কৃষ্ণকান্তের ডাকনাম কেষ্টা। কেউ কেউ অবশ্য ভালবেসেই বলুক, আর তাচ্ছিল্য করে বলুক- কৃষ্ণ বলে ডাকে। রোগা, পাতলা, ছিপছিপে গড়নের বছর কুড়ি বয়সের একটি তামাটে রঙের ছেলে। মাথায় প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা অগোছালো উস্কোখুস্কো বড় বড় চুল। সেই চুল যাতে কপালে এসে না পড়ে, তার জন্য একটা ছোট লাল গামছা পেঁচিয়ে কানের কাছে গিট দিয়ে বেঁধে রাখে সে। পরনে কখনও লুঙ্গি, কখনও পাজামা, কখনও বারমুডা প্যান্ট। গায়ে কখনও হাফ গেঞ্জি, কখনও বা উদোম খালি গা। তবে এ সব নিয়ে কৃষ্ণকান্ত কখনও ভাবে বলে মনে হয় না। তার ভাবনা তার দোতারা নিয়ে। কোথা থেকে এই দোতারা সে সংগ্রহ করেছিল জানি না, তবে নিজে কেনেনি বা কেনার সামর্থ্য নেই এ বিষয়ে নিশ্চিত। গ্রামের একজন বলেছিল, শিখিরার সুজয় মাস্টার তাঁর পুরানো দোতারা ওকে দান করেছেন। সুজয় মাস্টার নিজেও একজন দোতারা শিল্পী, তাঁর কাছেই কেষ্টার তালিম এবং শিক্ষা। সুজয় মাস্টার শুধু দোতারাই বাজান না, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানো তাঁর শখ। আড়বাঁশিও তিনি খুব ভাল বাজান। সেখান থেকে কৃষ্ণ আড়বাঁশিও বাজানো শিখেছে কিছুটা। তবে সে দিনের বেলা দোতারা নিয়ে থাকে, কোনও কোনও দিন রাতের বেলা আড়বাঁশি বাজায়।
একেবারে বাড়ির কাছে সরকারি প্রাইমারি ও হাইস্কুল থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণকান্ত তৃতীয় শ্রেণীর পর আর পড়েনি। তার ইচ্ছে করেনি। পড়া নিয়ে তার বাড়ির লোকেদের কোনও মাথা ব্যথা নেই, বরং স্কুলে না গেলেই ভালো। অবস্থাপন্ন কারও বাড়িতে গিয়ে মাহিন্দর থাকলে বা নিদেনপক্ষে তাদের জমিতে জন খাটলে তবু দুচার টাকা ঘরে আসতে পারে। একগাদা লোক সংসারে, সবাই ভাদামে টাইপের। খালিপেটে গামছা বেঁধে ঘরের মেঝেতে শুয়ে থাকবে, তবু কোন কাজ করতে চাইবে না। একটা বোনের বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চা হবার পর কি অসুখে মরে গেল। আর আছে তিন দাদা। তার বড়টি বিয়ে করে সংসার করে আলাদা হয়ে গেছে। তারও অবস্থা ভালো নয়। তবু সংসারের তাগিদে বাড়ির পাশের স্কুলের মাঠে ছোলা, আচার বিক্রি করে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা তার খদ্দের। তাতে আর কত হয়? সপ্তাহে দুই দিন ঝুড়ি মাথায় করে সালালপুরের হাটে যায়। অন্য দুই দিন মহীপালপুরের হাটে। এই হাটেই যা দশ-বিশ টাকার বিক্রিবাটা হয়। তাতেই তার সংসার চলে। তার সঙ্গে ছেলেটিকে সে পড়াচ্ছে। এবার ক্লাস ফোর।
কৃষ্ণকান্তের পরের দাদাটিও বিয়ে করেছে। একটা বছর দুই বয়সের ছেলে আছে। সেও বিশেষ কিছু করে না। একটু হাতটানের অভ্যেস আছে। রাতবিরেতে বেরিয়ে গ্রাম ঘুরে ছোটখাটো জিনিস চুরি করে। ঘটিবাটি, থালাবাসন, যা পায় তাই নিয়ে দুচার টাকায় বেচে দেশি মদের ভাটিতে গিয়ে নেশা করে বাড়ি এসে মাতলামি করে আর বৌকে পেটায়।
