যে ভাবে রাত কাটছে
গীতায় আছে ‘ফলের আশা না করে কর্ম করে যাও’। আমরা তুচ্ছ খুপরিজীবি ডাক্তার। এইসব মহান বাণীকে আত্তিকরণ করতে পারিনি। কর্মের ফলাফল মনোমত না হলে মেজাজ খিঁচরে যায়।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সুনামি হয়ে যাওয়ার পর সারা দিনে রোগী দেখছি প্রচুর। তাতে সমস্যা নেই। একদা সরকারি চাকরি করার সুবাদে আমি প্রচুর রোগী দেখেই অভ্যস্ত। অধিকাংশই জ্বরের রোগী। তাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে রোগীরা অনেকসময়ই আমার প্রত্যাশা মতো ভালো হয়ে উঠছেন না। প্রতিদিনই দু-চারজন হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। আরো মুশকিল হচ্ছে তাঁরা যখন জিজ্ঞাস করছেন, ‘কী করব? কোন হাসপাতালে ভর্তি হব?’ তার কোনো সদুত্তর দিতে পারছি না।
করোনার রিপোর্ট করাতে দেরী হচ্ছে। রিপোর্ট আসতেও দেরী হচ্ছে। রোগী খারাপ হলে ভর্তি হতে দেরী হচ্ছে। এক চক্রব্যূহের মধ্যে পরে ছটফট করছি। বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই। সাড়ে নটা- দশটা থেকে শুরু হয় ফোন পর্ব। সেও শেষ হতে হতে রাত সাড়ে এগারোটা।
একমাত্র ঘুমের সময়টুকুই শান্তি। সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা অবধি রোগীর চাপে যা যা করে উঠতে পারিনি, সে সবই স্বপ্নে করার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশীরভাগ রাত্রেই সেটুকুও হয়ে ওঠে না।
গতরাতে যখন শুলাম তখন রাত বারোটা। পরেরদিন সাতটা থেকে দোহাড়িয়ায় চেম্বার আছে। ভোর ভোর উঠতে হবে। স্ত্রীর বিএসসি নার্সিংয়ের ফাইনাল পরীক্ষা কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই সে আলাদা ঘরে রাত জেগে পড়ে। মানে ঘুমে ঢোলে আর পড়ার চেষ্টা করে। আমি দুই মেয়েকে নিয়ে শুই।
ছোটো মেয়েকে ভয়ংকর ভুতুড়ে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ালাম। তারপর আমিও ঘুমের জগতে একটু একটু করে প্রবেশ করছি, তক্ষুনি ‘টিং টং’- কলিংবেল বেজে উঠল।
নিশির প্রথম ডাকেই যেমন সাড়া দিতে নেই, তেমনি ডাক্তারদের মাঝরাতের কলিংবেলের প্রথম আওয়াজে সাড়া দিতে নেই। মটকা মেরে পড়ে রইলাম।
কিন্তু ওপারের মানুষটির ভীষণ তাড়া। তিনি এবার সুইচ চেপেই আছেন, ছাড়ছেন না। এখনই দুই মেয়ে উঠে পড়বে। এমনকি যা আওয়াজ হচ্ছে গোটা পাড়ার মানুষও উঠে যেতে পারে।
দরজা খুলে দোতালার বারান্দা থেকে উঁকি মারলাম। গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘কী হয়েছে?’
‘ডাক্তারবাবু, শিগগিরী দেখুন না, খিঁচুনি হচ্ছে।’
বোঝো কাণ্ড। এই মাঝ রাতে খিঁচুনি রোগী নিয়ে আমি কী করব? ওপর থেকেই বলে দেওয়া যায় তাড়াতাড়ি হাসপাতালের এমারজেন্সিতে নিয়ে যান। সেটা খারাপ দেখায়। একবার নিজের চোখে রোগীকে দেখে বলি। নইলে এনারাই একটু বাদে বলবেন, ‘হারামজাদা ডাক্তার রোগীকে না দেখেই হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল।’
নীচে নামলাম। দরজা খুললাম। এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। খিঁচুনি হওয়ার মতো কাউকে চোখে পড়ছে না। বললাম, ‘রোগী কই?’
ভদ্রমহিলা কোল থেকে একটি বছর দেড়েকের বাচ্চাকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিলেন। বললেন, ‘কাল থেকে জ্বর হচ্ছিল। একটু আগে চোখ টোখ কেমন দাঁড়িয়ে গেছিল। খিঁচুনি হচ্ছিল।’
ফেব্রাইল কনভালশানের কেস। কিন্তু বাচ্চা রোগী দেখলেই আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে হাসপাতালে পাঠালাম।
হাতটাত ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে আবার শুয়েছি, চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। রাত দেড়টা বাজে। আর সাড়ে চারঘন্টা মতো ঘুমানোর সুযোগ আছে। এই ঘুমটুকু না হলে কাল পনেরো ঘণ্টা রোগী দেখতে দেখতে বারে বারে হাই উঠবে।
ভাগ্য খারাপ। আবার আমাকে চমকে দিয়ে কলিং বেল বেজে উঠল। বারান্দা থেকে উঁকি মারলাম। ‘কী হয়েছে?’
