অনিরুদ্ধর নিজেকে মাঝে-মাঝে মিত্রবাড়ির ছেলে বলে পরিচয় দিতেই লজ্জা করে। তার স্বর্গত ঠাকুর্দা ভগীরথ মিত্র সেসময়কার বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন। তার বাবা ছিলেন কিংবদন্তী কার্ডিওলজিস্ট। দাদা অনিমেষ পারিবারিক ধারা ভেঙ্গে যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে নামকরা কোম্পানিতে চাকরি করছে। অফিসের কাজে আজ আমেরিকা তো কাল জার্মানি। দাদার ছেলে সত্রাজিৎটাও ভয়ঙ্কর মেধাবী। পারিবারিক জয়পতাকাটাকে সে যে আরও কিছুদূর নিয়ে যাবে তা নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই।
আর সে অনিরুদ্ধ মিত্র। টেনেমেনে বি.এ. পাশ। তাও ছাব্বিশ বছর বয়েসে। বাবা বেঁচে থাকলে নির্ঘাৎ বলতেন, ওটা অ্যাবর্টাস। গর্ভস্রাব। তার ডাক্তার বন্ধু বলেছে এটা কোনো নষ্ট জিনের কারসাজি। না হয় এরকম ব্লাড লাইনে তার মত ‘রদ্দিমাল’ বের হয় না। সে শুনেছে ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার ছেলেরা মাঝেমাঝেই এরকম অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে।
কিন্তু সে আর কী করে! ছোটবেলা থেকেই তার অঙ্ক আর ইংরেজিতে মারাত্মক ভয়। ক্লাস সিক্স অব্দি তাও ঠিক ছিল। কিন্তু সেভেন থেকে বীজগণিত আর পাটিগণিতের অকুলান সমুদ্রে সে হালে পানি পেত না। ক্লাস সেভেনের ‘উৎপাদকে বিশ্লেষণ কর’, আর পাটিগণিতের ‘ক-খ-গ তিনজন মিলে একটি কাজ শুরু করিল’ – এই জটিল আবর্তে সে গোলকধাঁধার মত ঘুরপাক খেত।
তার বাবা দূরদর্শী লোক ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছেলের জ্ঞানবুদ্ধির পরিচয় পেয়ে ইংরেজি মাধ্যম থেকে ছাড়িয়ে তাকে বাড়ির কাছের সরকারি বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করেন। শুধুমাত্র এই একটি কারণেই সে ক্লাস এইট, নাইন ও মাধ্যমিকে দু-বছর করে নিয়ে বি.এ. পর্যন্ত উতরেছে। উচ্চ মাধ্যমিকে যদিও আর্টস নেয়ায় অঙ্কটা বাদ গেছিল তবু ততোধিক কঠিন ইংরেজিতে একবার ব্যাক পেয়ে কোনোমতে দ্বিতীয়বারে পাশ করে।
সুখের বিষয় এই যে এহেন গর্ভস্রাবের অন্তিম পরিণতি দেখার আগেই তার বাবা-মা সিমলা বেড়াতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তারপর থেকে দাদার সংসারেই আছে। অনুগৃহীত হয়ে নেই। কারণ উত্তরাধিকারসূত্রে বাবার সম্পত্তির অনেকটাই সে পেয়েছে। বাড়ির দোতলার দুটো ঘর, সংলগ্ন পায়খানা বাথরুম তার বরাদ্দ। প্রচন্ড অলস। কাজের চেষ্টা কোনোদিন করে নি। বন্ধুবান্ধবও বিশেষ নেই। তার একমাত্র সময় কাটানোর উপায় বই।
অবশ্যই বাংলা বই। আর ইংরেজি বইয়ের বাংলা অনুবাদ। এই বই পড়ার অভ্যাসটা তার মায়ের থেকে পাওয়া। তাদের বাড়িতে দোতলার স্টাডিতে কম করে হাজার পাঁচেক বই আছে। বঙ্কিম থেকে সুনীল, রামমোহন থেকে কোনান ডয়েল কে নেই? রীতাভরি ছিলেন বইয়ের পোকা। এসব নভেল তারই সংগ্রহ। বইয়ের সঙ্গে থাকলে অনিরুদ্ধ মায়ের সান্নিধ্য অনুভব করে।