এর পরের দাদাটি বিয়ে করেনি। তাই কিছু করতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতাও নেই। সেও একটা লুঙ্গি পরে খালি গায়ে শুকনো মুখে এদিক ওদিক ঘোরে। কেউ টুকটাক কোন কাজ দিলে করে। দু’একদিন অন্যের জমিতেও কাজ করে। কিন্তু সম্প্রতি সে ডান পায়ের অসুখে ভুগছে। পায়ের পাতা ঠিকমতো পাততে পারে না, একটি গাছের ডালের লাঠি তার ভরসা। কিছুদিন আগে একটা কাঁটা ফুটেছিল পায়ে। প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি। তারপর ব্যথা হলে লতার রস লাগিয়ে পায়ে চুল বেঁধে রেখেছিল কিছুদিন। কোন কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাড়ির পাশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমার কাছে যখন এল, পায়ের পাতা ফুলে ঢোল। এক দিকে পূঁজ জমে আছে অনেকটা। অনেক বকাবকি করে, পূঁজ বের করে ওষুধ দিয়ে বেঁধে খাবার ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। এখন ব্যথা একটু কম, তবুও পা পেতে চলতে অসুবিধে হয়। ওর যা অবস্থা, গ্যাংগ্রিন হয়ে গেলে পা কাটতে হবে। এখানে হবে না, কলকাতা যেতে হবে। সে কলকাতার নাম শুনেছে, কিন্তু মগরা ছাড়া অন্য কোথাও যায়নি। একবার চুঁচুড়া গিয়েছিল অনেক দিন আগে।
ওদের বাবার বয়স হয়েছে, চলতে পারে না ঠিক করে, তবুও একটু সুস্থ থাকলে এটা ওটা করে দুচার টাকা আয় করার চেষ্টা করে।
যত ঝামেলা ওর মায়ের। এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে, কারও বাড়ি রান্না করে এই এতগুলো লোকের মুখে দুবেলা না হলেও একবেলা খাবার তুলে দেবার ব্যবস্থা করে্ন কোনো রকমে। হাজার হলেও মা। তবুও সেই মায়েরও সমস্ত ব্যাপারটি সয়ে গেছে। এসব নিয়ে তিনি আর দুশ্চিন্তা করেন না। ছেলেরা না খেয়ে ঘুরে বেড়ালেও তাঁর কিছু করার নেই। বলার নেই। সাংসারিক ব্যাপারে এখন তিনি নির্লিপ্ত। বলেন, ‘দামড়া ছেলে কাজ না করলে না খেয়ে থাকবে, আমি কি করব?’
আমার বাড়িতে যখন অশ্বিনী দাদু কাজ করার জন্য তাঁকে ঠিক করে দিলেন, তখন থেকে তাঁর একটি নির্দিষ্ট আয়ের সংস্থান হল। (অশ্বিনী দাদুর কথা অন্যদিন বলব)। তাতে তাঁর নিজের পরিধান এবং সংসারের খাদ্যের কিছু সুরাহা হলেও ছেলেদের মানষিকতার কোনও পরিবর্তন হল না। বরং তারা আরও গা-ছেড়ে দিল।
বলতাম, ‘দেখো, তোমার ছেলেরা যদি কোনও ব্যবসা করে, আমি পুঁজি দিতে পারি’।
তিনি তাচ্ছিল্যভরে বলতেন, ‘ছাড়ো দিন! ওঁরা করবে ব্যবসা? মদ মাতালের দল, সব অকম্মার ঢেকি’।
বলতাম, ‘কিন্তু, তুমি কতদিন আর এভাবে ওদের খাওয়াতে পারবে?’
