মেন্টাল ডিপ্রেশন বা হতাশা নিয়ে কিছু লেখার জন্য অনেকেই আমাকে নানা সময়ে অনুরোধ করেছেন। আমি নিজেও এই বিষয়টা নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এত সীমিত জ্ঞান নিয়ে এমন বৃহৎ এবং জটিল জিনিসে হাত দিতে ঠিক সাহস হচ্ছিল না। তা যাইহোক, শেষমেষ একটা চলনসই গোছের বস্তু দাঁড় করানো গেছে এটাই রক্ষে ! প্রথমেই বলে রাখি যে এটা সম্পূর্ণভাবে একটা জন-সচেনতামূলক লেখা, যেখানে আমি চেষ্টা করেছি হতাশা সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা দিতে এবং তার গুরুত্বটা বোঝাতে। মূল উদ্দেশ্য হলো আপনি যেন নিজের এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মূল্যায়ন করতে পারেন, হতাশা-জনিত সমস্যায় ভুগছেন কি না সেটা বুঝতে পারেন, তার পরিমাপ করতে পারেন এবং প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নেওয়ার গুরুত্বটা অনুধাবন করতে পারেন। লেখাটা যদি আপনাদের সামান্যতম কাজে লাগে তাহলে যারপরনাই আনন্দিত হবো। যদি কেউ এই লেখাটা শেয়ার করতে চান তাহলে স্বচ্ছন্দে করতে পারেন, আলাদা করে আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
ভূমিকা শেষ, এবার মূলপর্বে যাওয়া যাক।
প্রথম কথা হলো হোয়াট ইজ মেন্টাল ডিপ্রেশন ? হতাশা মানে কি শুধুই মন খারাপ ? না, একদম না ! মন খারাপটা হতাশার অনেকগুলি লক্ষণের অন্যতম প্রধান লক্ষণ বটে, কিন্তু তার সাথে আরও কিছু সাইন্স অ্যান্ড সিম্পটমস্ থাকলে তবেই সেটাকে মেন্টাল ডিপ্রেশন বলা হয়।
হতাশা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। ধরন অনুযায়ী লক্ষণগুলোও ভিন্ন, তবে সেই শ্রেণী বিভাগের আগে কয়েকটা কমন লক্ষণ জেনে নেওয়া যাক, যেগুলো থাকলে সামগ্রিক ভাবে বোঝা যাবে কোনও ব্যক্তি হতাশাগ্রস্ত কি না :-
১) একটানা বেশ কিছুদিন ধরে মনমরা হয়ে থাকা, বা সহজ ভাষায় আমরা যাকে বলি ‘মুড অফ’ থাকা।
২) কোনো কিছুতে আনন্দ বা আগ্রহ না থাকা, অর্থাৎ loss of pleasure or interest বা “Anhedonia”.
শব্দটা এসেছে গ্রীক ‘Hedone’ থেকে, যার অর্থ সুখানুভূতি বা pleasure.
৩) উদ্যমহীনতা বা lack of energy.
৪). ঘুমের ব্যাঘাত বা sleep disturbance.
মনে রাখবেন, প্রত্যেক মানুষই এই লক্ষণগুলো কখনও না কখনও ফেস করে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে মেন্টাল ডিপ্রেশনে ভুগছে। যদি এগুলো একটানা বেশ কিছুদিন ধরে চলে এবং সেটা তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে লক্ষণীয় ভাবে প্রভাবিত করে তবেই আমরা বলবো যে হি বা শি ইজ সাফারিং ফ্রম ক্লিনিক্যাল মেন্টাল ডিপ্রেশন।
এবার আমরা আরেকটু গভীরে যাই, অর্থাৎ হতাশার শ্রেণীবিভাগ-গুলো একঝলক দেখে নিই, কেমন ?
১) MAJOR DEPRESSIVE DISORDER :-
****************************** ********
এর কয়েকটা বিশিষ্ট লক্ষণ আছে। লক্ষণগুলো মনে রাখার সহজ উপায় হলো “SIGECAPSD” নামক একটি mnemonic মাথায় রাখা, যেটা আমরা এবার আলোচনা করবো।
ক) S = SLEEP.
সাধারণত ঘুম কমে যায়, তবে কিছু atypical বা ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কমার বদলে ঘুম বেড়ে যেতে পারে।
খ) I = INTEREST, which refers to “Loss of Interest” :-
যেসব বিষয়ে সেই ব্যক্তিটি অত্যন্ত আগ্রহ বোধ করতো সেসব বিষয়গুলো আর তাকে টানবে না। পছন্দের কাজকর্মের প্রতি একটা ঔদাসীন্য এসে যাবে, এবং সেটা রীতিমতো অন্যদের চোখে পড়ার মতন।
গ) G = GUILT, বা অপরাধবোধ :-
কোনও এক বা একাধিক কারণে সেই ব্যক্তিটি প্রবল অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়। অপরাধটা সত্যি বা কল্পিত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তিটি চাইবে নিজের শাস্তি হোক, ফলে যাবতীয় আনন্দদায়ক বিষয় থেকে আস্তে আস্তে সরে আসবে। এই সেন্স অফ গিল্ট থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা আসাও বিচিত্র নয়।
ঘ) E = ENERGY, which refers to “Lack of energy”, বা উদ্যমহীনতা।
কোনো কাজেই উৎসাহ থাকবে না, ফলে ধীরে ধীরে উদ্যম হারিয়ে যাবে। পড়াশুনো, চাকরি, সংসার …. সব ক্ষেত্রেই সেই উদ্যমহীনতার প্রভাব পড়বে।
ঙ) C = CONCENTRATION, which refers to Loss of Concentration, অর্থাৎ মনঃসংযোগ কমে যাওয়া।
চ) A = APPETITE, which refers to lack of appetite :-
খাদ্যের প্রতি অনিহা আসা এবং রুচি কমে যাওয়া। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, ‘Hunger’ এবং ‘Appetite’ কিন্তু এক জিনিস নয় ! প্রথমটার অর্থ ক্ষুধা, এবং দ্বিতীয়টি খাদ্যরুচি। এখানে আমরা খাবারের প্রতি রুচি কমে যাওয়ার কথা বোঝাতে চাইছি।
ছ) P = PSYCHOMOTOR RETARDATION OR PSYCHOMOTOR AGITATION :-