হাজার পাঁচেক বই শেষ করতে আর কতদিন লাগে? তাই স্থানীয় দু-দুটো লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছে। দুপুর আর বিকেলটা ওখানেই কাটে। সন্ধ্যেবেলায় চা খেয়ে ওপরে চলে যায়। বাড়ির কারো সাথে তার কোনো বিরোধও নেই হৃদ্যতাও নেই। বউদি তাকে সহ্য না করতে পারলেও মুখে কিছু বলে না। দাদা নিজের কাজে এত ব্যস্ত যে সংসারের দিকে ফিরে তাকাবার সময় নেই।
একমাত্র ব্যতিক্রম ভাইপো সত্রাজিত। মানে সতু। সে ছোটবেলা থেকেই কাকার ন্যাওটা। কাকার কাছে ছোটবেলা থেকে দেশ বিদেশের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনে সে কাকা অন্ত প্রাণ। আগামি বছর আই.সি.এস.সি. দেবে। এখনও সময় পেলেই কাকার ঘরে এসে দাবা খেলে সময় কাটায়। অনিরুদ্ধের মনে হয় শুধু এই ভাইপোর জন্যই যেন তার এই বাড়িতে বসবাসের একটা তাৎপর্য আছে।
এহেন অনিরুদ্ধের একটা নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। চোখের সামনে কোন ঘটনা দেখলে হঠাৎ করে মনে হয় এরকম সে আগে কোথাও ঘটতে দেখেছে। তবে কোথায় ও কবে দেখেছে সেটা ও কিছুতেই মনে করতে পারে না।
সেদিন জানলার ধারে বসে বই পড়তে-পড়তে বিছানায় রোদ এসে পড়ায় চমকে উঠে তার মনে হল এমন রোদ এসময় এখানে এসে পড়বে সেটা আগে যেন সে কোথায় দেখেছে। তবে কোথায় ও কবে দেখেছে সেটা ও কিছুতেই মনে করতে পারল না।
তার মনের এই রূপান্তর তাকে বেশ ভাবিয়েছে। সে ভাবার চেষ্টা করেছে এমনটা আগে কখনও হত কিনা। হালকা-হালকা এমন একটা হত বটে তবে এখন যেরকম ঘনঘন হচ্ছে আগে তেমন কখনও হয় নি।
তার কি দিব্যদৃষ্টি খুলে যাচ্ছে? ভাবনাটার মধ্যে একটা অলৌকিক উত্তেজনা আছে। তবে যে ছেলের মাথা ছোটবেলা থেকেই নীচু এই ধারণাটা তার মনে বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।
এটা কি কোন অসুখ? বাড়ির সবাই তো বলে সে নাকি ডিপ্রেশনে ভোগে। ডিপ্রেশন থেকে কি এমন হয়? কে জানে। সিদ্ধার্থকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সিদ্ধার্থ বড় ডাক্তার। এম.ডি.। অনেক বড় বড় লোকের তার মত ছোট বন্ধু থাকে। সিদ্ধার্থ ওকে কখনও অবহেলা করে না। একেবারে নার্সারি থেকে বন্ধু। একই পাড়ায় থাকে। তার সত্যিকারের বন্ধু বলতেও একটি আর বাড়ির বাইরে লাইব্রেরি ছাড়া যাবার জায়গাও একটি – ওই সিধুদের বাড়ি। তার কাছে সিধুই। মনে পড়ে না লাস্ট ওকে কবে সিদ্ধার্থ বলে ডেকেছে।
রবিবার বিকেলে সিধুর চেম্বার বন্ধ থাকে। গেলে রবিবার বিকেলেই ওর বাড়ি যায়। সিধুর নতুন বউও তাকে বেশ খাতির যত্ন করে। চা-সিঙ্গাড়া দেয়। সবার খোঁজখবর নেয়। সিধুর বউকে তার বেশ ভালই লাগে। কখনও সিধুর বউকে দেখলে তারও একটু বিয়েটিয়ে করারও ইচ্ছে হয়। তবে ওই পর্যন্তই। তার বেশি কিছু না।
সিধুকে ঘটনাটা খুব উৎসাহ নিয়ে বলল। তার মনের এই ভাবান্তর অসুখ-টসুখ কিনা তাও জানতে চাইল। অথচ সিধু ব্যাপারটা পাত্তাই দিল না।
আরে এটা খুব সাধারণ ঘটনা। অল্পবিস্তর সবারই হয়।
মানে তোরও হয়?
