরের ভোট নিয়ে বেশী চিন্তিত। তাই এই মহামারীর বাজারেও তিনি এগারো হাজার কিলোমিটার উজিয়ে আহমেদাবাদে সার্কাস করতে চলে এলেন। নিউইয়র্ক শ্মশান হতে চলেছে, আর তিনি এখনো উল্টোপাল্টা ভুলভাল বকে চলেছেন। তাঁর কাট আউটে কেক খাওয়ানো ভারতীয় ভক্তকুলকেও বলিহারি, কোলের কাছের শত্রুদেশে মহামারী ছড়াচ্ছে দেখেও সাবধান না হয়ে ট্রাম্পের সার্কাসে নাচতে গেছিলেন! প্রতিবেশীর খড়ের গাদায় আগুন লাগলে আমার ঘরও যে পুড়তে পারে, তা বুঝতে আমাদের যথেষ্ট দেরী হয়েছে। তবে বিলম্বে বোধদয় হলেও মন্দের ভালো।
আর ওদিকে রাজপুত্র ও প্রধানমন্ত্রীর নিজের করোনা না হওয়া অবধি ইংল্যান্ডের টনক নড়েনি। চ্যানেলের ওপারে ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন নাকানিচোবানি খাওয়ার পরেও ইংল্যান্ড হার্ড ইমিউনিটি-র উদ্ভট তত্ত্ব গিলিয়ে গেছে দেশবাসীকে। এখন তারা নিজেরাই খাদের কিনারে, দেশ শাসন করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে দেশে, বিশেষতঃ কলকাতায় ভাইরাস রপ্তানি করেছেন তাঁরা। ইংল্যান্ড থেকে যে-ই আসছে, তারই করোনা ধরা পড়ছে- এত ছড়িয়েছে ওদেশে !
চীন গুগলি ছেড়েছে, আর বিশ্বনেতারা প্যাড-হেলমেট পরতেই ভুলে গেছেন। চীনের উপর তাঁদের এত নির্ভরতা! তাঁদের মূর্খামির জন্য বিশ্ব হারিয়েছে ডাঃ জন মারে-র মতো বিশ্ববরেণ্য বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ ও অসংখ্য অসমসাহসী স্বল্পনামা চিকিৎসাকর্মীকে। আরো কতজন এর বলি হতে চলেছে কে জানে! সময়ই বলতে পারবে।
( উপরের ছবিটি প্রফেসর ডাঃ জন এফ. মারে-র, যিনি ‘মারে স্কোরিং পদ্ধতি’-এর আবিষ্কর্তা। যে পদ্ধতি কোভিড-19 ও অন্যান্য নিউমোনিয়ার চিকিৎসাতেই কাজে লাগে।)