হাঁটা, চলা, কাজে, কর্মে একটা শ্লথ অথবা অলস ভাব চলে আসে। এর বিপরীত অবস্থাটাও হতে পারে, অর্থাৎ অকারণ অস্থিরতা, যেমন ঘনঘন আঙুল মটকানো, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, বারবার হাত মুঠো করা, ঘরের মধ্যে উত্তেজিত ভাবে পায়চারি করা, ইত্যাদি। যাদের প্রথম থেকেই এরকম মুদ্রাদোষ আছে তাদের ক্ষেত্রে এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, কিন্তু যারা নতুন করে এই ধরনের সিম্পটমস্ বা লক্ষণ ডেভেলপ করছে তারা Major Depressive Disorder-এ ভুগতে পারে …. অতএব সেটা অবজ্ঞা না করে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
জ) S = SUICIDAL IDEATION, অর্থাৎ আত্মহত্যা করার বিষয়ে সিরিয়াসলি চিন্তাভাবনা করা।
এই লক্ষণটা হতাশায় আক্রান্ত যে কোনো রোগীর ক্ষেত্রেই খুব কমন ব্যাপার। যারা Major Depressive Disorder-এ ভোগে তাদের প্রায় ৭৫ শতাংশের মধ্যে suicidal ideation পাওয়া যায়। এর সাথে কিন্তু ‘suicidal tendency’ গুলিয়ে ফেললে চলবে না ! দ্বিতীয়টার মানে হলো আত্মহত্যার প্রবণতা, আর সেটা নিয়ে যখন রীতিমতো চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পনা করা হয় তখন তাকে suicidal ideation বলে। এর মানে এই নয় যে সেই ব্যক্তিটি আত্মহত্যা করবেই, কিন্তু এই বিষয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কল্পনা করে কষ্ট পাওয়ার আনন্দ, যাকে কেতাবি ভাষায় মর্ষকামীতা বা Masochism বলে। বিষয়টা একদমই উপেক্ষা করার মত নয়, কারণ দিনের পর দিন এরকম ideation করতে করতে ব্যক্তিটি একসময়ে সত্যিই আত্মহত্যার প্রচেষ্টা নিতে পারে।
ঝ) D = DEPRESSED MOOD :-
যে লোকটা ডিপ্রেশনে ভুগছে তার মুড যে ডিপ্রেসড্ থাকবে তা বলাই বাহুল্য, সুতরাং এই পয়েন্টটা আপাতদৃষ্টিতে বোকা-বোকা ঠেকাই স্বাভাবিক। কিন্তু না, এটা কোনও সাধারণ মুড অফ নয়, বরং একটা বিশেষ ধরণের মনখারাপের ভাব, যাকে “মেলাঙ্কলিয়া” বলা হয়। কথাটা এসেছে গ্রীক ‘Melanos’ আর ‘Cholos’ শব্দ থেকে, যার সমষ্টিগত অর্থ হলো ‘black bile’ বা কালো পিত্তরস। গ্রীক ভাষায় melanos মানে কালো, আর cholos মানে bile বা পিত্তরস। তখনকার দিনে এটাই বিশ্বাস করা হতো যে লিভার যখন অসুস্থ হয়ে কালো রঙের পিত্তরস উৎপাদন করে তখনই মানুষ অবসাদ, মনখারাপ, ইত্যাদি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। সেই থেকেই এটার নামকরণ করা হয়েছে Melancholia.
মেলাঙ্কলিয়ার কয়েকটা বিশেষ লক্ষণ আছে, সেগুলো একটু আলোচনা করা যাক। এই লক্ষণগুলো থেকেই বোঝা যাবে যে কেউ সাধারণ মনখারাপে ভুগছে নাকি মেলাঙ্কলিয়ায় আক্রান্ত।
a) কোনও নির্দিষ্ট অথবা সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই হতাশা এবং অবসাদ।
b) Daytime or morning depression – অর্থাৎ অবসাদগ্রস্ত ভাবটা প্রধানত দিবাভাগে হয়। এখানে বলে রাখা ভালো যে পরিসংখ্যানগত ভাবে যদিও দেখা গেছে যে দিবাকালীন অবসাদটাই বেশি হয়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সান্ধ্য অথবা রাত্রিকালীন অবসাদ হবে না ! সুতরাং কেউ যদি দিনে চনমনে, রাতে বিমর্ষ থাকে তাহলেও এই পয়েন্টটা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
c) খাদ্যের প্রতি রুচি, অর্থাৎ ‘Appetite’ কমে যাওয়া। ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে অবশ্য কমার বদলে বেড়ে যেতে পারে, তবে সাধারণত কমেই যায়।
d) Increased REM sleep – আমাদের ঘুমের মধ্যে দুরকম phase চলে, একটা Non-rapid eye movement অর্থাৎ NREM sleep, আরেকটা Rapid eye movement অর্থাৎ REM sleep. আমরা স্বপ্ন দেখি REM sleep-এর সময়। তবে যাইহোক, এই বিষয়টা নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করছি না, কারণ এটা বোঝার দায়িত্ব ডাক্তারের। আক্রান্ত ব্যক্তি বা তার বাড়ির লোক এটা বুঝতে পারবে না।
এতক্ষণ আমরা Major Depressive Disorder সম্বন্ধে আলোচনা করলাম, এবার চলুন আরেক ধরণের ডিপ্রেশনের আলোচনায় যাই।
২) CHRONIC DEPRESSION :-
******************************
এর আরেক নাম Dysthymia, যেটা এসেছে গ্রীক ‘dys’ এবং ‘thumos’ শব্দ থেকে। কথাটার সমষ্টিগত অর্থ হলো প্রাণশক্তি বা আবেগের ঘাটতি, যাকে এককথায় ‘allergic to happiness’ বলা যেতে পারে।
এই গোত্রের ডিপ্রেশনে যাঁরা আক্রান্ত হন তাঁদের আনন্দে বা ফুর্তিতে থাকতে ইচ্ছে করে না। সবসময়ে একটা বিমর্ষ ভাব। এই ভাবটা কয়েকদিন বা কয়েকমাস চললে অন্য কথা, কিন্তু যখন দুবছর বা তার অধিক সময় ধরে একই অবস্থা চলে তখনই সেটাকে chronic depression বলা হয়। এটা Major Depressive Disorder-এর থেকে তুলনামূলকভাবে কম খতরনাক বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে গুরুত্বহীন ! ঠিক সময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে এর থেকেই আরো জটিল ধরণের হতাশা বা অন্যান্য জটিলতর মনরোগ ডেভেলপ করতে পারে, তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই chronic depression-এর সাথেই major depressive disorder জড়িয়ে থাকে। অতএব chronic depression ঠিকমতো আইডেন্টিফাই করা এবং সেটা কাটানোর জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আইডেন্টিফাই করার জন্য যে লক্ষণগুলির দিকে নজর রাখতে হবে সেটা জন্য একটা mnemonic আছে – “ACHEWS”.