হয় বই কি। শুধু আমার কেন তুই আর পাঁচটা লোককে জিজ্ঞাসা করে দেখ তিনজন বলবে এমন তাদেরও হয়।
কিন্তু আমার যেরকম ঘনঘন হচ্ছে তোর কি সেরকম হয়?
তা হয়ত হয় না। তবে এই তো সেদিন হাসপাতালে ঢুকতে গিয়ে গেটের কাছে এক ভিখিরিকে হাত পাততে দেখে আমার মনে হল এমন যে একটা কিছু ঘটতে পারে সেসময় সেটা যেন আমি আগেই জানতাম। অথচ তার পরের ঘটনা আমার আর মনে এল না।
আমারও এমনটাই হয়। আগে-পরের ঘটনা ঠিক মনে করতে পারি না।
তুই এটা নিয়ে ফালতু চিন্তা করিস না। টেক ইট অ্যাজ নর্মাল।
এটা কি কোনো মনের অসুখ?
না রে, তোকে বললাম না এটা হতে পারে। সাধারণ লোকের পক্ষে এটা সাধারণ ঘটনা। তবে এর একটা গালভরা নাম আছে – দেজাভু।
দেজাভু? ফরাসি শব্দ? অনিরুদ্ধের মনে হল এই কথাটা সে আগে কোথাও পড়েছে।
ইয়েস। মানে অপরিচিত কোন ঘটনাকে পরিচিত বলে মনে হওয়া। টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি বলে একধরণের অসুখে এটা খুব কমন।
এপিলেপ্সি মানে তো মৃগি? কিন্তু আমার তো ওসব নেই।
হ্যাঁ তাই। তার মানে তুই সুস্থ। তবু তোরও দেজাভু হতে পারে। জুলিয়াস সিজারের নাম শুনেছিস তো?
রোমান সম্রাট সিজার?
হ্যাঁ। বলা হয় সিজার নাকি নরম্যাল ডেলিভারিতে না হওয়ায় তাকে মার পেট কেটে বের করতে হয়েছিল। তার নাম অনুসারেই এখনকার সিজেরিয়ান সেকশন বা মার পেট কেটে বাচ্চা বের করার পদ্ধতির নামকরণ হয়েছে।
ডাক্তারদের এই মহিলাদের পেট কাটা, বাচ্চা বের করা এই কথাগুলো সহজে আসলেও তার মত অবিবাহিত পুরুষের কাছে কথাগুলো অস্বস্তিকর। সে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করল, তার সাথে দেজাভুর যোগ কোথায়?
যোগ মানে এখনকার ঐতিহাসিকেরা বলেন সিজারের নাকি টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি ছিল। তবে তার দেজাভু ছিল এমন তথ্য আমি পাই নি।
সিদ্ধার্থ হয়ত ওকে এমন কথা বলত না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে লক্ষ্য করেছে তার বন্ধুটির একটা জ্ঞানলিপ্সা আছে যা কিনা পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে। তাই এসব ভাট বকল।
আচ্ছা আমি যদি অনেক্ষণ ধরে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করি তাহলে কি আমার ঘটনাটা মনে আসতে পারে?
