ডিমেনশিয়া। স্মৃতিভ্রংশ। এক অদ্ভুত রোগ, যার উত্তর বেশিরভাগটাই এখনো অজানা। রোগ ধরে ফেলা যায়, কিন্তু চিকিৎসা চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এই রোগে এতো তাড়াতাড়ি চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যায়, এতো তাড়াতাড়ি একটা মানুষ পিছিয়ে যেতে পারে জীবনের ‘টাইমলাইন’ ধরে — না দেখলে বিশ্বাস হয় না! রোগ তো নয়, যেন সিসিফাসের পাথর! গড়িয়ে পড়া আটকানোর চেষ্টা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা সফল হয় না, পাহাড়ের মাথায় তোলা তো দূরের কথা….
একটা মানুষ। স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে পড়াশোনা। প্রথমে কলেজে, পরে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি। হঠাৎই চার বছর আগে ছোট্ট মেয়ে লক্ষ্য করে, বাবা বিয়োগ করতে পারছে না। মাকে জানায়, মা প্রথমে হেসে উড়িয়ে দেয়, পরে দেখে ব্যাপারটা সত্যিই! বাজারের হিসেব করতে না পারা, তারপর ঘড়ি দেখতে না পারা। তারপর শুরু হয় লোকজনের সামনে সামাজিক ব্যবহার ধরে রাখতে না পারার সমস্যা। গালাগালি দিয়ে ফেলেন, মারধর করতে যান, করেও ফেলেন। একটা কথাও মনে রাখতে পারেন না, একটা বাক্যের জায়গায় তিনটে বাক্য বলতে গেলে মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। আমি আঁকতে দিলাম একটা ঘড়ি, উনি একটা গোল এঁকে মুখে বিভিন্ন আওয়াজ করতে করতে গোলের ভেতর আরো কয়েকটা গোল এঁকে দিলেন। ফ্রন্টো-টেম্পোরাল ডিমেনশিয়া। বয়স তো কমই এখনো, ৪৯ সবে। আর্লি অনসেট। স্ত্রী এর গলায় হতাশা, কষ্ট। বাড়ির একমাত্র আর্নিং মেম্বার, এখন কোনোমতে অনেকদিন পর পর স্কুলে গিয়ে সই করিয়ে এসে চাকরিটা বজায় রেখেছেন। এরপর কী হবে জানেন না। বাড়িতে অকারণে রাগারাগি, হিংস্রতা, মারধোর। চোখের কোণে ‘কেয়ারগিভার ডিস্ট্রেস’ চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে চায়, কোনোমতে সামলে রাখেন…
একটা মানুষ। আগে ইউনেস্কোর বড় পদে চাকরি করেছেন। বিদেশে থেকেছেন। রিটায়ারমেন্টের পর শুরু হলো ভুলে যাওয়া। নিজের পরিচয়টুকু মনে আছে, বাকিদের পরিচয় কখনো মনে পড়ে, কখনো পড়ে না। ডেটা কালেক্ট করবো শুনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কনসেন্ট ফর্ম পড়লেন, সই করলেন। ইংরেজি ফর্ম পুরো পড়ে নিজে ফিলআপ করলেন। কিন্তু মনে করেন না, নিজের কোনো রোগ আছে বলে। বুঝতে পারেন না, এটা সেন্টার না বাড়ি। অ্যালঝাইমার্স। হাসিখুশি। বন্ধুত্ব করতে ভালোবাসেন। স্ত্রী কবিতা লেখেন, তাঁর বই বেরোয়। স্বামীর রোগ হয়েছে, মেনে নিয়েছেন। যতটা সম্ভব খেয়াল রাখার চেষ্টা করেন, বাকি নিজের জীবনযাপন ও করেন। দুজনে মিলে মোটের উপর ভালোই আছেন।
একটা মানুষ। সারাজীবন পরিবারের খেয়াল রেখে এসেছেন, গৃহশ্রম করেছেন। আগে স্কুলেও পড়িয়েছেন। আজ দুবছর ধরে সবকিছু করতে ভুলে গেছেন। হাতে পেন দিলে উল্টো করে পেন ধরেন। কথায় কথায় কথা বুঝতে না পেরে হেসে ওঠেন। ঘরের আর কোনো কাজ করতে পারেন না। জামাকাপড় পরতে হয় কীভাবে, তাও ভুলে গেছেন। পরিয়ে দিতে হয়। ঘরের লোকের সামনে মাঝেমধ্যে সামাজিক লোকলজ্জা হারিয়ে ফেলেন, সেসব সামলাতে হয়। ফ্রন্টো-টেম্পোরাল ডিমেনশিয়া। স্বামী অসুস্থ। মেয়ে পড়াশোনা ও চাকরি করেন, মেয়েকেই সব সামলাতে হয়। মেয়ে বলছেন, যে সময়ে আমার মাকে পাশে পাওয়ার কথা ছিল, সেসময় আমাকে মায়ের পাশে থাকতে হয়।
এক অদ্ভুত রোগ। রোগ শুধু ওপিডিতে দেখলে বোঝা যায় না, ঘরের মধ্যে একটু উঁকি দিয়েও হয়তো দেখা উচিত। তবেই বোঝা যায়, একজন মানুষের রোগ কখনো কীভাবে পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। রোগের মারণশক্তি কতোটা, সেটা বোঝা যায় ঘরের লোকের সঙ্গে কথা বলে। দুর্ভাগা দেশ আমাদের, চার ঘন্টায় প্রতি ডাক্তারকে ১০০-২০০ রোগী দেখতে হয়। ডাক্তার বাড়ে, তবু রোগীর সংখ্যা কমে না। রোগের চিকিৎসাও তাই রোগীর চিকিৎসাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়…