লোকটার বয়েস বড়জোর ষাট। ন্যুব্জ শরীর আর ঝুঁকে আসা শিরদাঁড়া দেখে মনে হয় আশি। সে মাস তিনেক আগের কথা। আউটডোরের উপচে পড়া ভীড় এ একমিনিটের দেখা সাক্ষাৎ। খচ খচ করে লেখা পাঁচ লাইন ইনভেস্টিগেশনের লিস্ট দেখে ফ্যাল ফ্যাল চাউনিটুকু মনে আছে। এত্তসব করতে হইবো ডাক্তারবাবু?
না করতে পারলে একবার জহরলাল যেতে হবে। সেখানে তো ফ্রী এসব।
আমি কি কইরা যামু! আমি কি চিন্তে পারুম?
সাথে একটা নাতনীরর বয়েসি মে। বড়োজোর ১৭/১৮।
এ কে হয়? নাতনী?
লোকটা সলজ্জ তাকায়। আমার মাইয়া।
আর কেউ নেই? ছেলে পুলে? তাদের নিয়ে যাবে। কল্যানী আর কতটুকু দূর!
আচ্ছা দেখি।
তারপর আর দেখা হয়নি। স্রোতের মত আসা অসুখের ভিড়ে হারিয়ে গেছিলো নিতাই বিশ্বাস।
দেখা হল আবার দিন পনের আগে। চেম্বারে বসে আছি। বাড়িতে যাবার কল এল। একটু দূরে।
সাধারণত বাড়ি যেতে চাইনা। কিন্তু মেযেটাকে দেখে মায়া হল। বল্লাম চলো। কিসের রুগী?
আপনারই পেসেন্ট ডাক্তারবাবু, খুব হাঁপাচ্ছে।
তো গিয়ে দেখি নিতাই বিশ্বাস। বিছানার সাথে প্রায় লেপ্টে আছে। একে ভর্তি করেন নি কেনো!!
চৌকির এক কোনায় দাড়িয়ে থেকে নিঃশ্চুপ তাকিয়ে ছিল মেয়েটি।
হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে এনেছি কালকে।
সেকি? কেনও!!
রিস্ক বন্ডে ছাড়িয়ে আনা কাগজে লেখা সিওপিডি, হাইপারটেনশন, টাইপ টু ডাইবেটিস। খচ খচ ওষুধ । ইনহেলার।
ছোট চৌকির এক কোণে বিছানাটা উল্টে রাখা। সেখানে ডাই করা ওষুধ।
চটপট নেবুলাইযের ব্যবস্থা করা গেল। রেফার লিখে বাইরে বেরিয়ে দেখি, দুচারটে প্রতিবেশী গোছের লোক।
তাদেরকেই পাকরাও করে বল্লাম শিগগির ভর্তি করুন। নাহলে বাঁচানো মুশকিল। তখনই গল্পটা পুরোপুরি শুনলাম। নিতাই বিশ্বাস কয়েকবছর হল এসেছে এদেশে। স্ত্রী গত হয়েছেন আর বছর। মা মরা মেয়েটির পক্ষে একা একা হাসপাতাল বাড়ি এসব খুব চাপের। বাধ্য হয়েই তাই ছুটি করানো।
না। নিতাই বিশ্বাস বাঁচে নি। ভোর রাতে আবার ডাক পড়েছিল আমার। সিপিয়ার দিতে দিতে নিষ্ফল শরীরটা আর সাড়া দেয় নি। থেমে গেছিল চিরনিদ্রায়।
মৃত্যুর খবরটুকু শেষমেষ আমাদেরকেই দিতে হয়। খুব স্পষ্ট যে মৃত্যু সেটা বলতেও অনেক সময় কেঁপে ওঠে বুক। তক্তাপোষের কোনায় দাঁড়িয়ে সীমান্তের এপারে নিঃশেষ হয়ে আসা শেষ প্ৰিয়জনের মৃত্যু যে প্রত্যাশিত সে নিশ্চয়ই জানত মেয়েটিও। তবুও তার নির্বাক একাকীত্বের সামনে দাড়িয়ে ঘোষণাটুকু করতেও ভয়ে শব্দহীন হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই বিধ্বস্ত বিছানা থেকে বাইরে চলে আসি। বাইরে তখন ভোর। দু একটা প্রতিবেশী ভিড়।
নিতাই বিশ্বাসের ডেথ সার্টিফিকেটে লিখেছিলাম রেসপিরেটরি ফেইলিওর ইন এ নোন কেস অব সিওপিডি, টাইপ টু ডাইয়াবেটিস, হাইপারটেনশন।
নিতাই বিশ্বাসের ঠিকানা লেখা ছিল ভোটার কার্ডের লোকাল ঠিকানা।।
অথচ জন্মভূমি থেকে বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসা একটা প্রান্তিক মানুষের মৃতদেহ আর ফ্যাল ফ্যালে চাউনির একটা বাচ্চা মেয়ের সামনে দাড়িয়ে আমার মনে হচ্ছিল, ভীষণ ভাবে মনে হচ্ছিল ডেথ সার্টিফিকেট মৃত্যুর সত্যি কথা লেখে না। ভোটার কার্ড মানুষের সত্যি ঠিকানা জানে না। জানতে পারে না।।