অতি সাধের এই মানব জনম। হিন্দু শাস্ত্র মতে ৮৪ লক্ষ জনমের পর এই মানব জনম পেয়েছি। কিন্তু এই জনম নিয়ে কি করব? এ এক মস্ত ধাঁধা আমার কাছে।
একজন বলেছেন, ‘এই মানব জনম রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা’। কিন্তু কি আবাদ করব, কি সোনা ফলবে? আর সেই সোনা ফলিয়ে আমার কি লাভ? আমি কি মুক্তি চাই? অথচ শাস্ত্র মতে ৮৪ লক্ষ জন্মের পর আমাকে মানব জন্ম দেওয়া হয়েছে জন্ম-মৃত্যুর এই চক্রব্যূহ থেকে মুক্তি পেতে। এখানে, এই জনমে যদি সোনা ফলাতে না পারি, যদি বৈরাগ্য আনতে না পারি – তবে আবার চক্রাকারে ৮৪ লক্ষ বার জন্মের পর মানব জন্ম পাব। তবে এখানেও ভেদ আছে। কেমন? দেখা যাক শাস্ত্র কি বলছে – ২০ লক্ষ বার বৃক্ষ, ৯ লক্ষ বার জলজ জীব, ১০ লক্ষ বার কৃমি জাতীয় জীবন, ১১ লক্ষ বার পাখি ও ৩০ লক্ষ বার পশু যোনি ঘুরে তারপর মানব জনম ৪ লক্ষ বার। এই চার লক্ষ বারের মধ্যে আবার ভাগ আছে। প্রথমে বনমানুষ, তারপর পাহাড়ি জাতি, তারপর একে একে শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় এবং সবশেষে ব্রাহ্মণ এবং তার পর মুক্তি লাভ। এই হিসাবে আমি এখনও মুক্তির দোরগোড়ায় আসিনি। শূদ্র হয়ে জন্মেছি, আর কত লক্ষ জন্মের পর ব্রাহ্মণ জন্ম পাব, সে হিসেব কোথাও পাইনি। আর ব্রাহ্মণ জন্ম না পেলে মুক্তি নেই! তবে মুক্তির আশা বা ইচ্ছা, কোনোটাই আমার নেই। বরং বলি- ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়….., ইন্দ্রিয়ের দ্বার, রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার ‘।
মোটামুটি সংক্ষেপে এই আমার জীবন-দর্শন। আরও পরিষ্কার করে বললে, দৃশ্যে, গন্ধে, শ্রবণে যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আছে, তাকেই আপন বলে জড়িয়ে ধরতে চাই মনে-প্রাণে। আমার মোহই আমার মুক্তি, প্রেমই আমার ভক্তি। জীবন চলার পথে ভাল-মন্দ মিশিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তারই মিলিত সত্বা আমি। বাকি দিনগুলোতেও এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে যাব।
বলতে বসেছি জর্দা পানের কথা, তার মধ্যে এত আগডুম বাগডুম কেন? আপাত অর্থহীন, কিন্তু একটি সম্পর্ক তো আছেই। জীবনতো একটাই, আর সেই জীবন চলার পথে যা কিছু পেয়েছি, তাকেই পরখ করতে চেয়েছি ছুতমার্গকে দূরে সরিয়ে দিয়ে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ছুঁতে চেয়েছি সবকিছু। তাই যেমন পূর্ণকুম্ভ মেলায় নাগা সন্ন্যাসীদের আখড়ায় তাদের পাশে বসে হাতে তুলে নিয়েছি গাঁজার কল্কি, তেমনি আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী দাদাদের নিরামিষ রান্না খেয়েছি মহানন্দে। আবার গোমাংস খেতেও আমার বা বাধেনি, সে কথা আগের লেখায় বলেছি।