দেখ, দেজাভুটা শুধুই মনে হওয়া। বাস্তবের সাথে তার যোগ সামান্যই। অন্তত আমাদের নিউরোলজি তো তাই বলে। তবে মানুষের মন বড় বিচিত্র। মনস্তত্বের প্রায় কিছুই এখনও বিজ্ঞানীরা জানতে পারে নি। তোর সময় আছে। তুই তো ভেবে দেখতেই পারিস পরবর্তী ঘটনা যা ঘটতে চলেছে তা তোর মনে আসছে কিনা? তাহলে সেটা একরকম প্রফেসি বা ভবিষ্যতবাণী হবে বলতে পারিস।
সিধুর শেষ কথাটায় যে ব্যঙ্গ প্রচ্ছন্ন ছিল তা ধরতে পারলেও দেজাভু ব্যাপারটা সে কিছুতেই মাথা থেকে মুছে ফেলতে পারল না।
আর যতদিন যেতে লাগল তার দেজাভুও উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। আর যখনই এমন হত তখন ভাবার চেষ্টা করত তার পরে কিছু দেখেছিল এমন কিছু সে মনে করতে পারছে কিনা। কিন্তু তখনও পর্যন্ত আর কিছু মনে আসে নি। তাই ভাবতে গেলেই হতাশ হত।
তবে ঘটনাটা ঘটল সেই দিন। সেদিন মঙ্গলবার অমিতেশকাকা মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে এসেছিলেন যাদবপুর থেকে। কাকা নিচের বৈঠকখানার ঘরে কার্ড নিয়ে বসেছিলেন। বৌদি তাকে ডাকায় সে দোতলা থেকে নেমে এল। হঠাৎ ঘরে ঢুকে কাকার কথা শুনে তার মনে হল ঘরের পরিবেশটা তার চেনা। এমনটা সে আগে যেন কোথায় দেখেছে। কাকার হাতে বিয়ের কার্ড, দাদা-বৌদির হাসিমুখ দেখতে দেখতে তার চোখের সামনে কি যেন চলে এল। সম্পূর্ণ বিনা খেয়ালেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল –
কাকু এই বিয়ে আপনি দেবেন না। ছেলেটা মনে হয় ভাল নয়।
তুই কী বলছিস? ছেলেকে তুই চিনিস? ওদের বাড়ি তো টালিগঞ্জে। ছেলে থাকে স্টেটসে। আই.আই.টি. ইঞ্জিনীয়র। এমন ছেলেকে তুই… মাথাটা কি একদম গেছে?
আরে না না… আমার হঠাৎ মনে হল… মানে এরকম মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছে… মানে আজ এই প্রথম মনে হল…
অনিরুদ্ধ লজ্জিত হয়ে ওপরে চলে গেল। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল সুনন্দার ভাবি বর মানে একটা ছেলে সুনন্দার মুখ বালিশে চেপে ধরছে।
কাকু আপনি কিছু মনে করবেন না। অনী কি বলতে কি বলে ফেলেছে। চাকরির চেষ্টা নেই। সারাদিন ঘরে বসে ছাইপাশ নভেল পড়ে-পড়ে ওর দিনদিন মাথাটা বিগড়ে যাচ্ছে।
অমিতেশকাকা কিছু না বলে মুখটা গম্ভীর করে চলে গেলেন।
এই ঘটনার পর তাকে নিয়ে বাড়িতে নানান কথা কানে এসেছে। দাদা-বৌদি সেদিন খাবার টেবিলে আলোচনা করছিল –
আমার মনে হয় এটা এক ধরণের জেলাসি। ওর এত বয়স হয়েছে বিয়ে হচ্ছে না তাই অন্য কারোর বিয়ে হোক এটা ও চাইছে না। বৌদির গলায় ধিক্কার।
কি বলছ এসব? ওসব কিছু না। ফ্রাস্ট্রেশানে ওর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
সব ঠিক আছে। মাথা কিছুই খারাপ না। ‘ইনসেস্ট’ কিনা দেখ? আমি বাথরুম থেকে বেরোলে অনী আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যে আমারই মাঝে-মাঝে লজ্জা করে।
থাম! বাজে বোকো না। তুমি কোনোদিনই আমার ভাইকে সহ্য করতে পার না।