এবার দেখা যাক লক্ষণগুলো কি কি :-
ক) A = APPETITE DEFICIENCY, বা খাদ্যের প্রতি অনিহা বা রুচি কমে যাওয়া।
খ) C = CONCENTRATION DEFICIT, বা মনঃসংযোগ কমে যাওয়া।
গ) H = HOPELESSNESS, বা নিরাশ ভাব। সর্বক্ষণ মনের মধ্যে হা-হুতাশ, ‘ধুর, আমার দ্বারা কিস্যু হবে না’ টাইপ চিন্তাভাবনা, জীবনের প্রতি সার্বিক ভাবে negative approach, ফলে কাজকর্মে উৎসাহ কমে যাওয়া ইত্যাদি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
ঘ) E = ENERGY DEFICIT.
মনের মধ্যে নিরন্তর নিরাশতা থাকলে এনার্জি তো কমে যাবেই ! এ আর নতুন কথা কি !
ঙ) W = WORTHLESSNESS
এটাও ওই নিরাশ ভাবের সাথে যুক্ত। নিজেকে পৃথিবীর বোঝা হিসাবে ভাবা, অপরাধবোধ, ইত্যাদি।
চ) S = SLEEP DISTURBANCE
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুম কমে যায় অথবা quality of sleep কমে যায়, তবে কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে উল্টোটাও হতে পারে।
৩) PSYCHOTIC DEPRESSION :-
****************************** **
এবার চলুন আরেক ধরণের ডিপ্রেশনের কথা আলোচনা করা যাক, যার পোশাকি নাম Psychotic Depression.
এটা বেশ গুরুতর ভ্যারাইটির ডিপ্রেশন, কারণ ঠিক সময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে এর জের হসপিটালাইজেশন পর্যন্ত গড়াতে পারে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে অন্যান্য ভ্যারাইটি-গুলোয় কখনও হসপিটালাইজড্ হতে হয় না, তবে psychotic depression-এ তুলনামুলকভাবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারটা বেশি। আসুন এর সাইন্স অ্যান্ড সিম্পটমস্-গুলো একটু দেখে নেওয়া যাক :-
ক) ANXIETY বা উদ্বেগ –
আমরা সবাই কমবেশি উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগি, তবে এক্ষেত্রে সেটা ঘোরতর আকার ধারণ করে। কোথাও একটু জোরে আওয়াজ হলো অথবা বাসনপত্র পড়ে গেল, তাতেই বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে যায়। দূরে কোথাও চেঁচামেচির আওয়াজ শুনলে মনে হয় নির্ঘাৎ আমার বাড়িতে হামলা করতে আসছে। ট্রেনে চাপলে মনে হবে এই বুঝি ট্রেন বেলাইন হয়ে গেল অথবা মুখোমুখি আরেকটা ট্রেনের সাথে ধাক্কা খেলো।
নিজের শরীর নিয়েও দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। সারাক্ষণ মনে হয় আমার এই হয়েছে, তাই হয়েছে …. ফলে কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে ছোটে। এঁদের কাছে প্রায়শই একগাদা ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট দেখতে পাবেন, তাতে রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে ইউএসজি, সিটি স্ক্যান …. কিছুই বাদ নেই ! অথচ সব রিপোর্ট নর্মাল। কিন্তু নর্মাল থাকলেও তাকে বোঝানো যায় না যে সে একজন সম্পূর্ণ সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ। এই জিনিসটার একটা ডাক্তারি নাম আছে – ‘HYPOCHONDRIACAL SYNDROME’.
‘Chondros’ মানে হলো cartilage বা তরুণাস্থি, যেটা এক্ষেত্রে আমাদের পাঁজরের হাড়কে বোঝাচ্ছে। ‘Hypo’ মানে নিচু বা তলায় অবস্থিত। অর্থাৎ Hypo + Chondros = পাঁজরের তলায় অবস্থিত একটি অঙ্গ, যেটা হলো গিয়ে লিভার। তখনকার দিনে এটাই বিশ্বাস করা হতো যে নিজেকে অসুস্থ বলে কল্পনা করাটা একটি লিভার-ঘটিত রোগ, তাই এমন নামকরণ।
আশাকরি মোটামুটি বুঝতে পেরেছেন Anxiety বলতে আমরা এখানে কোন লেভেলের উদ্বেগের কথা বোঝাতে চাইছি। অনেকেই হয়তো ভাবছেন “হা ভগবান, আমারও তো ঠিক এরকমই হয় ! তাহলে কি আমার ঘন্টি বেজে গেল ?”
