ভ্যাকসিন
করোনা রোগী বেশ কমে এসেছিল। গণপরিবহনের অভাবে লোকজন টেম্পোয় গাদাগাদি করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যাচ্ছিলেন। কম বয়সী ছেলেমেয়েরা পার্কে দুষ্টুমিও শুরু করেছিল। চারিদিকে টুকটাক ডাক্তার পেটানোও শুরু হয়ে গেছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছিল।
ভেবেছিলাম দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিনগুলো আর লিখব না। এমনিতেই দু-একজন মৃদু অভিযোগ করেছিলেন ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যেভাবেই হোক এই লেখাগুলো পড়ে কিছু মানুষ ভয় পাচ্ছেন।
লিখতামও না, যদিনা আজ এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস না করতেন, ‘আমি লোহার খাটের শুই। আমি কি ভ্যাকসিন নিতে পারব? ভ্যাকসিন নিয়ে ওই খাটে শুতে পারব?’
ভ্যাকসিন নিতে পারবেন কি না বহু লোকই জানতে চান। কিন্তু ভ্যাকসিন নিয়ে কোথায় শোবেন কেউ আজ পর্যন্ত জানতে চাননি।
আমাকে অবাক ভাবে তাকাতে দেখে সান্ত্বনা দিয়ে উনি বললেন, ‘আমি অবশ্য বেশ মোটা তোষক পেতে শুই।’
আরো ঘেঁটে গেলাম। উনি তখনও বলে চলেছেন, ‘তোষক ঠিক কতোটা মোটা হলে খাটের সাথে আমার আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই? মানে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে আমার শরীরে যদি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়?’
এবারে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো। বললাম, ‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
ভদ্রলোক মনোক্ষুণ্ণ হলেন। বললেন, ‘কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি সহ বিশাল খবর বেড়িয়েছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে হাতা, খুন্তি, চামচ, পয়সা সব গায়ে আটকে যাচ্ছে।’
কী আর বলব। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি স্কুলে গেছেন? নাইন টেনে শরীর বিজ্ঞান পড়েছেন? হৃদপিণ্ড, যকৃত, বৃক্ক, শিরা, ধমনী, রক্ত? সেসময় তো মহামারির জন্য বছরের পর বছর স্কুল বন্ধ থাকেনি।’
ভদ্রলোক অত্যন্ত আহত ভাবে বললেন, ‘আমি বিএ পাশ।’
কথা বাড়ালাম না। এরকম বিএ পাশ রোগী আমার বেশ কয়েকজন আছেন। তার মধ্যে একজন স্বনামধন্য জ্যোতিষী। আজ বহরমপুর তো কাল শিলিগুড়িতে চেম্বার। দেখাতে এলেই বলেন, ‘আজ রাত বারোটায় অমুক বাংলা চ্যানেলে আমার একটা পোগ্রাম আছে, বিজ্ঞান সম্মত কোষ্ঠী বিচার নিয়ে। পারলে দেখবেন।’
বললাম, ‘বাড়িতে একটা টিভি আছে বটে, কিন্তু সেটা বাবার ঘরে। আমার দুই মেয়ে মাঝে মধ্যে লুকিয়ে কার্টুন দেখতে গিয়ে ধরা পরে। বাবা তখন কার্টুন দেখার অপকারিতা নিয়ে বিশাল লেকচার দেয়। ওই ঘরে গিয়ে রাত বারোটায় বিজ্ঞানসম্মত কোষ্ঠীবিচার দেখলে বাবা মাঝ রাতেই আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেবে।’
জ্যোতিষী ভদ্রলোক রোগী হিসেবে মোটেও ভালো নন। মাঝেমাঝেই প্রেশার সুগারের ওষুধ বন্ধ করে দেন ও একেকটা ঝামেলা বাধিয়ে আসেন।
এতোদিন ছোটো খাটো ঝামেলা হতো। পায়ে ফোঁড়া বা মেন ইয়েতে চুলকানি। সপ্তাহ দুয়েক আগে স্ট্রোক হয়েছে। প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাঁ দিকটা দূর্বল। বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আগেই বুঝতে পেরেছিলাম বিপদ ঘটতে চলেছে। গোমেদটা ধারণ করা উচিৎ ছিল। আমার গণণা যে এতটা অভ্রান্ত বুঝিনি।’
যাকগে, ভ্যাকসিনের প্রসঙ্গে ফেরত আসি। আপাতত করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে সকলের অসংখ্য প্রশ্ন। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় আমাদের এলাকার অর্ধেক লোকের করোনা হয়ে গেছে। কেউ পরীক্ষা করেছেন, কেউ পরীক্ষা করেননি। তবে পরীক্ষা না করলেও দিব্যি বুঝেছেন করোনাই হয়েছে। জ্বর কাশির সাথে স্বাদ গন্ধ চলে গেছিল। করোনা চিকিৎসার প্রটোকলে যা ওষুধ পত্র আছে সেগুলোই খেয়েছেন। কিন্তু পরীক্ষা করেন নি।
এখন তাঁদের প্রশ্ন, ‘আমরা কি ভ্যাকসিন নিতে পারব। সরকার বলছে করোনা সেরে যাওয়ার ৩ মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে না।’
যাঁরা গাইডলাইন বানান, তাঁরা তো গাইডলাইন বাজারে ছেড়েই খালাস, আমরা পরেছি মুশকিলে।
হাজার হাজার প্রশ্ন।
হার্টের অসুখ আছে, ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে?
ডাস্ট অ্যালার্জি আছে, ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে?
চিংড়ি মাছে অ্যালার্জি আছে, ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে?
একজিমা আছে, ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে?
প্রেশার সুগার আছে, ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে?
থাইরয়েডের সমস্যা আছে, ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে?
ফ্যাটি লিভার আছে, ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে?
অ্যানিমিয়া আছে, ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে?
উত্তর দিতে দিতে খুপরিজীবি ডাক্তারের নিজের খুপরিই খারাপ হওয়ার অবস্থা। সকলেই একই উত্তর দিচ্ছি, ‘এই সমস্যাগুলো আছে বলেই আপনার আরো ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ। বস্তুত প্রথম যখন ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছিল, ৪৫ বছরের উপরে যাঁদের এসব সমস্যা ছিল তাঁদেরই শুধু ভ্যাকসিন দেওয়া হতো।
আর করোনা হতচ্ছাড়াও তেমন। বেশ কমছিল, একটা জায়গায় এসে আটকে গেছে। গত সপ্তাহ দুয়েক ধরে সাতটা- আটটা কেস রোজই পাচ্ছি। বাড়ছেও না, কমছেও না। এরকম কদিন চললেই তো তৃতীয় ঢেউ আসার সময় হয়ে যাবে।