কানের পাশে একটানা সুর করে ভেসে থাকা আওয়াজে রাতের সুখনিদ্রাটুকু ভেঙেই গেল অর্জুনের। এমনিতেই পুজোর ছুটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হতে চলেছে কঠিন সেমিস্টার পরীক্ষাগুলো।
একটু বেলার দিকে পড়তে বসলে কখন যে মাঝরাত চলে আসে বুঝতে পারেনা সে। মাঝখানে মা এসে খাবার জন্য বকাবকি করে যান। কিন্তু এখন শিয়রে সমন। সে কথা মাকে বোঝাবার উপায় নেই।
নব্বই দশকের শুরুর কলকাতা। উদার অর্থনীতির প্রভাব তখনও পুরোপুরি এসে পৌঁছায়নি শহর কলকাতায়। শহরতলীর এইসব অঞ্চলে নিচু জলা জমিগুলো ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি শুরু হয়েছে। বস্তিগুলোতে আলো পৌঁছে দেওয়া শুরু হলেও, কিছু কিছু ঘর এখনো নিষ্প্রদীপ। আকাশ ফুঁড়ে ওঠা বহুতল আর এখানে ওখানে মাথার উপরে জেগে থাকা শপিং মলের আধিক্য তখনও গ্রাস করে ফেলতে পারেনি কলকাতার আকাশটাকে।
কালিপুজো শেষ হয়েছে কিছুদিন। শহরজুড়ে সাড়ম্বরে শ্যামা মায়ের আরাধনার পরে এখন স্তিমিত হয়েছে মাইক আর শব্দবাজির উচ্ছ্বাস। কিন্তু তার গুঞ্জন যেন এখনও যেন রয়ে গেছে কানের ভিতর।
দোতলায় অর্জুনের নিরিবিলি এই ঘরটি রয়েছে বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে। ঘরের খড়খড়ি দেওয়া দুটি জানালা খুললেই অনেকটা দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। পাশাপাশি দুটি বাড়ি রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা দৃষ্টিপথকে আচ্ছন্ন করতে পারে না। একফালি জমি পেরিয়ে ছোট একতলা বাড়িটি এক প্রৌঢ় ডাক্তারবাবুর। আর তার পাশের বাড়িতে থাকেন দুই ভাই, রতন ও ধীমান। রাস্তার উল্টো দিকে রয়েছে জরাজীর্ণ বহু পুরনো এক বাড়ি। যে বাড়িতে বসবাসকারী মানুষ জন, সে বাড়ির মতোই প্রাচীন এবং রহস্যময়। নামে ‘পাঞ্জাবি বাড়ি’ হলেও সে বাড়িতে বসবাস করে আপামর ভারতবর্ষ। একতলায় বিহার অথবা উত্তরপ্রদেশের মানুষ থাকলে, দোতলায় দক্ষিণ ভারতীয় হয়ে তেতলার ছাদে তা পাঞ্জাব প্রদেশে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু ঘরগুলো এক থাকলেও প্রায়শই বদলে যায় ভাড়াটেদের মুখ। বছরের পর বছর ধরে সেই রকমই চলে আসছে। পরিবর্তন এতটাই যে পাড়ার হাল হকিকত জানা ক্লাবের ছেলেরাও ফি বছর জলসা অথবা পুজো পার্বণের চাঁদা তুলতে গিয়ে ঘাবড়ে যায় নতুন মুখ দেখে। আসলে সে বাড়িটা ছিল বাঙালি পাড়ার ভিতর একটা অবাঙালি মানুষদের আস্তানা। ঠিকানা বজায় রেখে দেশোয়ালি মানুষের জন্য কলকাতা শহরে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই।
তখনও শহর কলকাতা, কর্মসংস্থানের উপায় খোঁজ করে চলা দেশের অন্যান্য প্রদেশের মানুষের কাছে এতটা ব্রাত্য হয়ে যায়নি।
অনেকরাতে পড়তে পড়তে কখন যে অর্জুনের ঘুম এসে গিয়েছিল তা খেয়াল ছিল না। পুজোর মরশুম চলে গেলেই হালকা শীত পড়তে শুরু করে কলকাতা শহরে। মা হয়তো কখন এসে ঘরের লাইট নিভিয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে যান ঠাহর করতে পারে না সে।
পুজো শেষ হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসা মাইকের আওয়াজ আর ইতিউতি বাজির শব্দ থেকে দূরে থাকতে সন্ধ্যা থেকেই সে বন্ধ করে দেয় খড়খড়ি দেওয়া কাঠের জানালা দুটো।
ঘুম ভেঙে সঠিক রূপে জাগ্রত হতে খানিকক্ষণ সময় লাগে সবারই। অর্জুনের ক্ষেত্রেও অন্যথা হলো না। আধোঘুমে সে কান পেতে রইলো ভেসে থাকা সেই কণ্ঠস্বরের দিকে।