তাঁদের আশ্বস্ত করে বলছি, একদম আতঙ্কিত হবেন না ! কারো anxiety বেশি থাকা মানেই যে তার psychotic depression আছে তা কিন্তু নয় ! যদি দেখা যায় উদ্বেগজনিত সমস্যা ছাড়াও তার মধ্যে psychotic depression-এর আরো কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তবেই সেটা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক বা গুরুত্বপূর্ণ, নচেৎ নয়।
খ) PARANOIA –
কথাটা এসেছে গ্রীক Para (abnormal) + Noos (mind) থেকে, যার সরল অর্থ মানসিক বৈকল্য বা মস্তিষ্কবিকৃতি। বেশ কিছু জটিল টাইপের মানসিক রোগে এই লক্ষণটা দেখা যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো Schizophrenia বা স্কিৎজোফ্রেনিয়া।
প্যারানয়েড পার্সোনালিটির ক্ষেত্রে নানা রকমের মানসিক বিভ্রম ঘটতে পারে। এঁদের মনটা সাধারণত প্রচন্ড সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। অলীক, ভিত্তিহীন, অথচ বদ্ধমূল সন্দেহ। মনে হয় সবাই বুঝি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, সে নিজের বাবা-মা হোক অথবা নিতান্তই অপরিচিত অথবা অর্ধপরিচিত কোনও ব্যক্তি হোক। স্বামী, স্ত্রী বা সন্তানের ব্যাপারে এঁরা নানারকম কল্পিত সন্দেহ করেন, এবং তাদের গতিবিধির বিষয়ে অত্যুৎসুক বা hypervigilant হয়ে ওঠেন। এমনকি এও দেখা গেছে যে কেউ কেউ তাঁর স্বামী বা স্ত্রীর উপর নজর রাখতে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের শরনাপন্ন হয়েছেন।
এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার megalomania-তে আক্রান্ত হন। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ বলে মনে করেন, যাকে বলা হয় ‘de la grande’ effect, অর্থাৎ আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট। এমনও ঘটনা আছে, যেখানে রোগীর ধারণা তিনি দয়া করে রয়েসয়ে প্রস্রাব করেন বলেই পৃথিবীটা এখনও টিঁকে আছে, নইলে যদি যুৎসই ভাবে মূত্রথলি খালি করতেন তাহলে অ্যাদ্দিনে পৃথিবী ভেসে যেত। ভাববেন না মজা করছি ! এরকম সত্যিই ঘটে ! প্যারানয়েড সিনড্রোম একটি অতি বিষম বস্তু। এর থেকে delusion, illusion, hallucination …. যা খুশি ঘটতে পারে, এবং সেই জন্যই psychotic depression এতখানি গুরুত্বপূর্ণ।
গ) DELUSION, অর্থাৎ ‘false belief’, বা এক কথায় বিভ্রম –
যেটা নেই সেটা বিশ্বাস করা যে আছে, অথবা যেটা আছে সেটাকে নেই বলে বিশ্বাস করা। অলীক, অবান্তর কল্পনা, যেমন ধরুন কেউ আমার মনের কথা বুঝে ফেলছে এমনটা ভাবা, অথবা কাউকে ছদ্মবেশী উগ্রপন্থী বলে খামোখা সন্দেহ করা, ইত্যাদি। মোটকথা, Delusion-এর কোনও মা-বাপ নেই। আক্রান্ত ব্যক্তি যেমন খুশি কল্পনা করে এবং সেটাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। মনোবিদ্যার জগতে এটা একটা ভয়াবহ বিভ্রম, যার আশু চিকিৎসা দরকার।
ঘ) HALLUCINATION –
শব্দটার সঠিক বাংলা ঠিক জানি না, তবে আলগোছে ‘দৃষ্টিবিভ্রম’ বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিটি নানারকম জিনিস দেখে, যেটার কোনো অস্তিত্ব নেই। যেমন ধরুন বাথরুমে ঢুকে দেখলো ভিতরে একটা সাপ শুয়ে আছে, অথচ সেখানে আদতে কিছু নেই। যদি এমন হতো যে বাথরুমের মধ্যে কোনো লাঠি অথবা দড়ি দেখে লোকটা সাপ বলে ভুল করছে তাহলে সেটাকে আমরা ‘ILLUSION’ বলতাম। অর্থাৎ ‘রজ্জুতে সর্পভ্রম’ হলে সেটা illusion, আর রজ্জু ছাড়াই সর্পভ্রম হলে সেটা hallucination …. বোঝা গেল ?
Psychotic depression-এ illusion হতেই পারে, তবে সেটা এখানে খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়, কারণ স্থান কাল পরিবেশের প্রভাবে সুস্থ লোকেরও illusion হতে পারে। যেমন ধরুন আপনি একটা গ্রামে বেড়াতে গেছেন। শীতের রাত। ঝেঁপে কুয়াশা পড়েছে। ঝাপসা চাঁদ, মায়াময় আলো। এমন সময়ে আপনি দেখলেন দূরে একটা ঘোমটা পরা বউ দাঁড়িয়ে আছে। ওটা নির্ঘাৎ কোনও শাঁকচুন্নী হবে, এই ভেবে আপনি দাঁতকপাটি খেয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলেন। একবারও মাথায় এলো না যে ওটা আসলে একটা কলাগাছের পাতা, যেটাকে ওই পরিবেশে দুলতে দেখে আপনার illusion হচ্ছে !
ঙ) Disorganised Speech and/or Behaviour –
অর্থহীন বা ভুলভাল কথাবার্তা, কাজকর্মে সামঞ্জস্য না থাকা, ইত্যাদি।
এছাড়া ডিপ্রেশনের অন্যান্য লক্ষণগুলোও এখানে কমবেশি থাকবে, তবে সেগুলো আমরা আগেই আলোচনা করেছি বলে আর বিস্তারিত বিবরণে যাচ্ছি না।
৪) BIPOLAR DEPRESSION :–
****************************
এর আরেক নাম MANIC-DEPRESSIVE PSYCHOSIS, তবে Bipolar Depression নামেই বেশি পরিচিত। এটা আরেকটি মারাত্মক ধরণের ডিপ্রেশন, যেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত-ধর্মী দুটো অবস্থা চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। একবার প্রবল হতাশা, তার পরেই মাত্রাছাড়া টগবগে ভাব …. আবার হতাশা, তারপর আবার সেই বে-লাগাম উচ্ছ্বাস বা অস্থিরতা …. এভাবেই চলতে থাকে।
এক একটা phase কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস ধরে চলে। দুটোর মাঝে একটা ‘normal phase’ আসে বটে, তবে সেই স্বাভাবিক অবস্থাটা কার কতদিন চলবে সেটা ব্যক্তি অনুযায়ী নির্ভর করে।
মুড প্রচন্ডরকম চেঞ্জ হয়। ডিপ্রেশনের ধরণটা ক্ষেত্রবিশেষে major depressive disorder অথবা psychotic depression-এর মতন, অতএব সেসব লক্ষণগুলো আর নতুন করে আলোচনা করছি না। বরং দেখা যাক manic phase-এর লক্ষণগুলো কি কি :-
ক) Abnormally high energy level –
উদ্যম এবং কর্মক্ষমতা খুব বেড়ে যায়, সেটা কাজের জায়গাতে হোক অথবা বাড়িতে হোক। সর্বক্ষণ একটা চনমনে উত্তেজিত ভাব, হই-হুল্লোড় করা, ইত্যাদি। এগুলোর কোনটাই সেই অর্থে খারাপ জিনিস নয়, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত হলে সমস্যা তো বটেই ! তাছাড়া যে মানুষটার প্রথম থেকেই এরকম স্বভাব তার কথা ভিন্ন, কিন্তু এক্ষেত্রে সে প্রশ্নটা আসছে না, তাই না ?