ঝাঁঝালো স্বরে বলতেন, ‘না পারলে সব না খেয়ে শুকাবে।’
‘কিন্তু…’
‘তুমি ছেলে আর কি করবে? যার যা ভাগ্যে আছে তাই হবে!’ বলে তিনি অসহায় ভাবে অন্য দিকে মুখ ঘোরাতেন।
একটি অসহায় মায়ের সমস্ত বেদনা আমাকে ছুঁয়ে যেত। আমার কিছু বলার থাকত না। তিনিও নীরবে বাড়ির পথ ধরতেন। আমার হাসপাতালের কোয়ার্টার থেকে তাদের বাড়ি দেখা যেত। একটি লালপেড়ে সাদা শাড়ির শীর্ণা শরীর মাটির আলপথ বেয়ে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যেত।
কৃষ্ণকান্তের এসব নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। সে ছিল তার মত। দোতারা আর আড় বাঁশি নিয়ে।
আমার হাসপাতালের ছয় বিঘা জমির মধ্যে সবকিছু ছিল। মাছের পুকুর, চাষের ক্ষেত, তেঁতুল গাছ, তাল গাছ, আম গাছ, কাঁঠাল গাছ, খেজুর গাছ, বাবলা গাছ, আমড়া গাছ, কুল গাছ – মোটামুটি সব ধরণের গাছ ছিল। এছাড়া হাসপাতালের মেন বিল্ডিং বা আউটডোরের পাশে ছিল একটি ন্যাড়া কদম গাছ, তার পাশে একটি মাঝারি শিরীষ গাছ। গরমের দিনে অনেকে ওই গাছের নিচে বসে থাকত। পরে আমি ওখানে পঞ্চায়েত প্রধানকে বলে অনেক সেগুন ও সাল গাছ লাগিয়েছিলাম। এখন তার ছায়ার এলাকাটি ছায়াচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
কৃষ্ণকান্ত কখনও কদম গাছের নিচে, কখনও শিরীষ গাছের নিচে বসে থাকত তার দোতারা নিয়ে। বিশেষত গরমের দিনে ওখানে বসে দোতারা বাজাত। গলায় অতটা সুর ছিল না, কিন্তু বাজনার তালে তালে কোনও কোনও গান আপনা থেকেই তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসত। গ্রামের কেউ কেউ অকম্মা বলে তাকে ব্যঙ্গ করত, কেউ তাকে গান শোনাতে বলত, আবার কেউ এককাঠি উপরে গিয়ে তাকে বলত ‘ওস্তাদ’।
যে যাই বলুক, তাতে কৃষ্ণকান্তের কোনও কিছু আসে যেত না। তার কৃষ্ণাঙ্গ মুখের হালকা গোঁফের নিচে সাদা দাঁতগুলো প্রায় বেরিয়েই থাকত, আর দোতারার সুরের সাথে তালে তালে তার ঢেউখেলানো চুল দুলত।
আমার হাসপাতালের সুইপার শ্রীবাস ছিল ব্যাঞ্জো বাদক। তার একটি পুরানো ব্যাঞ্জো ছিল। বেশ কয়েক দিন তার ব্যাঞ্জো শুনেছি। সে কৃষ্ণকান্তকে বলত, ‘ওস্তাদ, ব্যাঞ্জো শেখো, ব্যাঞ্জো! দেখো, তোমার দোতারার থেকে কত ভালো’।
কৃষ্ণকান্ত বলতো, ‘তুমি শেখালে শিখব’।
শ্রীবাস বলতো, ‘এসো তবে রাতে’।
‘যাব’ বলে মাথা দোলাত কৃষ্ণকান্ত।
কিন্ত সন্ধ্যা হলে আর শ্রীবাসকে পাওয়া যেত না। তারপর সে রাতে তার ঠেক থেকে যখন ফিরত, তখন সে অন্য লোক। এসব কৃষ্ণকান্ত জানত, তাই সে আসত না।
আমার সকালটা কেটে যেত আউটডোরে। দেড়টা দুটো পর্যন্ত। আমি আমার হাসপাতালের চেম্বারে বসেই কৃষ্ণের দোতারা শুনতাম। ভালোই লাগত। শুধু আমি কেন, গ্রামের যারা ওষুধ নিতে আসতো, তারা সবাই শুনত।