পরে কবে কি জন্ম পাব, কোথায় যাব- জানিনে, আর আদৌ জন্ম পাব কি না তাও জানিনে, কাজেই এই জন্ম যখন একবার পেয়েছি, তাকেই চেটেপুটে উপভোগ করি! তার অমৃত যেমন পান করব, তেমনি গরলও দুহাত পেতে নেব কোনও কিছু না ভেবেই। আর তাই যখন যেখানে যা পেয়েছি, নিত্য নতুন যা কিছু এসেছে, তাকে পরখ করতে চেয়েছি নির্দ্বিধায়।
আজ যে যর্দা খাওয়ার কথা বলতে বসেছি, সেও এই মনোভাবেরই প্রতিফলন। এই জন্যেই, এই কথা বোঝাতেই লেখার আগে এত গৌরচন্দ্রিকা ফলাতে হল। আমার জীবনের, বিশেষত ডাক্তার জীবনের যা কিছু স্মরণীয় ঘটনা আছে, তার মধ্যে এই জর্দাপান খাওয়া একটি।
এবার ঘটনাটি বলি-
আমার প্রথম কোথায় পোষ্টিং ছিল এক গ্রাম্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পূব পাশেই ছিল হাই স্কুল, তার পাশে প্রাইমারি স্কুল। আমি যখন ছিলাম, তখন বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ ছিল দুই স্কুল মিলে। এখন অবশ্য মাঠের চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরা দেওয়া হয়েছে, তাতে লাভ কি হয়েছে জানি না- কিন্তু সেই খোলা হাওয়া আর নেই, আর খোলা মাঠে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটাকে যেমন আকাশের মত বড় করে দিতে ইচ্ছে করে, বদ্ধ জায়গায় বসে তা হয় না।
হাসপাতালের ছিল ছয় বিঘে জমি, তার পশ্চিম পাশে ছিল একটি বড় খেলার মাঠ, আর মাঠের গায়ে একটি দোতলা পাকা দালান, যেটি কোনও এক সময় লাইব্রেরি বা ক্লাবঘর হিসাবে ব্যাবহৃত হত। বৃন্দাবন সমিতির ভবন। সম্পূর্ণ এলাকাটি তৈরি করেছিলেন ক্যাপ্টেন ব্যানার্জী বলে পরিচিত এক ভদ্রলোক, যিনি আর্মির ডাক্তার ছিলেন। আর্মি থেকে রিটায়ার করার পরে তার মনে হল, এই গ্রাম্য, অনুন্নত এলাকার জন্যে কিছু করা যাক। তিনি কয়েকজন সঙ্গী-সাথীকে নিয়ে নেমে পড়লেন কোমরে গামছা বেঁধে। শুনেছি, আক্ষরিক অর্থেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষে করে এই সব করেছিলেন। তারপর যা হয়, তিনি বৃদ্ধ হলেন, সমিতির লোকের সাথে মনোমালিন্য হল, যে যা পারল ভাগাভাগি করে নিল। সব উন্নয়নমূলক কাজকর্ম গেল থেমে। অসুস্থ ক্যাপ্টেন ব্যানার্জী মাঝে মাঝে হেঁটে দুই কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে আমার কাছে কয়েকবার এসেছিলেন, কিভাবে এই সমিতিকে বাঁচিয়ে তোলা যায় সেই আলোচনা করতে। সে অন্য কথা, অন্যদিন বলব– আজকে জর্দার কথা।
সমগ্র এলাকাটি রাতের দিকে নির্জনই বলা চলে। এমনকি বিপদের সময়, বা আমার কোয়ার্টারে বসে যদি রাতে হাঁক দিই, গ্রামের তো কেউ শুনবেই না, আমার হাসপাতালের কোয়ার্টারের দু একজন ছাড়া কাউকেই পাওয়া যাবে না। হাসপাতালে থাকত কম্পাউন্ডার, দুইজন সিস্টার, একজন জি.ডি.এ. আর একজন সুইপার।