খ) Overconfidence –
নিজের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আস্থা, যেটা সময়ক্ষেত্রে অযৌক্তিকও বটে। “আমাকে গুলি করলেও আমার কিছু হবে না” টাইপের হাবভাব। মদ্যপান করলে মানুষের মন থেকে যেমন ‘ইনহিবিশন’ চলে যায়, এটাও অনেকটা সেরকম ব্যাপার। যে লোকটা অফিসের মিটিং-এ কখনও মুখ খোলে না, অথবা ভুলভাল ইংরেজী বলার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে, সেই লোকটাই এখন মিটিং-এ সরব হবে, আগ বাড়িয়ে বক্তব্য পেশ করবে, ফড়ফড় করে ইংরেজী বলবে ….. মানে ইনহিবিশন চলে গেলে যেগুলো হয় আর কি !
সাধারণ বিচারে এটা কখনোই নিন্দনীয় নয়, বরং প্রশংসনীয় …. কিন্তু এক্ষেত্রে এই অস্বাভাবিক, অনিয়ন্ত্রিত আত্মবিশ্বাসটা আদতে bipolar depression-এর একটা লক্ষণ।
গ) Increased libido or sex-desire –
যৌন-চাহিদা বেড়ে যায়, এবং পুরুষের ক্ষেত্রে যৌন-ক্ষমতাও বেড়ে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মেই যৌনক্রীয়া এমন একটা ব্যাপার যেখানে নারীকে তার যৌন-ক্ষমতার পরিচয় দিতে হয় না, কিন্তু পুরুষকে দিতে হয়, বা বলা যেতে পারে সেই ‘চ্যালেঞ্জ’-টা নিতে হয়। “চ্যালেঞ্জ ঠিকমত নিতে পারবো কি না” – এই চিন্তা বা মানসিক উদ্বেগটাই পুরুষের যৌন-দুর্বলতার প্রধান কারণ। কিছু কিছু জেনুইন শারীরিক কারণ আছে ঠিকই, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই মানসিক উদ্বেগটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এখানে যেহেতু manic phase-এ আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় সেহেতু যৌন-দুর্বলতার পিছনে যে মানসিক কম্পোনেন্ট বা উপাদান আছে সেটা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায় …. ফলে যৌনক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে।
ঘ) Decreased sleep –
স্নায়বিক উত্তেজনার কারণে ঘুম এবং ঘুমের চাহিদা কমে যায়। ঝিমুনি ভাবও বিশেষ থাকে না। সারাক্ষণ মনের মধ্যে “এইটা করতে হবে, সেইটা করতে হবে” ধরণের প্রক্রিয়া চলে। Activity এবং productivity, দুটোই বেড়ে যায়।
ঙ) Irrational behaviour –
কাজকর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না। ‘ম্যানিক’ অবস্থায় খরচের হাত সাধারণত বেড়ে যায়, এবং সেটা আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন হলেও তারা পরোয়া করে না। দুমদাম শপিং করা, দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়া, অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার বাতিক, বন্ধুদের কথায় কথায় ট্রিট দেওয়া, ইত্যাদি বিষয়গুলো লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
চ) Poor judgement –
বিচার-ক্ষমতা কমে যাওয়া, অপরিণামদর্শিতা, নিজের মতটাই শেষ কথা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মত – এই ধরণের বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মানো। এটাও সেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং ‘de la grande’ effect-এর ফল।
এছাড়া আরো কিছু লক্ষণ আছে, তবে আমরা যেটুকু আলোচনা করলাম তাতে আশাকরি Bipolar Depression সম্বন্ধে একটা সামগ্রিক চিত্র পেয়ে গেছেন।
Psychotic depression- এর মতো এক্ষেত্রেও হসপিটালাইজেশনের হার বেশি, এবং তারচেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো রোগীকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানো। ডিপ্রেশন চলাকালীন যদিও বা সে ওষুধ খেতে রাজি থাকে, কিন্তু manic phase এলেই রুগি আর ওষুধ খেতে চায় না। তার নিজের কাছে এটা একটি অতি আনন্দময় সময়, অতএব সে ওষুধ খেতে চাইবেই বা কেন ? এই সময়ে বাড়ির লোকের সাপোর্ট অত্যন্ত প্রয়োজন, নইলে শুধু ওষুধ আর কাউন্সেলিং-এ কাজ হবে না।
৫) SEASONAL AFFECTIVE DISORDER :-
