মন ভালো করার গল্প
প্রায় সব রোগীই পজিটিভ। কিন্তু এতো পজিটিভ রোগীর মধ্যে বসেও নিজে পজিটিভ থাকতে পারছিলাম না। দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিন যত গড়াচ্ছে, তত মুড়ির মতো মিইয়ে যাচ্ছিলাম। রোগী দেখতে হয় বলে দেখছি, কিন্তু আনন্দ পাচ্ছি না। লেখালিখির ইচ্ছেটাও চলে গেছে। একটু যে ভাবনা চিন্তা করে লিখব, সে সময়টুকুও পাচ্ছি না। রাত সাড়ে ন’টা, দশটা নাগাদ রোগী দেখা শেষ করে ফোন খোলা মাত্র ফোন। একটা ফোনে দুমিনিট কথা বলতে বলতে তিনটে মিসকল। শ’খানেক ফোন ধরে স্নান করতে করতে রাত বারোটা বাজছে।
এর মধ্যে কারা আবার ফেসবুকে ভারতীয় সেনাদের সাথে চিকিৎসকদের তুলনা করে একটা পোস্ট করেছে। সেই পোস্ট একেবারে শেয়ারিং লাইক হট কচুরিজ। সেসব দেখে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। সেনারা যে কাজ করেন একজন চিকিৎসক হাজার চেষ্টা করেও করে উঠতে পারবেন না। আমার হাতে একটা বন্দুক ধরিয়ে দিলে আর সামনে পৃথিবীর পাঁচজন কুখ্যাত অপরাধীকে দাঁড় করিয়ে দিলে একজনকেও গুলি করে মারতে পারব না। বরঞ্চ তারা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাণে বাঁচিয়ে পৃথিবীর ক্ষতি সাধন করতে পারি।
মোদ্দা কথা চল্লিশ ওয়াটের ফিলামেন্টের বাল্বের মতো টিম টিম করে জ্বলছিলাম। অনেক দিন ধরে একনাগাড়ে জ্বলে আছি। যেকোনো সময়ে কেটে যেতে পারি।
তবে রাত সাড়ে দশটায় একটা মাত্র ফোন সমস্ত পরিস্থিতিটাকে পাল্টে দিল। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ এক ডাক্তারদাদার ফোন। -হ্যালো, ঐন্দ্রিল, গুরু… কেমন আছো?
এই ডাক্তার ভদ্রলোককে আমি হেব্বি হিংসে করি। লোকটা সারাদিন রোগী দেখার নামে বাইকে ঘুরে বেড়ায় আর ফেসবুকে দারুণ দারুণ ছবি দেয়। আমি ছোট্ট খুপরিতে বসে সেসব ছবিতে দুঃখের ইমোজি দিই।
বললাম, -আর যা আছি। সব পজিটিভ লোকজনের মাঝখানে একমাত্র নেগেটিভ ব্যক্তি। ভাবছি এবার তোমার শরণাপন্ন হবো।
দাদা সাইক্রিয়াট্রিস্ট। ডিপ্রেশনে থাকা মানুষজনকে দিব্যি সুস্থ করে দেয়। দাদা বলল, ‘লাভ নেই। আমি আমার স্পেশালাইজেশন পাল্টে ফেলেছি। আমি এখন করোনার ডাক্তার। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে করোনা রোগী দেখে বেড়াচ্ছি।’
বললাম, ‘যাহ্, তুমি আবার স্পেশালাইজেশন পাল্টালে কেনো। এখন তো সাইক্রিয়াট্রির ভালো রমরমা। প্যানিক ডিজওর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিউওর্ডার, ডিপ্রেশনের রোগীদের ছড়াছড়ি।’
দাদা বলল, ‘এই তোরা এতো বদনাম করতিস, বলতিস পাগলের ডাক্তার।’
-বদনাম কবে করলুম?
-সজ্ঞানে না হলেও মনে মনে নির্ঘাত করেছিস। আমার টেলিপ্যাথির জোর আছে, লোকজনের মনের কথা টের পেয়ে যাই।
-আমি মধ্যমগ্রামে আর তুমি বেলুড়ে। তোমার টেলিপ্যাথি কী ফাইভ জি নাকি?
-মনের মিল থাকলে ফোর জি- ফাইভ জি কিচ্ছু লাগেনা বৎস। বহু দূরে বসেই মনের মানুষের চিন্তা ভাবনা টের পাওয়া যায়।
-বাবারে, বিলেত ফেরত ডাক্তার শেষে বাংলা সিনেমা দেখছে নাকি?