হাসপাতার চত্তর ছাঁড়িয়ে, স্কুলের মাঠ ছাড়িয়ে মাঠের শেষ প্রান্তে, পূব দিকে ছিল দুটি জরাজীর্ণ কোয়ার্টার। একটি সিঙ্গেল কোয়ার্টারে প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার জগবন্ধুবাবু সপরিবারে থাকতেন। অন্যটিতে ছিল দুজন শিক্ষকের থাকার ব্যাবস্থা। একদিকে থাকতেন নীলমনিবাবু, অন্য দিকে নুরুলবাবু। দুজনের মধ্যে চেহারা-চরিত্রে মিল খুব কম ছিল, কিন্তু আন্তরিকতা ছিল। আমার যেহেতু অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না, প্রতিবেশী হিসাবে সন্ধ্যাবেলা কাজের শেষে আমি যেতাম সেখানে। বেশিরভাগ সময়েই নীলমনিবাবুর কাছে, কারণ তিনি অবিবাহিত এবং সঙ্গীত নিয়ে থাকেন।
নীলমনিবাবুকে নিয়ে ভবিষ্যতে অনেক কিছু বলার আছে, আপাতত সংক্ষিপ্ত ভাবে তার পরিচয় দিই। তিনি স্কুলে অংক ও দরকারে বিজ্ঞান পড়াতেন। কিন্তু তার চেহারায় সেই ছাপ ছিল না। বেশ স্বাস্থ্যবান মাঝারি মাপের চেহারা, দাঁড়ি-গোঁফ কামানো, মাথার লম্বা চুল ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। সব সময় পরনে সাদা ধোপদুরস্ত ধুতি এবং সাদা পরিপাটি পাঞ্জাবি। কাঁধে সাদা উত্তরীয়। তিনি ছিলেন বেলুড়মঠের দীক্ষিত এবং অনুগামী। নিজে রান্না করে নিরামিষ খাবার খেতেন। অবিবাহিত। আমি যখন যাই, তখন তার বয়স চল্লিশের কোঠায়।
তবে, এসব ছিল তার বাইরের দিক- অন্তরে তিনি ছিলেন সঙ্গীত প্রেমী। এটুকু বললে কিছুই হয়তো বলা হয় না, সঙ্গীত ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান এবং সম্ভবত বাঁচার রসদ। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন অত্যান্ত সৌখিন। একটা বাজাজ স্কুটি নিয়ে সুদূর মগরা বাজার করতে যেতেন, আর সেখানকার সবচেয়ে ভাল দোকানের ভালো মিষ্টি কিনে এনে রাখতেন অন্যদের বা আমাদের খাওয়াবেন বলে। আমাদের বলতে আমি, ওখানকার ইউকো ব্যাঙ্কের তাপসদা, শৈলেশদা, উনার গানের গ্রাম্য শ্রোতার দল, তবলা বাজাতে আসা ভালকীর রবিনদা, বংশীবাদক নবীন– এছাড়াও বিভিন্ন লোক। নীলমনিবাবু চা কিনে আনতেন কলকাতার সুবলের দোকান থেকে। তেমনি সুন্দর করে চা নিজেই করতেন। সেই চা মুখের কাছে নিলে গন্ধে মন জুড়িয়ে যেত। তিনি ছিলেন যেমন মিষ্টভাষী, তেমনি বিনয়ী। আমি এমন লোক আর দুটি দেখিনি।
নীলমনিবাবু সব গান করতেন না। পুরানো দিনের গান, ক্লাসিক্যাল, নজরুল গীতি, শ্যামা সঙ্গীত, বিশেষত নজরুলের লেখা শ্যামা সঙ্গীত ছিল তার প্রিয় গান। প্রায় প্রতিদিনিই গানের আসর বসত সন্ধ্যেবেলা। একে একে পাশের নানা গ্রাম থেকে সঙ্গতকারীগন, শ্রোতারা এসে জড় হত। গান একবার শুরু হলে আর থামতে চাইত না। ভাঙ্গা কোয়াটারের ভাঙ্গা জানালা দিয়ে সুর ছড়িয়ে যেত মাঠ পেরিয়ে, ধানক্ষেত পেরিয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে। সে গানের এমনই যাদু, ওঠা যেত না।