****************************** *********
এটা নিয়ে আমাদের খুব বেশি চর্চার প্রয়োজন নেই। মোটের উপর জেনে রাখুন যে এই ধরণের হতাশার সঙ্গে শীত বা গ্রীষ্মকালের যোগ আছে। বেশি হয় শীতকালে এবং শীতপ্রধান দেশে। ফাঁকা জায়গা, ঘন বসতির অভাব, বাড়িগুলো সব দূরে দূরে, তার মধ্যে চতুর্দিক বরফে ছেয়ে গেছে। বাইরে বেরোনোর সুযোগ কম, এই অবস্থায় ওইরকম পরিবেশে থাকতে থাকতে একসময়ে তীব্র হতাশা গ্রাস করে, যা থেকে সাঙ্ঘাতিক ধরণের মনোবিকার ঘটাও বিচিত্র নয়। এই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে একটা অসাধারণ সাইকোলজিক্যাল হরর মুভি আছে – “THE SHINING”. পারলে নেটফ্লিক্সে দেখে নেবেন। স্টিফেন কিং-এর লেখা, স্ট্যানলি কুব্রিকের পরিচালনা, আর জ্যাক নিকলসনের অভিনয় …. সবাই নিজের নিজের জগতের একেকজন কিংবদন্তী। ছবিটা দেখলে Winter Depression-এর ‘এ টু জেড’ বুঝে যাবেন।
Summer Depression যে একেবারে হয় না তা নয়, তবে তুলনামূলকভাবে অনেক কম, আর আমাদের দেশে খুব একটা প্রযোজ্য নয় বলেই আর কচকচানিতে যাচ্ছি না।
যাক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনাদের একটা ধারণা হয়ে গেছে কিভাবে নিজের অথবা বাড়ির কোনও সদস্যের ডিপ্রেশন আছে কি না সেটা বুঝবেন এবং অন্তত কিছুটা হলেও assess করবেন। আলোচনাটা এখানেই শেষ করবো ভাবছিলাম, কিন্তু আরও দুটো বিষয় নিয়ে একটু না বললে ব্যাপারটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। একটা হলো মেনোপজ-সংক্রান্ত ডিপ্রেশন, আরেকটা হলো আপনার নিজের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে কি না সেটা জানা, এবং থাকলে কতটা আছে সেটা নিজেই নির্ধারণ বা পরিমাপ করা। তাহলে চোখেমুখে জল ছিটিয়ে আরেকটু কষ্ট করে বসুন, ওইদুটো চ্যাপ্টার হয়ে গেলেই ক্লাস শেষ।
PERI AND POST-MENOPAUSAL DEPRESSION :-
****************************** ******************
মেনোপজ একটা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক ব্যাপার, যদি না নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কারো জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়। সেটাও অবশ্য মেনোপজ, তবে ন্যাচারাল মেনোপজ না, সার্জিক্যাল মেনোপজ। ন্যাচারাল মেনোপজের কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই, তবে আমাদের দেশের মহিলাদের সাধারণত পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মাঝামাঝি একটা বয়সে হয়। যদি চল্লিশের আগেই পাকাপাকি ভাবে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেটাকে premature menopause বলে।
পুরোপুরি মেনোপজ হওয়ার আগের কয়েকটা বছরকে perimenopausal period বলা হয়। এই সময়ে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে পড়ে, ব্লিডিং কখনও বাড়ে, কখনও কমে, কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর আবার হয়তো শুরু হয়ে গেল …. এভাবেই চলতে চলতে একসময়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। একটানা একবছর পিরিয়ডস্ বন্ধ থাকলে তখন বলা যেতে পারে যে এবার সত্যিকারের মেনোপজ হয়েছে, এবং তিনি এখন ‘post-menopausal stage’-এ আছেন।
সার্জিক্যাল মেনোপজের ক্ষেত্রে perimenopausal stage-টা ততটা বোঝা যায় না, কারণ সাধারণত সেই স্টেজটা আসার আগেই জরায়ু বাদ চলে যায়।
Perimenopause-এর সময় থেকেই নারীর দেহে ও মনে কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। এই পরিবর্তনগুলোর প্রধান কারণ হলো শরীরে Oestrogen নামক হরমোনের উৎপাদন কমে যাওয়া। ঋতুস্রাবের পরিবর্তন তো আছেই, তার সাথে ‘hot flashes’ অর্থাৎ হঠাৎ গরম লাগা, কান-মাথা দিয়ে ভাপ বেরোনো, ঘেমে যাওয়া, ইত্যাদি বিভিন্ন সিম্পটমস্ দেখা দেয়। এছাড়া হাড়ের সমস্যা, ঘনঘন মুড-বদল, মানসিক অবসাদ, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, যোনিপথের শুষ্কতা বা vaginal dryness হওয়া …. সব মিলিয়ে পরিবর্তনের লিস্টটা নেহাত ছোট নয় !
আমরা শারীরিক ব্যাপারগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা না করে বরং ডিপ্রেশনের বিষয়টায় যাই। মেনোপজ-সংক্রান্ত ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে perimenopausal stage, অর্থাৎ মেনোপজের আগের পর্বটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়টাতেই ডিপ্রেশন বেশি হয়, কারণ তখন হরমোনের পরিমাণ বদলাতে থাকে এবং ওঠানামা করে। পুরোপুরি মেনোপজ হওয়ার পর শরীরে ইস্ট্রোজেন-এর মাত্রা কমে গেলেও স্থিতিশীল থাকে, ফলে তখন হরমোন-জনিত শারীরিক সমস্যা বৃদ্ধি পেলেও মানসিক প্রবলেম তুলনামূলকভাবে কম হয়।
কি কি সমস্যা দেখা দেয় ?