ওষুধ নেবার বা ডাক্তার দেখাবার লোকের অভাব ছিল না। ছোট শিশু থেকে শুরু করে সত্তরের বুড়ো-বুড়ি সব ছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল রাধি। রাধি হেমব্রম। স্থানীয় আদিবাসী সাঁওতাল মেয়ে।
মাঝারি চেহারা, গায়ের রঙ কাল, মাথার চুলগুলো কোঁকড়ানো। চেহারায় আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য ছিল না, কিন্তু তার মুখখানি ছিল অপূর্ব লাবণ্যময়। আর কালো মুখমন্ডলের মধ্যে ঝকঝকে সাদা মানানসই দাঁতের হাসি। হাসিটি যেন মুখে লেগেই থাকত আর কথায় কথায় খিলখিল শব্দে উপচে পড়ত। তার দিকে তাকালে, তার কথা শুনলে তার হাসি দেখলে আর গায়ের রঙের বা অন্য কিছুর কথা মনে অসত না। যেন এই হাসি, এই স্বর, এই প্রগলভতা একমাত্র ওর চেহারার সাথেই মানানসই। ঈশ্বর একেবারে নিক্তিতে মেপে মেপে ওকে সবকিছু দিয়েছেন। কোথাও এক বিন্দু বেশি বা কম নেই। রাধি তৈরি হয়েছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে।
রোজ সে আসত না। একাও আসত না। যখন আসত, তার সাথে আরও দু’একজন থাকত। কখনও বাড়ির ঠাকুরমা বা ভাই, কখনও আরও এক দুজন সমবয়সী মেয়ে। বান্ধবীরা একসাথে এলে সবাই মিলে রাস্তায় হাসি ছড়াতে ছড়াতে আসত এবং হাসি ছড়িয়ে চলে যেত। দু’একদিন ধমক দিয়েছি, ‘এত হাসিস কেন রে?’ এই কথার মধ্যে হাসির কি আছে জানি না, কিন্তু শুনে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, আবার সবাই হেসে উঠতে। বলতাম বটে, তবে ভাল লাগত, যার রেশ ওরা চলে যাওয়ার পরেও থাকত।
রাধি গানও গাইতে পারত। একদিন দেখি রাধি আর তার দুই বান্ধবী কৃষ্ণকান্তের চারপাশে ঘিরে বসে আছে। কৃষ্ণকান্ত দোতারা বাজাচ্ছে মাথা ঝাঁকিয়ে চুলে ঢেউ খেলিয়ে আর রাধি ও তার সহচরীরা খিল খিল করে হাসছে। বেশ লাগল দেখতে।
এই গরমে বাইরে লোকজন কম। সকালেই লোকের আনাগোনা বেশি, এগারোটার পর কমে যায়। এমনিতেই গরম, তাছাড়া কয়েকদিন আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঠে চাষের কাজ চলছে পুরোদমে। আমি প্রায় ফাঁকা মাঠের মধ্যে আমার স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘরে বসে প্রকৃতির খোলা হাওয়া খাচ্ছি। না, মনে হয় এই বেশ আছি। এত বছর কলকাতার প্রায় মাঝখানে ব্যস্ততম পেশায় থেকে যে জীবন কাটিয়েছি, সেই জীবনের সাথে এই জীবনের কোনও মিল নেই। এখন শান্ত, তরঙ্গহীন জীবন। অলসতা আপনিই আসে। দুচোখ ভরে প্রকৃতির রূপ দেখা, তাকে চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো, মানুষ দেখা, মানুষের মধ্যে মানুষ দেখা – এই আমার কাজ। আর বেডহীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিধিরাম সর্দারের দায়িত্ব সামলানো।
