ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেও ( ১৯৮০- ২০০০ সালে) ভারতের প্রায় সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালের শীর্ষে থাকতেন শুধুই প্রথিতযশা নামকরা চিকিৎসকেরা। আমাদের দেশ তখন বর্তমানের চেয়েও বেশী গরীব দেশ ছিলো কিন্তু, আর এইসব বেসরকারি বা প্রাইভেট চিকিৎসকেরা, আমার যতটুক মনে পরে এখন, সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্টই সম্মান ও ভালোবাসা পেতেন তখন। ডাক্তাররা তখন ভগবানের পরেই সন্মান পেতেন সাধারণ মানুষের কাছে। অনেকসময়ই তখন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে হাসপাতালের বিলও কমিয়ে দেওয়া হতো, ক্ষেত্রবিশেষে, মানবিকতার খাতিরে। তখন প্রাইভেট হসপিটালগুলোতে চিকিৎসা নিয়ে এতো করাপশনও ছিলো না। অবশ্য বেসরকারি হাসপাতাল তখন হতে গোনা মাত্র কয়েকটাই ছিলো। আর, তারপর গত দুই তিন দশক ধরে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারলেন যে, এইসব আদর্শবাদী চিকিৎসকদের দিয়ে সত্যিকারের তাদের ব্যবসা হবে না বেশী মুনাফা অর্জনের জন্য।
তখন সব MBA, MHA (Masters in Hospital Administration) এই সব গালভরা কোর্সগুলো স্বীকৃত ও জনপ্রিয়তা পেলো। এবং মানুষের জীবন ও যন্ত্রণা সম্বন্ধে কোনও ধারণা না থাকা এদেরকে ম্যানেজার করে (এইচ আর ডিপার্টমেন্ট) হাসপাতালের সবার মাথার উপরে বসিয়ে দেওয়া হলো বিশেষ কুটিল উদ্দ্যেশ্যে।
অনেকক্ষেত্রে এইসব MBA, MHA কোর্স এমনকি ডিস্টান্স বা অনলাইন মোডেও করা যায়। কোনও রোগী, হাসপাতাল বা চিকিৎসকের সাথে সময় কাটানোর প্রয়োজন হয় না এদের, এটা অনেকটাই বই পড়ে সাইকেল চালানো বা সাঁতার শেখার মতো বলা যায়। এইসব MBA, MHA-রা অধিকাংশই চিকিৎসক নন, এবং তাঁদের বেশির ভাগ অনেকেই খুবই নিম্ন মেধারও। চিকিৎসকদের মতন তাঁদের ষোলো-সতেরো ঘণ্টা করে রোজ পড়াশুনো ও বা হাসপাতালের আউটডোর বা ইনডোরে ডিউটি করতে হয় না, এবং টানা ৩৬ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করার কথাতো দূর অস্ত। রোগী বা তাঁর আত্মীয়দের সাথে তাঁদের কোনও রকম আত্মিক যোগাযোগও হয় না।
অসহায় রোগীর আত্মীয়দের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা তাই ইতস্তত না করেই বলতে পারেন, ” তোমার/আপনার রোগীকে বাঁচাতে হলে আরও টাকার জোগাড় করো/করুন। না হলে চিকিৎসা হবে না।” তাঁরা শুধুই টাকার অঙ্কের সংখ্যাটাই চেনেন। আর জানেন কিভাবে তাঁদের সেই হাসপাতালের লাভ হবে এবং নিজেদের বেতনও চড়চড়িয়ে বাড়বে।
চিকিৎসাশাস্ত্রে কিন্তু শুধুই মানুষের জীবন বাঁচানোর পদ্ধতিই শেখানো হয়, হাসপাতালের ব্যবসায় লাভ বা লোকসান ব্যাপারটা একদমই শেখানো হয় না। চিকিৎসকরা অন্তত ডাক্তারি পড়ার সময় ব্যবসাটা শেখেন না। অন্যদিকে এই ‘ম্যানেজার’রা তাঁদের সম্পূর্ণ কোর্সে শুধু সংখ্যা আর লাভ করার উপায়গুলিই শেখেন। সেখানে মানবিকতার কোনও স্থান নেই কিন্তু।
ব্রিটিশরা আমাদের দেশে প্রথমে ব্যবসা করতেই এসেছিলো। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা পুরো ভারতবর্ষকে দখল করেছিলো। ম্যানেজাররাও প্রায় তাই করেছেন। ব্রিটিশরা যেভাবে ভারতীয় রাজাদের উপর নানা রকম নিয়মকানুন, ট্যাক্স চালু করেছিলো, তাঁদের স্বাধীনতা খর্ব করেছিলো, ঠিক তেমনই বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজাররাও তাঁদের চিকিৎসকদের উপর নানারকম নিয়ম কানুন চাপিয়ে তাঁদের বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরাধীন দাস বানিয়ে ছেড়েছেন বেশীরভাগই ক্ষেত্রেই।
বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি…?