অনিরুদ্ধ আড়াল থেকে সব শুনছিল। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেখে সে ওপরে চলে গেল। ওপরে উঠে ডিকশনারি দেখে ‘ইনসেস্ট’ মানেটা দেখে ওর কান লাল হয়ে গেল। যদিও বৌদি যে বিভিন্ন ব্যাপারে অনেক নিচে নামতে পারে সে সেটা আগে থেকেই জানত। তবে আজকের মত এতটা সে কোনোদিন প্রত্যাশা করে নি।
হপ্তাখানেক বাদে অমিতেশকাকা আবার এলেন। কাকা একদম ভেঙ্গে পড়েছেন। ঘটনাচক্রে উড়ো চিঠি মারফৎ খবর পেয়ে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন ছেলেটা সত্যিই ভাল নয়। তার আমেরিকায় একটি বিয়ে করা বিদেশি বউ আছে। ডিভোর্সও ঠিকঠাক হয় নি। অথচ তার বাড়ির লোক পুরো ব্যাপারটা চেপে গেছে।
এই ঘটনার পর থেকে অনিরুদ্ধ বাড়িতে একটা বিশেষ গুরুত্ব পেতে শুরু করল। সবাই যে ওকে বেশ একটা ভয় ও সমীহের চোখে দেখছে এটা সে বুঝতে পারল।
অনেকদিন বাদে দাদা তার ঘরে এল। দাদা শেষ কবে তার ঘরে এসেছে সে মনে করতে পারল না। বছর পাঁচেক তো হবেই।
অনী তুই কি সত্যিই কিছু দেখতে-টেখতে পাচ্ছিস? আই মিন ফোরসি করছিস?
না দাদা তেমন কিছু নয়। কয়েকদিন ধরে আমার সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে। তবে ভবিষ্যৎ কিছু হঠাৎ দেখতে পাওয়া সেদিনই প্রথম। তার আগেও তেমন কিছু দেখি নি, পরেও না।
অমিতেশকাকুর মেয়ের বিয়ের ব্যাপারটা শুনেছিস তো? তোর কথাটা তো মিলে গেছে।
ওভাবে বোলো না। ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে। এমন তো এখন আকছার হচ্ছে।
অনিরুদ্ধ তার চেয়ে বারো বছরের বড় দাদাকে সবসময় তুমি বলেই সম্বোধন করে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। দাদা অনিমেষ অফিসের কাজে সিকিম যাবে। ওদের কোম্পানির একটা কাজ হচ্ছে সিকিমে। তদারকি করতে যাবে। অনেক দিনের অ্যাসাইনমেন্ট। সোমবার বেরোবে। দমদম থেকে ফ্লাইট করে সোজা বাগডোগরা। সেখান থেকে জাইলো করে গ্যাংটক।
সোমবার দাদা যখন বেরোচ্ছে তখন অনিরুদ্ধ বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। ডিসেম্বরের ঠান্ডা। দাদার গায়ে কোট। বৌদি চাদর গায়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। হালকা কুয়াশা এখনও লেগে আছে বাড়িতে। কাদের বাড়িতে হরিনাম হচ্ছে সকালে। মিষ্টি ধূপের গন্ধ।
হায় ভগবান এ দৃশ্য যেন তার কতদিনের চেনা। সে দাদার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। তার চোখে ভেসে উঠল মা-বাবা দাদার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাবার মুখটা চেনা যাচ্ছে না। রক্তে ভেজা। ব্যান্ডেজ জড়ানো। মা’র মুখটা বিষণ্ণ। মৃতের মুখের মত পাংশু। মুখের কষ বেয়ে নেমে আসছে রক্তের রেখা।
দাদা তুমি যেও না। ট্যুর ক্যান্সেল কর। অনী অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল।
তুই এসব কী বলছিস? কেন? দাদার গলা শান্ত অথচ গম্ভীর।
আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা বিপদ হতে পারে।
অনিমেষ গাড়ির আধখোলা দরজাটা বন্ধ করে বৌয়ের মুখের দিকে তাকাল।
যেও না, ও যখন বলছে… থেকে যাও।
কিন্তু এত ইম্পরট্যান্ট অ্যাসাইনমেন্ট। দু-ঘন্টা বাদে ফ্লাইট। সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি কোন মুখে না করি?