কৃষ্ণকান্তের মা আমার বাড়িতে কাজ করেন- আমি মাসি বলি, তিনি আমার সমস্ত দায়িত্ব একটু একটু করে নিজের অজান্তেই কাঁধে তুলে নিয়েছেন। শহরের মত এখানে সকাল বিকাল বাজার নেই। মহীপালপুরের হাট দূরে বলে ওখানে যাওয়া হয় না। সালালপুরের হটে গিয়ে ঘুরে আসি মাঝে মধ্যে। একার জন্য আর কি কিনব? বাড়িতে রোজ তিন চারটে মুরগির ডিম হয়। গোটা পনের মুরগি আছে, কৃষ্ণকান্তের মা-ই দেখাশোনা করে। তাদের জন্য একটা ঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে কোয়ার্টারের দেওয়ালের সাথে জুড়ে। তিনি সকালে এসে তাদের ঘর খুলে দেন, সারা হাসপাতাল চত্বর এবং মাঠে ঘুরে ঘুরে তারা খেয়ে বেড়ায়, সন্ধ্যা হলে নিজেরাই এসে ঘরে ঢুকে যায়। ডিম দেওয়ার সময় আবার ঘরে ঢুকে ডিম পেড়ে যায়। ডিম পাড়া হয়ে গেলে কক কক করে তা জানান দেয়। সেই ডিম আমার নিয়মিত খাদ্য। দিনে দু’তিনটে। বাকি যা জমে, কয়েকদিন পর পর মাসি নিয়ে যায়।
তিনি কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে বাজারের কথা বলেন না। কম্পাউন্ডারের মাধ্যমে আমি জানতে পারি, আমার ঘরে কোনও রান্নার শব্জী নেই। কখনও কখনও তাও জানতে পারি না। তিনি ঘরের পাশে লাগানো পেঁপে গাছ থেকে একটা পেঁপে পেড়ে ডিম দিয়ে রান্না করে রাখেন। তা নিয়ে আমার কোনও অসুবিধা নেই, দিনে কিছু খাবার জুটে গেলেই হল। তবে তাঁর সংসারের কথা চিন্তা করে খারাপ লাগে। অসুস্থ স্বামী, অকর্মণ্য ছেলেদের নিয়ে যে ভারি সংসার, তা প্রায় একাই টেনে নিয়ে চলেছেন।
কিন্তু কৃষ্ণকান্তকে দেখে মনে হত, তার মত সুখী লোক আর নেই। কাজ করতে হবে এমন কোন কথা নেই, খাবার বাড়িতে গেলে কিছু না কিছু পাওয়া যাবে, না পেলেও বিশেষ ক্ষতি নেই। নিশ্চিন্তে নিজেকে নিয়েই আছে। অনেক দিন কাছে গিয়ে বলেছি, ‘কেষ্টা, কিছু তো করতে হবে, এই দোতারা আর বাঁশি বাজিয়ে সংসার চলবে?’ কৃষ্ণ আমার দিকে তাকিয়ে কথার বিশেষ জবাব দিত না। আমার দিকে তাকিয়ে হাসি আরও ছড়িয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলত, ‘ডাক্তারবাবু, আপনার পছন্দের গান শুনবেন?’
“শোনা’। বলার সাথে সাথে কৃষ্ণকান্তের দোতারা ঝাড়া দিয়ে উঠত। তার তালে তালে কৃষ্ণকান্ত শুরু করত ‘ভালো কইরা বাজাও গো দোতারা…’ এই গানটি কৃষ্ণকান্ত বেশ ভাল গাইত। আগে দু একবার ওর কাছে এই গান শুনতে চেয়েছি- তাই এই ভাবে ওর আসল কথা পাশ কাটিয়ে যাওয়া।
মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে মনে হত, আমি কেন এমন হতে পারি না? কি পাওয়ার লোভে এমন করে ছুটে চলেছি? এত কষ্ট করে দিন-রাত এক করে পড়াশুনা করে, এই চাকরীতে যোগ দিয়ে দায়িত্ব বেড়েছে বৈ কমেনি। আর এই চাকরির সবচেয়ে খারাপ অংশ হলো প্রশাসনিক দিক। এই সমস্যা, ওই সমস্যা লেগেই আছে। এসব দিন দিন বাড়বে ছাড়া কমবে না। আরও ডিগ্রি, আরও সিনিয়রিটি, আরও দায়িত্ব এবং আরও সমস্যা। আমার চেয়ে তো কৃষ্ণকান্ত অনেক সুখে আছে। আর্থিক স্বনির্ভরতা এবং স্বচ্ছলতাই কি সুখের মাপকাঠি? নিশ্চয়ই নয়! তাহলে প্রতিটি ধনী লোকই সুখী হত!