‘মরে যাচ্ছি ডাক্তারবাবু?’
‘কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলুন।’
‘খুব হাঁটু ব্যথা হচ্ছে।’
‘আপনি হাঁটু ব্যথার জন্য এই মাঝ রাত্রে আমার ঘুম নষ্ট করছেন?’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
‘আপনি বুঝতে পারছেন না। ভয়ংকর হাঁটু ব্যথা হচ্ছে। ব্যথার চোটে ঘুমাতে পারছি না। মনে হচ্ছে মরে যাব।’
আমার মাথা গরম হচ্ছে। বললাম, ‘হাঁটু ব্যথায় কেউ মরে না। এখন দেখাতে হলে হাসপাতালের এমারজেন্সিতে যান।’
‘হাসপাতালে যেতে চাচ্ছি না। ওখানে তো শুনছি করোনা রোগীতে ভর্তি।’
‘মাঝরাতে হাঁটুব্যথার রোগী আমি দেখব না। দয়া করে আর কলিং বেল বাজাবেন না।’
জল টল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। ভদ্রলোক এখন নির্ঘাৎ আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন। সেসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু মনোমতো স্বপ্ন দেখতে পারছিলাম না। সারাদিন রোগী দেখে দেখে স্বপ্নেও সেই রোগীরাই আসছেন।
স্বপ্নেই এক রোগী দেখছিলাম, স্যাচুরেশন ৮০%। বললাম, ‘ভর্তি না করে বাড়িতে রেখেছেন কেন?’
বাড়ির লোক বললেন, ‘সরকারি হেল্প লাইনে ফোন করেছিলাম। বলেছে আমার রোগী ওয়েটিং লিস্টে ৫০১ নম্বরে আছে।’
স্বপ্ন বলেই চমকালাম না। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। কলিংবেল আরেকবার বেজে উঠতেই বুঝতে পারলাম ওটার আওয়াজেই ঘুম ভেঙেছে। একবার তাও সহ্য করা যায়। তা বলে এক রাত্রে তিন তিনবার!
বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখলাম বাড়ির সামনে একটা এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। একজন কমবয়সী ছেলে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, একবার নীচে আসবেন?’
নীচে গিয়ে বুঝলাম পরিস্থিতি গুরুতর। এক বয়স্ক মানুষকে তিনদিন আগে আমার কাছে আনা হয়েছিল। ভদ্রলোকের স্ট্রোক হয়েছিল। প্রেশারও অনেক বেশি ছিল। আমি প্রেশারের ওষুধ দিয়ে বলেছিলাম সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করতে। ওনার বাড়ির লোক করোনার ভয়ে ওনাকে বাড়িতেই রেখে দিয়েছিলেন। আজ রাতে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। কিন্তু হাসপাতালে যখন পৌঁছেছেন, তার আগেই উনি মারা গেছেন। ওখান থেকে সরাসরি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন। এখন আমি যদি ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখে দিই।
ভদ্রলোককে আমি চিনি। পাশের পাড়ায় থাকেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওনার বাড়ির লোককে বললাম, ‘এখন চারটে বাজে। আপনি সাড়ে সাতটা নাগাদ ওনার আধার কার্ড আর আমার প্রেসক্রিপশন নিয়ে দোহাড়িয়ার এই চেম্বারে চলে আসুন।’ ঠিকানাটা ভালো করে বুঝিয়ে বললাম।
আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছি, হঠাৎ পাঁজরের কাছে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথায় ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল। ছোটো মেয়ে রাণী ডাকছে, ‘বাবা, ও বাবা…’
‘কী হল?’
‘বাবা, হিসু করব।’
‘করে আয়।’
‘লাইট জ্বেলে দাও। আমি তো ছোটো, হাত পাই না। তুমি বাইরে দাঁড়াবে। বাথরুমে আরশোলা আছে, ভূত আছে। আমার ভয় করে। ও বাবা কী হল? আমার কিন্তু বিছানায় হয়ে যাবে।’
অগত্যা উঠে পড়লাম। বাইরে আলো ফুটে গেছে। পাখি ডাকাডাকি করছে। আর শোয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। একটা বড়সড় হাই তুলে দিনের শুভসূচনা করলাম।