ঘরের মধ্যে আমরা দশজন। উৎকণ্ঠা, উদ্দীপনা মিশ্রিত মুখ চাওয়া-চাওয়ি। মিনিট পাঁচেক হলো আমাদের হাতে মহার্ঘ্য কোভিশিল্ড সরকারী বদান্যতায় প্রোথিত। এখন অবজারভেশনের ঘেরাটোপে।
হাওড়ার এক যৌথ পরিবারে সকলে মুখ চুন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারণ জ্যাঠামশাই ঘোষণা করেছেন, কাল নাকি সকালে নিমাই কম্পাউন্ডার আসবে–
সকলে যেন হাজির থাকে। অর্থাৎ বাৎসরিক সেই কাণ্ডটি ঘটবে। টিএবিসি ইঞ্জেকশন প্রদান। আমার ঠাকুর্দার ভাষায়, সুস্থ শরীর ব্যস্ত করা।
দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঠাকুর্দার অমতে এই একটা কাজই খুব সম্ভবত নিস্তারিণী নিকেতনে ঘটত, আর এক প্রভাবশালী তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জ্যাঠামশাই-এর দাপটে ও তত্ত্বাবধানে।
কাল স্কুলে যেতে হবে বলে পার পাবার উপায় নেই। কলেরা/টিএবিসি ইঞ্জেকশনের চিঠি নিয়ে গেলে ছাড়। এ ব্যাপারে হেড স্যারও জ্যাঠামশাইপন্থী বা জ্যাঠাবাবু হেড স্যার (হাঁদ্দা) অনুগামী।
শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছি বটে কিন্তু মজা একটু পাচ্ছি– মা, কাকিমা, জেঠিমা বা ছোট পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে। বেচারারা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমাদের সামনে পড়লে একটু কষ্টার্জিত হাসি।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সাইকেল বাড়ির গলিপথে রেখে নিমাই কম্পাউন্ডার বাড়ির বৈঠকখানায়। চামড়ার ঢাউস ব্যাগ থেকে এক এক করে যন্ত্রপাতি বেরোচ্ছে। জেঠুর নির্দেশে ছোটপিসি ফুটন্ত গরম জলের বাটিটা সামনে রেখে গেল। নিমাই কাকুকে এই মুহূর্তে সাক্ষাৎ যম বলে মনে হচ্ছে। অতি যত্নে কাঁচের সিরিঞ্জ আর ছুঁচ সেই গরম জলে ছেড়ে দিলেন।
ঘরের অন্দরমহলে তখন ঠেলাঠেলি— তুই আগে যা।
–না আমি কেন, তুই যা না।
–এ মা কী বোকা, আগে হলে তো আগে সেরে যাবে।
অবশেষে বাবা প্রথম এগিয়ে গেলেন আর তখনই বুঝলাম, বাবা হওয়া বড় জ্বালা।
এবার আমাদের ভায়েদের মধ্যে সাহস দেখানোর পালা। ভয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেও চোখে জল আসা চলবে না। অদ্ভুত একটা হাসি হাসি মুখ করে বলতে লাগলাম, কৈ আমার তো কিসসু হয় নি।
সকাল গড়িয়ে বিকেল। হাতে ব্যথা আর জ্বর নিয়ে আমরা সবাই গড়াগড়ি খাচ্ছি। উপহার স্বরূপ আমরা সবাই নিজের নিজের জন্য একটা করে নুন-পুঁটলী পেয়েছি। হারিকেনের কাঁচের তাপে গরম করে ইঞ্জেকশনের জায়গায় চেপে ধরা আর উহু উহু করা।
ঠাকুর্দা চারপাশে ঘুরে নিজের বিছানায়।–এইজন্যেই বলি সুস্থ শরীর ব্যস্ত করার দরকার কি?
একদম ঠিক কথা।
বাবা ওদিকে সকলের জন্য স্কুলের অনুপস্থিতির চিঠি লিখে চলেছে।
দুদিন বাদে চিঠি হাতে স্কুলে যেতে ছুটি মঞ্জুর। পাশে বসা বন্ধু কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলল, কি রে ঠিক আছিস? ব্যথা নেই? মোক্ষম জায়গায় খোঁচায় ককিয়ে উঠতে বোঝা গেল, একদমই ঠিক নেই।
এদিকে হ্যাঁচকা টানে উঠলাম– কি হলো! আমাদের অবজারভেশনের টাইম হয়ে গেছে। দেখলাম সিস্টার দিদিমণি বলছেন, আপনার কোনো অসুবিধা না থাকলে এখন যেতে পারেন। কোনো অসুবিধা হলেই জানাবেন।
বেশ দিব্যি আছি। ফুরফুরে মেজাজে সাবডিভিসন হাসপাতালের বাইরে এলাম। সবার হাতে শিল্ড। এ এক শিল্ড বিজয় বটে।
ওপর দিকে তাকালাম। ঐ তো কতজনকে দেখা যাচ্ছে। স্কুলের ঐ সহপাঠীর কথা মনে হলো, কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে যে বলেছিল, কী রে ব্যথা আছে?
ওপরে তাকিয়ে বললাম অনেক অনেক ব্যথা আছে। এ ব্যথা যাওয়ার নয় বন্ধু। এ ব্যথা চিরকালীন ব্যথা।