এভাবে দিন কাটছিল বেশ। মাসে মাসে কিছু টাকা পাচ্ছি, গ্রামের লোকের সম্মান পাচ্ছি, কারও পুকুরে মাছ ধরা হলে কখনও কখনও একটা আমার বাড়িতে দিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ব্যাঙ্কের স্টাফ তাপসদা, শৈলেশদা, প্রবীরদা, এদের সাথে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। দুপুরে সেখানে গিয়ে ক্যারাম খেলছি। আর সবচেয়ে বড় কথা আমার তেমন কোন উচ্চাশা নেই। এত এত টাকা আয় করব, সারাদিন টাকা এবং ডিগ্রির পিছনে ছুটব, সে ইচ্ছা কোনদিন হয়নি। বাবা চেয়েছিল ডাবরার শশী ডাক্তারের মত দাপুটে গ্রাম্য ডাক্তার হই। বাবার ইচ্ছায় ডাক্তার হওয়া। সে তো হতে পেরেছি! না, তার চেয়ে অনেক বেশিই হয়েছি।
এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় আছে। আমি আসলে গাঁইয়া। আমি গ্রামে গেলে মনে হয় আমার নিজের জায়গায় এসেছি। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি। মেঠো পথে জমির আল বেয়ে হাঁটতে আমার ভাল লাগে। মাঠ ভর্তি সবুজ ধানের ক্ষেত দেখলে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়। ধানের সোঁদা গন্ধে আমার নেশা লাগে। তাই এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে আমি যেন আমার নিজের জায়গা খুঁজে পেলাম। এখানকার মানুষদের নিজের লোক বলে ভাবতে আমার অসুবিধা হয়নি। আর তারাও তেমনি আমাকে নিজের বলে গ্রহণ করেছিল।
গ্রামের মানুষজন আমার খুব চেনা। কৃষ্ণকান্তদের আমি অনেক দেখেছি, কাজের মাসি, তার সংসার এবং সেই সংসারকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম প্রতিটি গ্রামেই অনেক, অনেক আছে-দৃষ্টির অগোচরে।
আমি সকালে উঠে চা খাই। তারপর নিজস্ব চেম্বারে বসি। কাজের মাসি সকালেই চলে আসে। চেম্বার শেষ করতে করতে রুটি-শব্জী টিফিন তৈরি হয়ে যায়। তারপর খেয়ে আউটডোর। সেখানে নানা জনের চিকিৎসা করা, গল্প করা, স্টাফদের নিয়ে মিটিং, এর মাঝে কৃষ্ণকান্তের দোতারা শোনা, রাধিদের দেখা, তাদের সাথে কথা বলা, কৃষ্ণ-রাধিকার খুনসুটি দেখা- সময় কাটছিল বেশ। দিন দিন রাধির আর কৃষ্ণের মেল বন্ধন ভালোই জমছিল। দু একদিন দেখেছি, রাধি সখী পরিবৃত হয়ে গান করছে- সাঁওতালদের গান আর কৃষ্ণ তার সাথে দোতারায় তাল মেলাচ্ছে। আবার দু একদিন দেখেছি, কৃষ্ণকান্তের বাঁশি বাজানো রাধি ও তার দলবল তন্ময় হয়ে শুনছে।
কোনও কোনও দিন আমি রাতে ফোল্ডিং খাটিয়া ঘরের বাইরে মাঠের মধ্যে পেতে শুয়ে শুয়ে আকাশের চাঁদ-তারা দেখতাম। আক্ষরিক অর্থেই তাই। আর ঘরের মধ্যে টেপ চালিয়ে বাইরে শুয়ে শুনতাম- ‘দূরে কোথায় দূরে…দূরে…., অথবা অন্য কোনও রবীন্দ্র সঙ্গীত। তখনও বিয়ে করিনি, অঢেল স্বাধীন জীবন। তার মধ্যে কোনও কোনও দিন হঠাৎ করে ভেসে আসত কৃষ্ণকান্তের বাঁশির সুর। আমি নীরবে ঘরে গিয়ে গান বন্ধ করে ওই বাঁশি শুনতাম। না, ছেলেটা সত্যিই এখন ভাল বাঁশি বাজায়।
এভাবে দিন চলছিল বেশ। কিন্তু তবুও কিছুদিন এভাবে চলার পর একঘেঁয়ে লাগত। মনে হত, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে আসি হোষ্টেলে গিয়ে, কিংবা কোথাও ঘুরে আসি। যেহেতু ডাক্তার আমি একা, তাই চলে যেতাম কয়েক দিনের জন্যে কম্পাউন্ডারের উপর সব ছেড়ে দিয়ে। তিনিই তখন সবকিছু।
এইভাবে একবার সাত দিনের জন্যে সেন্টার ছেড়ে চলে এলাম। ফিরে গিয়ে আবার যথারীতি একই কাজ। ছুটি থেকে আসার পর প্রথমে কয়েক দিন বেশ চাপ যায়। সব ঠিক আছে। কিন্তু কৃষ্ণকান্তকে দেখতে পেলাম না। এমনিতেই সব দিন যে ও আসে, তা নয়। কিন্তু সপ্তাহদুই পরেও যখন তাকে দেখলাম না, তখন কম্পাউন্ডারকে বললাম- ‘কেষ্টাকে তো দেখছি না?’