-শোনো ভাই, বেশি কথা বলা যাবে না। দু একটা কাজের কথা সেরে নি। রোগীর বাড়িতে রয়েছি। যাকে দেখতে এসেছি এতক্ষণ ধরে ফোনে কথা বললে অসন্তুষ্ট হবেন। আমি না হয় ডাক্তার। ডিনার রাত দেড়টায় করলেও চলে। কিন্তু এনারা তো ডাক্তার নন।
-এখনও রোগীর বাড়িতে?
-চমকানোর কী আছে। আজ তো তাও তাড়াতাড়ি শেষ হবে। এটাই শেষ রোগী। কাল রাত দেড়টায় বাড়ি ফিরেছি। কাল সারা দিনে ৫২টি হোম কলে রোগী দেখেছি। সব করোনা রোগী। মোট ১৭৪ কিলোমিটার বাইক চালিয়েছি।
-সব্বনাশ, এজন্য লোকজন ডাক্তারদের গালি দেয়!
-আর বৎস নিজে যখন খুপরিতে একশো পেশেন্ট দেখো, তখন খেয়াল থাকে না। বুঝলি, আজ একজনের মুখাগ্নিও করলাম। ভদ্রলোকের দুই মেয়ে। একটু দূরে থাকে। লকডাউনের অজুহাতে কেউ এলো না। বলল, আমরা আসতে পারব না, আপনারা যা পারেন, করেন। যেন বাপটা আমার। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে ভদ্রলোককে পুড়িয়ে এলাম।
-গুরুদেব, তোমার খুরে খুরে প্রণাম।
-কীসব অভিজ্ঞতা হচ্ছে। মাঝরাতে এক ভদ্রলোক ফোন করেছেন। ঘুম চোখে ফোন ধরে বললাম, ডাক্তারবাবু মারা গেছেন। আমি ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলছি। ভদ্রলোক বিশ্বাসই করতে চান না। বলছেন, পরশুদিনই দেখলাম, ডাক্তারবাবু বাইক চালিয়ে যাচ্ছেন। বললাম, ঐদিন রাতেই হার্টফেল করে মারা গেছেন। ভদ্রলোক বললেন, যা কী হবে? আমার বাড়িতে একজন করোনা রোগী আছে। অবস্থা সুবিধার না। ডাক্তারবাবুকে দেখাবো ভাবছিলাম। বললাম, তাহলে প্ল্যানচেট করে ডাক্তারবাবুর প্রেতাত্মাকে ডাকুন। সবে মরেছেন তো, একটু ডাকাডাকি করলেই চলে আসবেন।
ডাক্তারদাদার সাথে কথা বলার পর হতাশা পুরোটাই কেটে গেলো। একজন মানসিক রোগের ডাক্তার, যিনি দিব্যি এই সময়টা নিরাপদে কাটিয়ে দিতে পারতেন, তিনি স্বেচ্ছায় সারাদিন ঘুরে ঘুরে করোনা রোগীদের বাড়ী গিয়ে দেখে আসছেন। সেই তুলনায় আমার কাজ তো নস্যি।
তবে শুধু চিকিৎসকরাই নন, বহু সাধারণ মানুষ মাঝে মাঝেই অসাধারণ কাজ করে ফেলছেন। এক মহিলা বাড়ি বাড়ি বাসন মাজা, ঘর মোছার কাজ করেন। আমাদের পাড়াতেও এক বাড়ি কাজ করেন। আমি ওনার মুখটা চিনি। এক বয়স্ক মহিলাকে ধরে ধরে খুপরিতে ঢোকালেন।
জিজ্ঞাসা করলাম,’তোমার মা?’
উনি বললেন, ‘না, খালপাড়ে আমাদের পাশেই থাকে। ভিক্ষা করে খায়। সাতকুলে কেউ নেই। দুই দিন ধরে জ্বরে ঘরে পরে রয়েছে। দুমুঠো ফুটিয়ে খাওয়ারও ক্ষমতা নাই। তুমি বলো ডাক্তারবাবু, একটা মানুষকে চোখের সামনে না খেয়ে, বিনে চিকিচ্ছেয় মরতে দেওয়া যায়?’
ঘাড় নাড়লাম, একদম যায় না। আর এনাদের মতো বহু মানুষ আছেন বলেই এ যাত্রা মহামারীতে আরো অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচবে।
ডাক্তারদাদা আর ওই মহিলা কারোরই নাম লিখলাম না। দাদার ফুটেজ খেতে ভয়ানক অপছন্দ। আর ঐ মহিলার লকডাউনে এমনিতেই একটা কাজ চলে গেছে। পরোপকারী কাজের মাসি অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে।
মোদ্দা কথা হলো হতাশা ক্লান্তি এরাও বেশিক্ষণ সুবিধা করতে পারছে না। আশেপাশের কিছু মানুষ এমন সব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন, ঠিক পজিটিভ হয়ে যাচ্ছি।