অনেকদিন বলে বলে গান বন্ধ করাতে হত, কারণ তখন হয়ত অনেক রাত হয়ে গেছে, মাষ্টারমশায়ের নিজের রান্না হয়নি- এরপর রান্না করবেন, খাবেন। আমি সঙ্গীতজ্ঞ নই, কিন্তু ওখানে গিয়ে অনেক কিছু জেনেছি, অনেক নতুন গান শুনেছি, জেনেছি- কাজী নজরুল ইসলাম যত শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন, অন্য কোন হিন্দু সাধক বা সঙ্গীতকার তত গান লেখেননি। মাষ্টারমশায়ের গাওয়া গান এমনভাবে মর্মে ঢুকে গেছে যে সেই সব গানের অনেক কলি আমি আজও মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই গুন গুন করে গেয়ে উঠি।
পক্ষান্তরে নুরুলবাবু ছিলেন বিপরীতধর্মী। ধর্মে শুধু নয়, কর্মেও। চেহারায় গাট্টা-গোট্টা, ছোট চেহারার মানুষ। বেশিরভাগ সময়ে ঘরে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে থাকতেন। স্কুলে যাবার সময় পরতেন পাজামা আর পাঞ্জাবী। খেতে খুব ভাল বাসতেন, নিয়মিত পান খেতেন। পাশের গ্রামে বাড়ি হলেও তিনি দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে কোয়ার্টারেই থাকতেন। মাঝে মাঝে জমিজমার তদারকি করতে গ্রামে যেতেন। তার স্ত্রী, যাকে আমি ভাবি বলতাম- খুব ভাল রান্না করতেন। মাঝে মাঝেই নুরুলবাবু আমাকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন বা নীলমনি বাবুর বাড়ি গেলে ডেকে নিয়ে বাটিতে কয়েকটুকরো মাংস খাইয়ে দিতেন। কিছুটা লুকিয়ে, কারণ সাত্ত্বিক নীলমনিবাবু জানলে কিছু ভাবতে পারেন, এই ভয় তার ছিল। কি বিষয়ে পড়াতেন জানিনা, তবে সম্ভবত আর্টের কোনও বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। নুরুলবাবুর আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল- তার গলাটি ছিল কিছুটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা এবং কর্কশ ধরণের।
একবার সেই সময় আমার কাছে একটি পুরানো ‘বিসর্জন’-এর কপি হাতে আসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যনাটক। পড়ে আমি এত অভিভুত হই, প্রায় মুখস্ত করে ফেলি। তারপর হঠাৎ একদিন মনে হল, নীলমনিবাবুর আখড়াতে অনেক লোক আসে, তাঁদের সবাইকে নিয়ে এটি নিয়ে শ্রুতিনাটক করলে কেমন হয়? যেমন ভাবা- তেমন কাজ। অন্য কোনও কাজ নেই তো! রাতে গিয়ে নীলমনিবাবুকে বললাম। উনি এত ভদ্র, কাউকে কোনও বিষয়ে না বলবেন- এমনটি ভাবাই যেত না। উনি সানন্দে সম্মতি দিলেন। এবার শুরু হল চরিত্রের লোক জোগাড় করা। একটি নারী চরিত্র দরকার। অপর্ণার জন্যে। কে…কে…?
