দু হাজার ঊনিশ সালে, চীনের উহান প্রদেশে হঠাৎ একটা রোগের খবর পাওয়া গেল-সম্পূর্ণ অজানা একটা রোগ। আমাদের গর্বিত বিজ্ঞান এই পুরো ঘটনায় থমকে গেল। কিন্তু থেমে গেল না। মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, ইশকুল, অফিস, কাছারি সব বন্ধ হয়ে গেল। খোলা থাকলো গবেষণাগার আর হাসপাতাল-চললো এক অক্লান্ত লড়াই। পৃথিবীর মানুষ এই রোগটা সম্বন্ধে কিছু জানার বা বোঝার আগেই গোটা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লো। বিজ্ঞানীরা থেমে ছিলেন না দিনরাত এক করে লড়ে যাওয়া স্বাস্থ্য কর্মীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে খুঁজতে থাকলেন রোগের কারণ আর তার চিকিৎসা।
আশ্চর্যজনক ভাবে প্রথমেই দেখা গেল ভাইরাস কতো বেশী ঢুকেছে তার ওপর এই রোগের জীবন মৃত্যু নির্ভর করে না। তাহলে কারণটা কী? বৈজ্ঞানিকরা খুঁজে দেখলেন করোনার আক্রমণে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটা তচনছ হয়ে যায়।এটা অসম্ভব বেশী বেশী কাজ করতে থাকে, এই ইন্নেট ইমিউন সিস্টেম(জন্মগত আর অন্যটা হলো অ্যাকুয়ার্ড, (বিস্তারিত পড়তে এই লিঙ্ক খুলুন https://thedoctorsdialogue.com/immunity-made-easy/)।
করোনা ভাইরাস যখন শরীরে ঢোকে তখন সে রেনিন অ্যাঞ্জিওটেনসিন নামে আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোল করার একটা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে কোষের মধ্যে ঢুকে যায়। তারপর সে নিজের বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। সেখান থেকে শরীরের সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়ে।
একটুখানি অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ তৈরি করার জন্য বিশেষ সৈন্যদল আছে।সেই সৈনিকদের সেনাপতিদের নাম যথাক্রমে সিডি4, সিসিএল2, সিসিএল3, সিসিএল7, সিসিএল12, আইএল6, আইএল-আলফা/বিটা, আইএল1-আলফা। এরা সবাই অকেজো হয়ে যায়। ম্যাক্রোফাজ টিএনএফ-আলফা/বিটা সবাই উল্টো পাল্টা কাজ করতে শুরু করে। আর সৈনিক হলো শ্বেত রক্ত কণিকারা।এরা তখন যাকে সামনে পায় তাকেই ধ্বংস করে ফেলে। এভাবেই শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একটার পর একটা ধ্বংস হতে থাকে।
ব্যাপারখানা জটিল হয়ে যাচ্ছে? তাহলে জেনে রাখুন এদের ভুলভাল কাজের জন্য শরীরের ইমিউনিটি বহু গুণ বেড়ে যায়। এটাকে ডাক্তাররা জটিল করে হাইপারইমিউন রেসপন্স বা সাইটোকাইন স্টর্ম বলে। এই সাইটোকাইন স্টর্ম হওয়ার জন্য ঐ আক্রান্ত জায়গাগুলো ফুলে ওঠে, পূঁজ জমে-ফলতঃ অক্সিজেন সরবরাহ কমে আসে। জায়গাটা মরে যায়। মনে রাখবেন ভাইরাস সিস্টেম ঘেঁটে দ্যায় আর সিস্টেম আমাদের মৃত্যু নিয়ে আসে।
আমাদের চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাইটোকাইন স্টর্ম থামানো। চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়টা এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের শেষে বলবো-তবে প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনও ভূমিকা নেই।
করোনা সর্বভুক। অর্থাৎ ও ফুসফুস, কিডনি, লিভার, ব্রেন,ইনসুলিন তৈরি করার প্যাংক্রিয়াস কিছুতেই বাছবিচার নেই। যে কোনও অঙ্গ তৎক্ষণাৎ নষ্ট হতে পারে অথবা রোগ সেরে যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে লাঙস, কিডনি বা হার্ট খারাপ হতে পারে-যথা পোস্ট কোভিড পালমোনারি ফাইব্রোসিস, শুগার, কার্ডিওমায়োপ্যাথি সব হতে পারে। একসঙ্গে বা আলাদা আলাদা করে। তার মানে সেরে গেলেও ভয় থাকে।