সন্তানধারণের ক্ষমতা চলে গেলে এক ধরণের মানসিক হাহাকার আসতে পারে। “আমি আর বাচ্চা নেব না” সেটা এক জিনিস, কিন্তু “আমি আর কোনদিন সন্তান ধারণ করতে পারবো না” – এই অক্ষমতাকে মানিয়ে নেওয়া বড় সহজ নয় ! নিজের নারীত্বের অহংকার কোথাও না কোথাও চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, এমন একটা বোধ চলে আসে। পুরুষদের ‘মিডল-এজ ক্রাইসিস’-এর মতো মহিলাদেরও এই সময়ে এরকম ক্রাইসিস ঘটতে পারে। মনে হয় যেন আমার বয়স হয়ে গেছে, স্বামী আর ভালোবাসে না, সংসারে একটা কাজের লোক (বা চাকুরীরতা মহিলাদের ক্ষেত্রে উপার্জনের লোক) ছাড়া আমার কোনও ভ্যালু নেই, জীবনটা বৃথা হয়ে গেল, ইত্যাদি। অনেকেই আবার “আমি এখনও শেষ হয়ে যাইনি” টাইপের মরিয়া ভাব থেকে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের প্রতি ঝুঁকে পড়েন, যেটা হয়তো এতকাল তাঁর কাছে একটা অলীক অ্যাডভেঞ্চার অথবা নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল। এই সময়টায় স্বামী এবং সংসারের সাপোর্ট প্রচন্ড ভাবে দরকার। তার পাশে থাকা, তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যে সে কতখানি মূল্যবান এবং অপরিহার্য, তাকে বেশি করে সময় দেওয়া — এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজন। যেসব মহিলারা কমবেশি এরকম সাপোর্ট পান তাঁরা ডিপ্রেশনে অনেক কম ভোগেন, কিন্তু যাঁরা পান না তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই হতাশার হার অনেক বেশি।
মেনোপজ-সম্পর্কিত ডিপ্রেশনের আলাদা কোনও সাইন্স অ্যান্ড সিম্পটমস্ নেই। কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে সামলে নিতে পারলে ডিপ্রেশনের স্টেজটা কেটে যায়, নইলে chronic depression বা major depressive disorder-এর দিকে মোড় নিতে থাকে।
সমস্যার তীব্রতা বুঝে প্রয়োজনে মনোবিদের পরামর্শ দরকার, তাছাড়া স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞের নির্দেশে HRT, অর্থাৎ Hormone Replacement Therapy নিলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। তবে সেটা সম্পূর্ণ ডাক্তারি ব্যাপার বলেই এখানে আর বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। মোটকথা, মেনোপজ-সংক্রান্ত ডিপ্রেশন কখনোই অবজ্ঞা করবেন না, আর পুরুষদের বলছি – এই সময়টাতে স্ত্রীকে বিশেষ ভাবে সময় দেবেন, তার পাশে থাকবেন, নইলে আখেরে আপনারই বিপদ …… বুঝেছেন ?
SUICIDE PRONENESS SCALE
****************************** *
এবার দেখা যাক আপনার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে কি না এবং থাকলেও কতটা আছে। এখানে আমরা একটা systematic approach নেবো। একটা স্কেল আছে, নাম SADPERSONS SCALE, যেটার দ্বারা এই আত্মহত্যার প্রবণতাটা মাপা যাবে।
“SADPERSONS” কথাটা একটা mnemonic, অর্থাৎ প্রতিটি অক্ষর মনে রাখলে পুরো জিনিসটা মনে থাকবে। সব মিলিয়ে মোট দশটা অক্ষর, যেটা দশটা পয়েন্ট বোঝাচ্ছে। প্রতিটা পয়েন্ট মানে একেকটা ‘suicidal risk factor’, যেগুলো নিয়ে আমরা এবার আলোচনা করবো। আপনি নিজেই নিজেকে নম্বর দেবেন। নম্বর মাত্র দুরকম — শূন্য অথবা এক। এইভাবে দশটা পয়েন্টের জন্য টোটাল ম্যাক্সিমাম স্কোর দশ, তার মধ্যে আপনি কত নম্বর পেলেন সেটা দেখতে হবে।
আসুন এবার এক এক করে পয়েন্টগুলো দেখা যাক আর নিজেকে নম্বর দেওয়া যাক –
১) S = SEX.
পুরুষ হলে ১, মহিলা হলে ০.
তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলা হয়নি, তবে ওটা সম্ভবত শূন্যই হবে।
২) A = AGE.
কুড়ি বছরের নিচে হলে ১.
চুয়াল্লিশ বছরের উপরে হলে ১.
কুড়ি থেকে চুয়াল্লিশের মধ্যে বয়স হলে ০.
৩) D = DEPRESSION.
ডিপ্রেশনের লক্ষণ থাকলে ১, না থাকলে ০.
ডিপ্রেশনের রকমফের এবং লক্ষণগুলো আমরা আগেই আলোচনা করেছি, অতএব তার সাথে নিজের লক্ষণ মিলিয়ে পয়েন্ট দিন। এখানে কোনও বিশেষ ধরণের ডিপ্রেশনের কথা বলা হয়নি। যেকোন ডিপ্রেশন থাকলেই নিজেকে এক পয়েন্ট দিতে হবে, আর যদি নিশ্চিত হন যে আপনার কোনরকম ডিপ্রেশন নেই তাহলে শূণ্য দেবেন।
৪) P = Previous attempt of suicide.
যদি কখনও আত্মহত্যার প্রচেষ্টা নিয়ে থাকেন তাহলে এক পয়েন্ট, নাহলে জিরো।
৫) E = ETHANOL, which refers to alcohol.
মদ্যপায়ী হলে এক পয়েন্ট, নইলে জিরো বসান।
৬) R = RATIONAL THINKING LOSS.
যদি আপনার নিজের মনে হয় যে চিন্তাভাবনা গুলো এলোপাথাড়ি বা অযৌক্তিক হয়ে যাচ্ছে তাহলে এক পয়েন্ট দেবেন, নতুবা শূন্য। নিজেই নিজের মূল্যায়ন করছেন, অতএব চোট্টামি করবেন না প্লীজ। সৎভাবে নম্বর দিন।
৭) S = SOCIAL SUPPORT, অর্থাৎ পরিবারের সাপোর্ট।
যদি মনে হয় আপনার পারিবারিক সাপোর্ট আছে তাহলে শূন্য বসান, আর যদি ভাবেন আপনি পারিবারিক ক্ষেত্রে কোনও সাপোর্ট পান না তাহলে এক পয়েন্ট দিন। ডিভোর্সি অথবা বিধবা/বিপত্নীক হলেও এক পয়েন্ট হবে, তাতে পারিবারিক সাপোর্ট থাকুক বা নাই থাকুক।
৮) O = ORGANISED ATTEMPTS OF SUICIDE PREVIOUSLY (planned or attempted) –
ইতিপূর্বে যদি আটঘাট বেঁধে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা নিয়ে থাকেন অথবা পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা করে থাকেন তাহলে এক পয়েন্ট, নাহলে জিরো লিখুন।
৯) N = NO SPOUSE
স্বামী অথবা স্ত্রী না থাকলে এক পয়েন্ট, আর যদি থাকে তাহলে জিরো।
১০) S = SICKNESS, mainly referring to terminal illness like cancer, etc.