তিনি বললেন- ‘আপনি শোনেননি কিছু?’
অজানা আশঙ্কায় বলে উঠলাম- ‘না-তো! কি হয়েছে?’
‘তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কতদিন ধরে। মাসি কিছু বলেনি?’
‘না, বলেনিতো’। আমি বিষ্মিত হলাম। মাসির বলা উচিৎ ছিল।
কম্পাউন্ডারকে বললাম- ‘কেন নিরুদ্দেশ হল? জানা গেল কিছু, কোথায় গেছে?’
‘না। কে-ই বা আর খোঁজ করবে? তবে আমার অনুমান রাধির জন্যে নিরুদ্দেশ হয়েছে’। কম্পাউন্ডার এই বিষয়গুলো খুব ভাল বোঝেন।
বললাম- ‘কেন, রাধিকে নিয়েই কি নিরুদ্দেশ হয়েছে?’
‘না, না। তেমন হলে সাঁওতালরা ওকে পিটিয়ে মারবে না? রাধির তো বিয়ে হয়ে গেছে- তারপর থেকেই কেষ্টাকে পাওয়া যাচ্ছে না’।
কথা বলতে বলতে ঘরে চলে এলাম। মাসি দুপুরের রান্না করে ঢেকে রেখে চলে গেছে। খেয়ে যথারীতি একটু গড়িয়ে বিকালে উঠলাম। কিন্তু সব কিছুর মাঝে কৃষ্ণ এসে হানা দিচ্ছে বারে বারে। সত্যিই তো, এতদিন তো অনুমান করিনি এমনটা হতে পারে। বেশ কয়েকদিন এসেছি- ওর মাও কিছু বলেনি।
বিকালে মাসিকে বললাম- ‘তোমার ছেলে কেষ্টা নাকি হারিয়ে গেছে? পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজেছো?’
তিনি বিরক্তির সাথে বলে উঠলেন, ‘ছাড়োদিন ওর কথা। যাবে আর কোন চুলোয়?’
‘তাই বলে খোঁজ করবে না?’
‘খোঁজা লাগবে না। প্যাটে টান পড়লি ঠিক চলে আসবে’
তিনি গুরুত্ব দিলেন না। তার কাছে মনে হল, এটি স্বাভাবিক ঘটনা। চিন্তার কিছু নেই। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু কেষ্টা আমাকে ছাড়ল না। মাঝে মাঝেই হানা দিতে লাগল আমার মনের মধ্যে।
গ্রীষ্ম কালের রাত, লোডশেডিং চলছে। বাইরে বেরিয়ে দেখি জোৎস্নায় আকাশ ভরে গেছে। হাওয়াও আছে বেশ। আমি আমার ফোল্ডিং খাটটিকে নিয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকে ফাঁকা মাঠের মধ্যে পেতে একটা বালিশ এনে শুয়ে পড়লাম। চাঁদের পাশ দিয়ে অনেক উঁচুতে সাদা সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে, তাতে চাঁদের আলো ঢাকা পড়ছে না। একটু দূরের রাস্তা দিয়ে সালালপুরের হাট থেকে কিছু লোকজন বাড়ি ফিরছে, তাদের ফিসফিসানি কথা শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎ করে শুনি আড় বাঁশি বেজে উঠেছে। এক করুণ মায়াবী সুর ভাসছে হাওয়ার সাথে, সারা আকাশ জুড়ে জোৎস্নার আলোর মধ্যে – যেন মেঘের সাথে পৌঁছে যাচ্ছে চাঁদের কাছাকাছি। তার মানে কেষ্টা ফিরে এসেছে। কান পেতে শুনলাম, যেন বাঁশি বাজছে আমার হাসপাতালের চেম্বারের দিক থেকেই। তবে কি কেষ্টা সেই কদম গাছের নীচে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে? নাকি খোলা মাঠের জোৎস্নার আলোয় বসে? একবার ভাবলাম, উঠে গিয়ে দেখে আসি। পরক্ষণেই মনে হল- না, কৃষ্ণকান্ত হয়তো তার রাধিকাকে ডাকছে-ডাকুক। প্রাণ ভরে ডাকুক!