জগবন্ধুবাবুর মেয়ে আছে অপু- না, ওর গলাটা মানাবে না। শেষ পর্যন্ত পোষ্টমাষ্টার মন্টু বলল, তার এক সম্পর্কিত বোন ঝর্ণা এসেছে বৈঁচি থেকে। কিছুদিন থাকবে। সে ভাল গান গায়, এখানে এলে নীলমনিবাবুর কাছে নিয়মিত আসে। তাকে ডাকা হল একদিন- না, সত্যিই ঝর্ণার গলা খুব ভাল। স্কুলে নাটক করে- কাজেই তার একটি ধারণা আছে। তাকেই মনোনীত করা হল। রাজা হলেন নীলমনিবাবু। আমি জয়সিংহ। আমার কম্পাউন্ডার রাজার ভাই, নক্ষত্ররায়। আর রঘুপতি? একজনই হতে পারেন- নুরুলবাবু। বেশ কয়েকদিন রিহার্সাল করে আমার টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে নিলাম। রেকর্ডের সময় ব্যাকগ্রাউন্ড লাইভ মিউজিক দিলেন বাঁশিতে নবীন, তবলায় রবিনদা, হারমোনিয়ামে নীলমনিবাবু। নুরুলবাবু দূর্দান্ত করলেন রঘুপতির পাঠ। তার কন্ঠস্বরে এমন ভাব আনলেন- নীলমনিবাবুকে যেন সত্যিই বলি দিতে পারলে খুশি হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, আজ চৌতিরিশ বছর পর সেই টেপটি অনেকদিন দেখছি না। কোথায় আছে জানি না। খুঁজে পেলেও সেটি ভাল আছে কিনা তাও জানি না। খুঁজে দেখব একদিন।
ওখানে একা থেকে, নীলমনিবাবুর গান শুনে, সকলের সাথে পরিচয় হবার পর আমি যেন ওদের একজন হয়ে গেলাম। আমার প্রায় নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়াল নীলমনিবাবুর ওখানে রাতে যাওয়া এবং গান শোনা। যেদিন ওখানে যেতাম না, সেদিন পালবাবুর তাসের আখড়ায় যেতাম, যেদিন তাসের আখড়ায় যেতাম না, সেদিন যেতাম নীলমনিবাবুর গানের আখড়ায়। আর ওখানে গেলে নুরুলবাবুর বিবি, আমাদের ভাবি- আমাকে অন্য কিছু না খাওয়ালেও একটি করে পান খাওয়াতেন। তিনি এবং নুরুলবাবু নিয়মিত পান খেতেন।
ছোট বেলায় আমাদের ছিল গোটাকয়েক পানের বরজ, এদিক ওদিক মিলিয়ে শ’খানেক সুপুরি গাছ। পান খাওয়ার অভ্যেস আমার কোনদিনই ছিল না। তবে দু’একদিন ছোট বেলায় পানও খেয়েছি, সুপারিও খেয়েছি। কিন্তু নিয়মিত খাইনি- কারণ বাড়ির কেউই পান খেতেন না, তাই সেই ইচ্ছা কখনও হয়নি। তবে কাঁচা সবুজ সুপারি খেলে কিছুক্ষণ কেমন মাথার মধ্যে ঝিম মেরে থাকত, সে কথা মনে আছে। দু একদিন ইচ্ছে করেই কাঁচা সুপুরি খেতাম।
তবে পান খেতেন গয়াবুড়ি, আমার মায়ের মাসি। সে ছিল ছ্যাঁচা পান। গয়াবুড়ির বয়স কত, সে হিসেব নেই- তবে দাঁতগুলো পড়ে গিয়েছিল। তাই শক্ত সুপারি খেতে পারতেন না। একটা বাঁশের চোঙের মধ্যে পান আর কাটা সুপারি দিয়ে অন্য একটি বাঁশের বা কাঠের লাঠি দিয়ে আঘাত করে হামানদিস্তার মত পিষে পানসুপারিকে মিশিয়ে নরম করে নিতেন। তারপর সেটি তার দাঁতহীন মাড়ির মধ্যে দিয়ে চিবিয়ে খেতেন। পান, সুপারি আর একটু চুন বা খয়ের এবং দোক্তা দিয়ে যে অপরুপ বস্তু তৈরি হত, তা তিনি মুখের মধ্যে দিয়ে বেশ আরাম করে চিবোতেন। আমরা কাছে থাকলে তার একটু ভাগ পেতাম।