দুরারোগ্য কোনও ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিক ভাবেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাবে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যদি সেরকম কোনও অসুখ থাকে তাহলে ১ বসান, নাহলে ০ লিখুন।
এবার আপনার টোটাল স্কোর কত হলো সেটা হিসাব করুন।
ক) ০ – ২ :-
যদি ০ থেকে ২ পান তাহলে আপনি একদম সেফ, মানে অন্তত এই মুহূর্তে আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন না।
খ) ৩ – ৪ :-
যদি আপনার স্কোর তিন থেকে চার হয় তাহলে সামান্য একটা সম্ভাবনা আছে, তবে এক্ষুনি ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিজেই নিজেকে কাউন্সেলিং করে এবং জীবনযাত্রায় কিছু পজিটিভ পরিবর্তন এনে ‘সেফ জোন’-এ থাকতে পারবেন। পারলে একবার কোনও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে নিন, তাহলে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।
গ) ৫ – ৬ :-
যদি আপনার পয়েন্ট ৫ থেকে ৬ হয় তাহলে একটু চিন্তার ব্যাপার। আপনার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে। এক্ষেত্রে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেওয়া নিতান্তই প্রয়োজন।
ঘ) ৭ – ১০ :-
আপনার স্কোর যদি সাত থেকে দশের মধ্যে হয় তাহলে আপনি বিপদসীমার উপরে বাস করছেন। যে কোনো সময়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন, অতএব যাবতীয় কাজ ফেলে রেখে আগে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে দৌড়ান। তিনি যদি হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন তো তাই হোন। ইউ আর আন্ডার সিরিয়াস রিস্ক অফ সুইসাইড !
আমাদের আজকের ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে গেছে। হতাশার লক্ষণ সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করলাম, কিভাবে নিজের এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হতাশা আছে কি না সেটা নির্ধারণ করবো সেটা জানলাম, এবং নানারকম হতাশা নিয়ে একটা সামগ্রিক চিত্র পাওয়ার চেষ্টা করলাম। মনোবিদের প্রয়োজন কখন এবং কতখানি সেটা বোঝার একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টাও নিলাম। বাকি রইলো ডিপ্রেশনের চিকিৎসার বিষয়টা। এই বিষয়ে বলার মতো উপযুক্ত জ্ঞাণ বা যোগ্যতা আমার নেই, তাছাড়া এটা ব্যক্তি বিশেষে নির্ভর করে বলে এরকম অন্ধ আলোচনা করা উচিতও হবে না।
ক্লাস শেষ করার আগে কয়েকটা কথা বলে যাই। হতাশা থেকে বাঁচার জন্য কি কি করা যেতে পারে সেটা নিয়ে আমি দীর্ঘদিন ভেবেছি। নিজের তাগিদেই ভেবেছি। ভাবনাগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার করছি, তবে গ্রহণ করবেন কি না সেটা পুরোপুরি আপনার ব্যাপার।
১) ডিপ্রেশনকে কখনও অবজ্ঞা বা অবহেলা করবেন না। যখনই বুঝবেন আপনি ক্লিনিক্যাল মেন্টাল ডিপ্রেশনে ভুগছেন তখনই ডাক্তার দেখান, নইলে এর শিকড় যে কত গভীরে চলে যেতে পারে আপনার ধারণা নেই !
২) সোশ্যাল মিডিয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকুন। এখানে যত অ্যাক্টিভ থাকবেন ততই ঘনঘন মুড বদল হবে, মানসিক অস্থিরতা আসবে, ইত্যাদি। ফেসবুক করতে হলে সময় মেপে করুন এবং করার পর লগ-আউট করে যান। জানি কাজটা একটু কঠিন, তবে এই কঠিন কাজটা করতে না পারলে আপনি অচিরেই কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের ইলেকট্রিক বিল অথবা মুদিখানার খরচের বোনাফাইড যোগানদার হয়ে যেতে পারেন। এবার ভেবে দেখুন কোনটা আপনার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য !
৩) নিয়মিত ব্যায়াম করুন। আপনাকে সিক্স প্যাক অথবা শিল্পা শেঠির মতো কোমর বানাতে হবে না, কিন্তু প্রতিদিন যদি আধঘন্টা করেও শরীরচর্চা করেন তাহলে মনটা ভালো থাকবে। এই “ফিলিং অফ ওয়েল-বিয়িং”-টা হতাশা নামক জোঁকের মুখে লবনের কাজ করে।
৪) নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথে “কোয়ালিটি টাইম” কাটান। তাদের সময় দিন।
৫) অফিসের কাজ অফিসেই শেষ করুন, সেটা বাড়িতে বয়ে আনবেন না।
৬) গল্পের বই পড়ুন, গান শুনুন, সিনেমা দেখুন, কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে মোবাইল ঘাঁটবেন না এবং ফেসবুক, হোয়াটস্ অ্যাপ ইত্যাদি করবেন না। নিজের কিছু মাপকাঠি স্থির করে নিন যেগুলো আপনি সৎভাবে এবং দাঁতে দাঁত চেপে পালন করবেন।
৭) সময় এবং সুযোগ পেলেই দু-চারদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ুন। ভ্রমণের মতো anti-depressant আজও আবিস্কৃত হয়নি।
আর কি ? এবার তাহলে আসি, কেমন ? সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, বেঁচে থাকুন। তেড়েফুঁড়ে বাঁচুন।
অনেক ভালোবাসা রইল। এটা শুধুমাত্র একটা লেখা নয় একটা দলিল যা প্রতিটি প্রজন্মের ভীষণ প্রয়োজনীয়। তোমাকে এবং বাকি সব ডাক্তারবাবুকে জানাই অকুণ্ঠ ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা। পেজটির সার্বিক সাফল্য কামনা করছি?