“আগ,আগ লগ গয়া।” মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে যেন ভেসে আসছে কোন বাচ্চা ছেলের গলার আওয়াজ। ঘুমের ঘোরে অর্জুন দেখলে জানালার খড়খড়ি দুটোতে, কেমন একটা স্বর্ণালি আভা লেগে রয়েছে। আর একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আসছে চিটচিট করে। মুহূর্তের ভগ্নাংশে চোখ খুলে গেল অর্জুনের। “আগ,আগ….” আরো তীব্র সেই কণ্ঠ এখন। এক লহমায় চাদর সরিয়ে উঠে পড়লো অর্জুন। কোথাও একটা বিপদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একলাফে ঘরের অন্ধকার ছেড়ে দরজা খুলে বারান্দায় ছিটকে বেরোল সে।
দাউদাউ করে জ্বলছে পাশের বাড়ির রতনদার একতলার বারান্দা। কোত্থাও কেউ নেই।আগুনের লেলিহান শিখা বারান্দা টপকে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। অর্জুন কি করা উচিৎ বুঝতে না পেরে দৌড় শুরু করলো সিঁড়ির দিকে। এখন কাউকে ডাকার সময় নেই, অন্য কিছু ভাবার কথা মনেও আসলো না তার। সদর দরজা খুলে খালি পায়ে দ্রুত যখন সে রতনদার জ্বলন্ত বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ালো ,তখনও কেউ এসে পৌঁছায়নি সেখানে। সে জানতো রতনদার বাড়ির একতলায় একটা কারখানা রয়েছে, সারাদিন কয়েকজন কর্মচারী সেখানে কাজ করে। মাঝে মাঝে তাদের ঠাট্টা-তামাশার আওয়াজ বাড়িতে বসেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে ঠিক কি প্রস্তুত হয় সে কথা জানে না সে।
কিন্তু এই মুহূর্তে, কোন এক কারণে সেই কারখানায় লাগা আগুনের সামনে, সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। আগুনের তীব্র উষ্ণতা আর কেমিক্যাল পোড়ার একটা অদ্ভুত মাদকের গন্ধে তার স্নায়ুতন্ত্র কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। একতলার এই বারান্দার পিছনেই থাকে রতন! তার কি খবর বুঝতে পারছে না অর্জুন। উপরের ধীমানদাও কি জানে যে আগুন লেগেছে বাড়িতে! এখন এখানেই আটকাতে না পারলে তো সারা বাড়ি জ্বলতে শুরু করবে একটু পরেই।
একাকী এই নির্জন রাস্তায় অর্জুনের বড় অসহায় লাগলো। সে সম্মোহিত হয়ে আগুনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। পা’দুটো কেউ যেন পেরেক মেরে আটকে দিয়েছে রাস্তার সাথে।
নড়তে পারছে না এতটুকু। হুঁশ ফিরলো একটা কুকুরের ডাকে।
অর্জুন দেখল পাশে দাঁড়িয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে রাগে গরগর শব্দ করছে ‘লন্ঠন’। পাড়ার পুরনো পাহারাদার। কয়েকদিন আগেও মাঝরাতে তার গলার আওয়াজ পাওয়া যেতো। অন্য আর সব কুকুরের মতো নয়, একটু স্বতন্ত্র গম্ভীর তার আওয়াজ।
রাতের গভীরে এই শব্দেই বোঝা যেত লণ্ঠন জেগে রয়েছে। নিস্তার নেই চোরেদের। একার শক্তিতে না পারলেও চীৎকারে পাড়া জাগিয়ে ছাড়বে সে।
কিন্তু কালি পুজোর সময় থেকেই তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে কুকুরেরা সাধারণত কালি পুজোর সময়ে শব্দবাজির অত্যাচারে লুকিয়ে পড়ে কোন এক গোপন আস্তানায়। এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাই জন্যেই হয়তো অনুপস্থিত ছিল কয়েকদিন।
লন্ঠনকে দেখেই কেমন একটা ভরসা ফিরলো অর্জুনের। সে দৌড়ে ফিরে গেল নিজের বাড়ির ভিতর।
ততক্ষণে জেগে উঠেছে তার নিজের বাড়ির লোকজনেরা। বাড়ির পিছনে থাকা জলে ভরা চৌবাচ্চা থেকে এক বালতি জল ভরে সে ফিরে এলো দ্রুত। বালতি ভরা জল সরাসরি ঢেলে দিল আগুনের উপর। ততক্ষণে বালতি করে জলের যোগান আসতে শুরু করেছে বাড়ি থেকে।