ইনভেস্টিগেশনের কথা বলতে গেলে প্রথমে বলতে হবে আরটিপিসিআরের কথা। যেহেতু এবার এই দ্বিতীয় তরঙ্গে গলায় বা নাকে অনেক সময় কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না সেক্ষেত্রে বুকের সিটি স্ক্যান করা ছাড়া উপায় নেই। এবং তার পর সাইটোকাইন মার্কার গুলো দেখতে হবে। বুঝতেই পারছেন সরকারি ব্যবস্থা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে এই সব করা দুঃসাধ্য আর বেসরকারি ব্যবস্থাটা শুধু ব্যয়বহুল তা নয় প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্রতম তাই সাধারণ মানুষের অসহায় মৃত্যু ছাড়া গতি নেই। অর্থাৎ আরটিপিসিআর নেগেটিভ মানেই যে আপনি নিরাপদ-তা নয়। বুকের সিটি স্ক্যান তখন করতেই হবে।
এরপর আসবো চিকিৎসায়। সাইটোকাইন স্টর্মে সাধারণতঃ কিছু এনজাইম বেড়ে যায় তবে বুকের সিটি স্ক্যান বড্ড দরকারি। বুঝতেই পারছেন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এটা গরীব মানুষ পারবে না। সুতরাং গরীব মরুক এই মনোভাবে আমাদের চিকিৎসা করতে হবে। (হয়তো লেখাটা কঠিন লাগতে পারে) তাই সন্দেহ হলে পরীক্ষা করান, নেগেটিভ বা পজিটিভ যাই হোক চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী বুকের সিটি স্ক্যান এবং সাইটোকাইন জন্য যে সব এনজাইম বাড়ে সেগুলো টেস্ট করান।সেগুলো ঠিক থাকলে তবে বাড়িতে চিকিৎসা।)
আমাদের অর্থাৎ চিকিৎসকদের প্রথম কাজ থাকবে সাইটোকাইন স্টর্ম থামিয়ে দেওয়া। এক্ষেত্রে কর্টিকো-স্টেরয়েডের কাজ সবথেকে বেশী। সির্টেলোজুমাব সাব কিউটেনিয়াস ইঞ্জেকশন, যেটা এই ধরনের অন্যান্য অসুখে(রিউম্যাটয়েড বা যে সব অসুখে ইমিউনিটি বেড়ে যায় সেখানে) কাজ করে সেটাও ব্যবহৃত হয়। তবে কখন সেটা চিকিৎসক বুঝবেন। তবে কর্টিকোস্টেরয়েড একটা অবশ্য প্রয়োজনীয় ওষুধ।
এরপর আসবে সাইটোকাইন স্টর্মের দ্বিতীয় উপসর্গ। অর্থাৎ শিরা ধমনীর ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। এর জন্য একটা অ্যান্টিপ্লেটলেট বা রক্ত তরল রাখার ওষুধ দরকার। সেটাও বড্ড দরকার।
যেহেতু স্টেরয়েড খেলে পাকস্থলীতে হাইড্রোকোলিক অ্যাসিড বেশী তৈরী হয় তাই একটা প্রোটন পাম্প ইনহিবিটার দরকার।
এরপর আসে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ। অর্থাৎ ভাইরাস মারার ওষুধ। র্যামডিসিভির সম্বন্ধে আমরা খবরের কাগজে পড়ছি। এগুলো জীবনদায়ী ওষুধ নয়। কতদূর দরকারি তা জানি না, কতটা কাজ করে তাও কেউ জানে না। তবু ভয়ঙ্কর চাহিদা। বারবার বলা হচ্ছে এগুলো অসুখ সারায় না। শুধু একটা চেষ্টা। এই দলে ফ্যাভিপিরাভির বলে একটা ওষুধ আছে।যখন শ্বেত রক্ত কণিকার টোটাল কাউন্ট বেড়ে যায় তখন হার্ট বা কিডনির ক্ষতি করে না এমন কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যায়।
সেরে যাওয়ার পরেও বুকের সিটি স্ক্যান আর ইকোকার্ডিওগ্রাম করে দেখা উচিত। অবশ্যই এই সব আমাদের দেশের সবার জন্য নয়-এমনকি পয়সা থাকলেও হয়তো আপনি সুযোগ পাবেন নাম (https://thedoctorsdialogue.com/ health-for-all-2/)। অক্সিজেন ব্যবহার করার বিষয়ে দু একটা কথা বলা উচিত। যখন সাইটোকাইন স্টর্মে ফুসফুস ধ্বংস হয়ে যায় তখন তার ফুলে ওঠা ও সঙ্কোচনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন বাইরে থেকে জোর দিয়ে অক্সিজেন ভেতরে পাঠাতে হয়। আমি ভেন্টিলেটর নামটা নেবো না। আপনারা আবার বলবেন পয়সা খ্যাঁচার কল। আর হ্যাঁ দেশে বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভেন্টিলেটরের সংখ্যা ঊনত্রিশ হাজার মাত্র তাই আপনি হে অভাগা মধ্যবিত্ত আপনি দেশ মহান বলা গোস্পদে ডুবে মরুন।