বল হঠাৎ শরীর খারাপ হয়ে গেছে। আর ওনারা কি যাবেন…?
বৌদি অনিরুদ্ধের দিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
জি.এম.কে ফোন করে জানাল সকাল থেকে সে খালি ঘর আর বড় বাথরুম করছে। এতক্ষণ জানায় নি। ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন একদম বেড রিডেন। নড়াচড়ারও উপায় নেই। জি.এম. এর অত্যন্ত তেতো গলার কিছু বাক্যবাণ তাকে হজম করতে হল। মুখ ব্যাজার করে সে জামাকাপড় ছেড়ে বসার ঘরে সেনসেক্স নিয়ে বসল।
সন্ধ্যের দিকে অফিস থেকে ফোন এল। যে গাড়ি করে ওরা সিকিম যাচ্ছিল সেটা খাদে পড়েছে। আবহাওয়া প্রচন্ড খারাপ থাকায় আর্মি কাজ করতে পারছে না। তবে কারোর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম কারণ খাদটা প্রায় হাজার ফুট গভীর।
খবরটা পেয়ে ছুটে ভাইয়ের ঘরে গিয়ে দেখল ছিটকিনি লাগান। বউ বলল অনী এসময় পাড়ার লাইব্রেরীতে থাকে। শেষ মুহূর্তে তার যাওয়া ক্যান্সেল করায় ও এতবড় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটায় অফিসে তাকে নিয়ে অনেক গুজগুজ ফিসফাস হল কিন্তু সে নিজে এত বড় পোস্টে চাকরি করে যে আলোচনাটা ক্যান্টিনের সিঙাড়াতেই শেষ হল। উলটে মৃত জি.এম. এর কন্ডোলেন্সে তাকেই নতুন জি.এম. বলে নির্বাচিত করা হল।
মার্চের শুরু। তার ভাইপো অনী এবার ক্লাস টেনের ফাইনাল দেবে। বাড়িতে সবাই খুব উৎকন্ঠায় আছে। অনিরুদ্ধও খুব টেনশন করছে। ভাইপোটি তার অত্যন্ত প্রিয় ও খুব মেধাবী। কিন্তু সেদিন দাড়ি কাটতে গিয়ে হঠাৎ আয়নায় দেখতে পেল তার মুখটা যেন পক্সের দাগে ভরে গেছে। পর মুহূর্তেই ভাল করে তাকিয়ে দেখল কই কিছু তো নেই। তার মুখে কোনোকিছুর দাগই নেই।
পরে ভাবতে বসে তার মনে হল আরে তার পক্স হবে না তো? তার থেকে বাড়ির সবার হলে? সতুর হলে? ওর পরীক্ষা। পক্স হলে তো পরীক্ষাই দিতে পারবে না।
তক্ষুনি নিচে গিয়ে দাদাকে বলল সতুকে পরীক্ষার আগে আগামি কয়েক হপ্তার জন্য মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিতে। বউদি রেগে গিয়ে কারণ জানতে চাইল। সে বলল তার সকালে আয়নায় দেখার কথা। দাদা আর কথা না বাড়িয়ে ছেলেকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিল। তার তিনদিন পরে প্রথম পক্স হল দাদার। তারপর বৌদির। শেষে তার। সতুদের ব্যাচের অনেক ছেলের পক্স হল। তাদের সবার ভ্যাকসিন নেওয়া ছিল। কিন্তু সিধু বলল, পক্সের ভ্যাকসিন একশ শতাংশ নিরাপত্তা দিতে পারে না। সতু মামাবাড়িতে থাকায় সে যাত্রা বেঁচে গেল। সুস্থ শরীরে পরীক্ষা দিয়ে আই.সি.এস.সি. তে অল ইন্ডিয়ার মধ্যে তৃতীয় হল।