বাড়ির কাজের লোক, কাজের প্রয়োজনে বাড়িতে ঘুরতে আসা তুতো দুই ভাইও সামিল হয়েছে সেই অগ্নি নির্বাপনে। এই হৈ হট্টগোলের মাঝে ধীরে ধীরে জমায়েত বাড়ছে পাড়ার আর পাঁচটা লোকের। কেউ পিছনে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছে আগুন নেবানোর, কেউ খবর নিচ্ছে দমকলকে ডাকা হয়েছে কিনা সে কথা জানতে। কিন্তু সে সব দিকে না তাকিয়ে অর্জুনের মতো জোয়ান ছেলেরা রিলে রেসের মতো হাতে হাতে বয়ে আনা বালতি ভরা জল ঢেলে যেতে লাগলো সেই আগুনের উপর। ধীরে স্তিমিত হতে লাগলো সেই লেলিহান শিখা। এরই মধ্যেই কাশতে কাশতে অন্য দরজা দিয়ে কোনক্রমে বেরিয়ে এসেছেন রতনদা।দোতলা থেকে নেমে এসেছেন ধীমানও।
আগুন অনেকটা আয়ত্বের মধ্যে এসে গেলে জমা ভিড়ের মাঝে লণ্ঠনের খোঁজ করছিল অর্জুন।
কিন্তু কোথাও দেখতে পেলে না তাকে।
সে লক্ষ্য করলে উল্টো দিকের পাঞ্জাবি বাড়ি থেকেও অনেকে নেমে এসেছেন রাস্তায়। বিভিন্ন ভাষায় আলোচনা চলছে আগুন নিয়ে। কেউ কেউ জল নিয়েও আসছেন বাড়ির ভিতর থেকে।
অর্জুন সেই বাড়ির ছাদে বসবাসকারী পাঞ্জাবি পরিবারটিকে জিজ্ঞেস করলে সেই বাচ্চা ছেলেটির কন্ঠস্বরের কথা। যেই স্বর তাকে, শীতের গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে এনে ফেলেছে এই সর্বভুক আগুনের সামনে। কিন্তু উপস্থিত ভিড়ের মাঝে সেই বাড়ির প্রায় সকলকে জিজ্ঞাসা করেও, মাঝরাতে জেগে থাকা কোন বালকের সন্ধান পাওয়া গেল না। যে কন্ঠস্বরের মালিক সঠিক সময়ে প্রতিবেশীকে জাগিয়ে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল রতন ধীমান-দের। একটু অবাকই হলো অর্জুন।
ভিড়ের একপাশে দাঁড়ানো পাড়ার একটি ছেলের প্রতি তার নজর পড়লো। কথায় কথায় তাকে লন্ঠনের খবর জিজ্ঞেস করলে।
উত্তরে এবার চমকে গেল অর্জুন। কালিপুজোর আগের রাতে নাকি বোমার আঘাতে ঝলসে যায় লন্ঠনের শরীর। সেটা যে আদৌ চকোলেট বোম ছিল না তা সহজেই অনুমেয়। দেওয়ালির আশেপাশে সেই সময় চকোলেট বোমার বারুদ একত্রিত করে তৈরি হতো এক রকম কৌটো বোম, যার ক্ষতি করার ক্ষমতা অনেক বেশি। আসলে লণ্ঠনের কড়া পাহারাদারিতে ছিঁচকে চুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এলাকায়। বেড়ে যাওয়া শত্রু সংখ্যার জন্যই হয়তো এই পরিণতি অপেক্ষা করছিল তার।
পাড়ার ছেলেরা ধরাধরি করে পশু হাসপাতালে নিয়ে গেলেও, বাঁচানো যায় নি তাকে।কালি পুজোর দিনই মারা যায় যায় লন্ঠন। আর ঠিক সেই জন্যেই দিন কয়েক তার আওয়াজ পাওয়া যায়নি।
পরপর ধেয়ে আসা দুই চমকে দেওয়া খবরে থমকে গেল অর্জুন। ধিকিধিকি আগুন এখনো জ্বলে আছে বারান্দার ভিতর। জানা গেল বারান্দায় রাখা ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমারে শর্ট সার্কিট হয়েই এই অগ্নিকাণ্ডের সূচনা।
চারিদিকে জলে জলাকার এখন। দমকলের ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে।
আকাশের দিকে চেয়ে অবাক অর্জুন দেখলে কালি পুজোর অমাবস্যা পেরিয়ে আকাশে হাঁসুলির মতো চাঁদ জেগে রয়েছে আরেক পূর্ণিমার অপেক্ষায় । মাঝে মাঝে তার গায়ে স্পর্শ করে যাচ্ছে বয়ে যাওয়া মেঘের দল।
বাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়, দূরে কোথাও রাতের পাহারায় ব্যস্ত কোন এক কুকুরের গলার আওয়াজ পেলে সে। ক্রমশ সেই শব্দের রেশ রাতের অন্ধকারে আরও দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
অর্জুনের মনে হলো আওয়াজটা ঠিক যেন লন্ঠনের মতো।