ভাবি আমাকে দিতেন সাদা পান। পান, অল্প সুপারি, কয়েকটি মৌরি এবং কখনও কখনও একটু চমনবাহারও থাকত তার সাথে। চমনবাহার দিলে পান মিষ্টি হয়ে যায়। আমি নিজেও এক সময় পানের দোকানে বসে পান বিক্রি করেছি। তাই জানি। মিষ্টি মশলার সাথে চমনবাহার আর একটু চাটনি দিলে অন্য একটা স্বাদ ও গন্ধ হয়- মিষ্টি পানের সেটাই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ভাবি শুধু চমনবাহারই রাখতেন। যদিও সাথে গোপাল সহ আরও নানা রকমের সুগন্ধি জর্দা ভাবির বাক্সে থাকত। তিনি নিজে এবং নুরুলবাবু খেতেন জর্দা পান।
একদিন পান সাজতে সাজতে আমাকে বললেন- ‘ডাক্তারবাবু, একটু জর্দা দেব পানে?’
আমি জানি না জর্দার কি স্বাদ বা নেশা! ইচ্ছে হল- দেখি পরখ করে, সবাই যখন খায়। বললাম- ‘অল্প করে দিন একটু। কিছু হবে না তো?’
“কি আর হবে। বেশ আরাম লাগবে’- বলে নিজেই একটা জর্দার কৌটা থেকে এক চিমটে মুখে দিয়ে বললেন- ‘আমি তো এই এতখানি করে খাই, আমার কিছু হয়েছে?’
তিনি অল্প একটু জর্দা আমার পানে দিয়ে বললেন- ‘গোপাল দিলাম। ঘুব কড়া নয়, খেয়ে দেখুন”
আমি পান মুখে দিলাম, দেখি প্রথমেই কেমন একটু মাথা কেমন করে উঠল। তারপর তেমন কিছু হল না। অন্য কোনও অসুবিধা হল না, শুধু মাথাটা একটু ঝিম মেরে থাকল।
এর পর কিছুদিনের জন্যে আমার মিষ্টি পান খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। চমনবাহারের বদলে হাল্কা জর্দা দিতেন ভাবি।
এমন একদিনের কথা। শীতকাল, সোয়েটার বা চাদর নিয়ে বেরোতে হয় রাতে। আমি একটি উলের চাদর গায় দিয়ে নীলমনিবাবুর আখড়ায় গিয়েছি রাতে খাওয়ার পরে। দু’তিনটে গান শুনেছি- এমন সময় পাশের কোয়াটার থেকে নুরুলবাবুর ডাক। বললেন- ডাক্তারবাবু একটু শুনুন।
আমি উঠে যাওয়ার পর ভাবি হাসিমুখে একটি সাজা পান ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। আমি নির্দ্বিধায় পান মুখে দিয়ে আবার নীলমনিবাবুর ঘরে বসেই টের পেলাম, গোলমাল কিছু একটা হয়েছে। মাথা টলতে শুরু করেছে। আমি বুঝলাম, কিছু একটা হতে চলেছে, অথচ কাউকে কিছু বলা যাবে না। যদি বলি শরীর খারাপ লাগছে, সবাই ব্যাতিব্যাস্ত হবে। তাই কোনওক্রমে নীলমনিবাবুকে বললাম- মাষ্টারমশাই, আজ যাই।
উনি গান থামিয়ে বললেন, ‘সে কি? আর একটু বসবেন না?’