প্রথমে সাধারণ, এবং নতুন সদ্য MD/ MS/ DM/ Mch পাশ করা চিকিৎসকদের টার্গেট করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ চিকিৎসকেরাই শান্তশিষ্ট ও ভদ্র হয়ে থাকেন। তাঁরা সাধারণত নিজের ডিউটির বাইরে অন্য কিছুতেই নিজেদের মাথা ঘামাতে চান না, তাঁরা ভীষণ কর্তব্যপরায়ণও আমরা সেটা দেখেছি । স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা খুব দ্রুত এটা বুঝতে পেরেছেন, কারণ ওনারা টাকা কামাতে এসেছেন, সমাজসেবা করতে আসেন নি মোটেই। পরে নামকরা চিকিৎসকেরাও ছাড় পাননি কিন্তু। আগে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসকদের “স্যার” বা “ম্যাডাম” বলে ডাকা হতো। কিন্তু এই সমস্ত ম্যানেজাররা এখন অনেকক্ষেত্রেই সরাসরি চিকিৎসকের নাম ধরে ডাকেন আমরা সেটাও এখন দেখতে পাই। ভাগ্য খুব ভালো হলে সম্বোধনে ডাক্তার লাগান যেন দয়া করে। বারবারই তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, এই হাসপাতালে বাকি পাঁচজনের মত তাঁরাও একজন সামান্য বেতনভুক কর্মচারী মাত্র। আর কিছু নন।
আস্তে আস্তে এটাই বেসরকারী ডাক্তারদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে, কিছু ব্যাতিক্রম হয়ত এখনও আছে। সব কিছুই প্রায় সকলে মেনেও নিয়েছেন। এমনকি, কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা এটাও মেনে নিয়েছেন, যে হাসপাতালে তাঁরা কাজ করেন, সেখানেও পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি পার্ক করার জন্য তাঁদের পার্কিং চার্জও দিতে হয়, খোঁজ নিয়ে দেখে নিতে পারেন।
আবার অনেক চিকিৎসকদের অহরহ শুনতে হয়, “কে আপনাকে মশাই রোগীকে ছাড় দিতে বলেছে….?”। ” ঠিক আছে, আমরা রোগীকে সাহায্য করার জন্য আপনার প্রতিদিনের ১০০০টাকা ফি বাদ দিয়ে দেবো, কিন্তু আপনার রোগীকে বাকি দুলক্ষ টাকা দিতে হবে। না হলে আপনার পরবর্তী ছয় মাসের মাইনে থেকে আমরা সেই টাকা কেটে নেবো ইনস্টলমেন্টে।” এইরকম অপমান জনক কথাও শুনতে হয় তাঁদের।
আর, সবচেয়ে অপমানকর কথা, “ডাক্তার বাবু, আপনি কিন্তু গত তিনমাসের টার্গেট পূরণ করতে পারেননি।” অর্থাৎ আপনি গভীর বিপদের মধ্যে আছেন। হ্যাঁ, ওনারা টার্গেট বেঁধে দেন তাঁদের ওখানকার প্রতিটি ডাক্তারদের। এটাই এখন প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ম। এর ফলেই যত করাপশন। টার্গেট পূর্ণ করতে হবে যেনো তেনো উপায়ে। না হলে ডাক্তারের চাকরি থাকবে না।
এই বিপদের সাথে রোগীর প্রতি গাফিলতির কোনও যোগাযোগ নেই একদম। চিকিৎসকের জ্ঞান বা মেধার সাথে কোনও যোগাযোগ নেই। এই বিপদ শুধু হাসপাতালের তহবিলে উপযুক্ত অর্থ তুলে না দিতে পারার জন্য এবং আদর্শবাদী ও রোগী-দরদী চিকিৎসকেরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বিপদের সম্মুখীন হন আজকাল। বাকি চিকিৎসকেরা আস্তে আস্তে অভিযোজন ঘটিয়ে নিজেদের কর্পোরেটের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার মেশিনে নিজেকে পরিণত করেন। এবং তাঁরাই এই সমস্ত MBA, MHA- দের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন ও বিপদ সীমার বাইরে থাকেন, কখনো সপরিবারে বিদেশ যাবার ফ্রি ভাউচারও পান বোধ হয়।
প্রায় সব চিকিৎসকই পেশার শুরুতে অনেক আদর্শ নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু আস্তে আস্তে সরকারি নিয়ম কানুন, সামাজিক নিয়ম কানুন, এবং বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজারদের নিয়ম কানুন তাঁদের চামড়া মোটা করে দেয় তাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। যাঁরা মেরুদণ্ড সোজা রাখেন, তাঁরা এই ব্যবস্থার অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হন, অনেকেই ইস্তফা দেন।
মনে হয় সময় এসেছে, চিকিৎসক সমাজের গর্জে ওঠার সময় আজ। জোর গলায় বলার, কোনও MBA, MHA নয়, এমনকি আইএএস বা WBCS অফিসারও নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নেতৃত্ব দেবেন শুধুমাত্র চিকিৎসকেরাই। চিকিৎসকদের দেখতে হবে স্বাস্থ্য ব্যবসা অন্য আর পাঁচটা ব্যবসার মতো গলা কাটা ব্যবসা যাতে না হয়ে ওঠে, আজকাল অনেক চিকিৎসক টিভির পর্দায় লেকচার ঝাড়েন, ন্যায়ের কথা বলেন, বাস্তব জীবনে একটা নয়া পয়সা ও নিজেদের ভিজিট বা ওটি চার্জ বাবদ মকুব করেন না।
সংবাদপত্র খুললেই এখন বিভিন্ন সুসজ্জিত নার্সিং হোমের কুৎসিত বিজ্ঞাপন। শহরের মুখ ঢেকে গেছে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং-এ। অথচ ত্রিশ বছর আগেও যখন বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা চিকিৎসকদের হাতে ছিলো, তখন কিন্তু এভাবে হাসপাতালের নামে বা নিজেদের নামে বিজ্ঞাপন দেওয়াটাকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো, মনে করার চেষ্টা করুন।
আজ, সকলেরই ভাবার সময় এসেছে শিক্ষা স্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কেন এভাবে ব্যবসা চলবে। সময় এসেছে এসেছে এই সব ম্যানেজারদের অন্য কাজ খুঁজে নিতে বলার। না হলে রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ের দুর্ভোগ বাড়বে বই কমবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মত বিষয়ের দিকে আজ বিশ্ব পুঁজি হায়নার মত তাকিয়ে আছে। ভারতবর্ষে স্বাস্থ্যব্যবসাটা কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।