যেদিন রেজাল্ট বের হল অনিমেষ সেদিন ছুটি নিয়েছিল। বাড়িতে সকাল থেকে রিপোর্টার আসা শুরু হয়েছে। সবাইকে ইন্টারভিউ দিতে দিতে দুটো বেজে গেল। সতু তখন ওপরে কাকার ঘরে গিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। কাকাকে এসময় পাবে ও আশাও করে নি। কারণ ও জানে কাকা এসময় বিভূতি স্মৃতি গ্রন্থাগারে এই মাসের শুকতারার পাতা ওল্টাচ্ছে।
এরপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। অনিরুদ্ধকে একটা বিশেষ কাজে বর্ধমান যেতে হবে। শিয়ালদা থেকে মাঁ তারা এক্সপ্রেস ধরবে। সে সকালবেলা আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। পাশেই একটা বাচ্চা ছেলে মা’র কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। একদম যেন ছোটবেলার সতু। সে গাল টিপে আদর করল। লাল গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার জিন্সে তাকে ফুটফুটে দেখাচ্ছে। বাচ্চাটা মাঝেমাঝেই এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে।
দুর্গাপুজো শেষ হয়ে গেছে। কালীপুজো সামনে। রামপুরহাট যাবার জন্য তাই যাত্রীদের ভিড় খুব। সেইসঙ্গে বর্ধমানের প্রতিদিনকার অফিসবাবুরা তো আছেনই। সেদিন আকাশটা একটু মেঘলা। আবহাওয়া অফিস বলছে কয়েকদিনের মধ্যেই শীত আসছে। একটু-একটু ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ফুলশার্ট পরে এসে সে ভালই করেছে। মনে মনে ভাবল।
সাত নম্বর দিয়ে যেই একটা ট্রেন ছেড়ে দিল তার হঠাৎ স্টেশনের পরিবেশ চেনা চেনা মনে হতে লাগল। পরক্ষণেই দেখল তার পাশের ছেলেটি হাতে ক্র্যাচ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ছেলেটার ডানদিকের পা-টা হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। এ কি বিড়ম্বনা!
হুঁশ ফিরতেই তাকিয়ে দেখল ছেলেটি তার পাশে নেই। হঠাৎ শুনতে পেল কয়েকজন লোক খুব চেঁচাচ্ছে। ছোট ছেলেটা খেলতে খেলতে লাইনের ওপর পড়ে গেছে। এদিকে কোন রকম ঘোষনা ছাড়াই মাঁ তারা এক্সপ্রেসও প্রায় প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়েছে।
সে কালবিলম্ব দেরি না করে লাইনে ঝাঁপ দিল। বাচ্চাটার দুটো পা-ই লাইনে আটকে গেছে। জুতো খুলে পা ছাড়িয়ে বাচ্চাটাকে সরিয়ে নিজে লাইন থেকে সরার আগেই ট্রেনটা তার গায়ের ওপর চলে এল। শেষ সময়ে সরে যেতে গিয়েও ডান পা-টা কিছুতেই আর সরাতে পারল না।
পাশে বাচ্চাটা অক্ষত। অনিরুদ্ধ বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকাল। একদম তার ভাইপোর মুখ যেন বসানো। অবিকল প্রুতিরূপ।
প্রচন্ড ব্যথায় মূর্ছিত হয়ে যেতে যেতে তার মনে পড়ল মিত্রবাড়ির সবাই বলে সতু নাকি একদম তার কাকার মত দেখতে হয়েছে। একদম নাকি কাকার মুখ বসানো