বললাম ‘একটু কাজ আছে’। বলেই উঠে পড়লাম।
অন্য কাউকে আর কিছু বললাম না। উঠে বাইরে বেরিয়ে মনে হল, মাথা নয় সারা পৃথিবীই টলছে। আমার পা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পেট পাঁকিয়ে উঠছে। আমার বড়জোর দুশো ফুট দূরে। সেখানে যেতে যেতেই ঘামতে শুরু করলাম। সারা শরীর জুড়ে কেমন একটি অস্বস্তি হচ্ছে। কোনওক্রমে ঘরের চাবি খুলে আবার সেটি লাগিয়ে ঘরে ঢুকে আর পারলাম না। বুঝলাম জর্দা এতটাই দেওয়া হয়েছে, যা আমার সহ্যের বাইরে। আগে পেট থেকে এগুলো বের করতে না পারলে বড়কিছু হয়ে যেতে পারে। বাথরুমে গিয়ে গলায় হাত দিয়ে বমি করলাম যতটা পারি। মুখে জল দিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। শীত কোথায়? সারা শরীর গরম, ঘাম ঝরছে দরদর করে, বমি ভাব, পেটের মধ্যে অস্বস্তি, মাথা তুলতে পারছি না। কোনও মতে আলো নিভিয়ে ফ্যান চালিয়ে দিলাম। একে একে শরীর থেকে সমস্ত পোষাক খুলে ফেলে দিগম্বর হয়ে ঘরের মেঝেতেই শুয়ে পড়লাম। আমার খাটে ওঠার ক্ষমতা নেই।
ঘরের মেঝেতে আমি শুয়ে আছি, মাথার উপরে পাখা চলছে ফুলস্পিডে, বাইরে জনহীন ফাঁকা মাঠ, দূরে দূরে গ্রাম- হাসপাতালের সব স্টাফ ঘুমিয়ে পড়েছে, সকলের ঘরের আলো নেভানো। শুয়ে শুয়েও মাথা টলছে, আমার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেছে। আমি নির্জীবের মত চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম।
কতক্ষণ জানি না। তবে বেশ খানিক্ষণ পরে যেন মাথা টলা কমলো ধীরে ধীরে। ঘামও কমে এল। আমার বোধশক্তি ফিরে আসছে আস্তে আস্তে। তবুও আমি শুয়ে রইলাম একই ভাবে। খানিকক্ষণ পর আমার আবার শীত করতে লাগল। উঠে পাখা বন্ধকরে রাতের পোষাক পরে নিলাম। আলো জ্বাললাম। আবার বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে জল খেলাম অনেকখানি। যদি কিছু শরীরে ঢুকে থাকে, তবে তা বেরিয়ে যাবে। তারপর বিছানায় উঠে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি মুখের উপর আলো পড়েছে। না, আর তেমন কোনও আসুবিধা নেই। শুধু একটু দুর্বলতা আর মাথায় সামান্য অস্বস্তি।
সেই থেকে আমার জর্দাপান খাওয়া একেবারে বন্ধ। না, কেউ দিলেও একবার মোড়ক খুলে দেখি কি আছে, তারপর পছন্দ মত সুপারি বা মশলা রেখে বাকিটা ফেলে দিই।
আর ওই ঘটনায় মনে মনেও কাউকে দোষারোপ করিনি কোনও দিন, বরং অন্যরকম ভেবেছি। জীবনতো অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যেই, যে জীবন শাস্ত্র মতে ৮৪ লক্ষ জন্মের পরে পেয়েছি। এই অমূল্য জীবন হয়তো আর পাব না, তাই বৈরাগ্য নয়, চারিদিকে যেখানে যতোটুকু পাই- সব কিছুর সবটুকু রূপ-রস-গন্ধ গায়ে মেখে নেব। তাতেই আমার আনন্দ, তাতেই আমার মুক্তি। ভাল-মন্দ মিশিয়ে নানা অভিজ্ঞতার সমাহার এই জীবন, আর এই সব মিলিয়েই আমি, এই আমি।