বিখ্যাত ‘ফ্রানিংহাম হার্ট স্টাডি’ তে পাওয়া গেছে ডায়াবেটিস রোগীদের যে কোনো রকম হৃদরোগ সমবয়সী ডায়াবেটিস নেই এমন লোকদের তুলনায় অনেক বেশি হয়।
আমেরিকান ডায়াবেটিস সোসাইটির তথ্য বলছে, বিশ্বে রোজ প্রতি ২১ সেকেন্ডে একজন মানুষ নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগীই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যান। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ— এই দুটো বিষয় পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ ডায়াবেটিসকে করোনারি আর্টারি ডিজিজের সমতুল্য বলে দাবি করেছে। অর্থাৎ, ডায়াবেটিস নেই এমন রোগীর তুলনায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে হৃদযন্ত্রের সমস্যা অনেক বেশি দেখা যায়। পুরুষের ক্ষেত্রে এই সমস্যা দুই থেকে তিন গুণ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রায় চারগুণ। ডায়াবেটিসের কারণে অ্যাথেরোস্কেরোসিসের ফলে হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে ‘ব্লকেজ’ তৈরি হয়। তবে, শুধু হৃৎপিণ্ডের ধমনীতেই নয়, শরীরের যে কোনও অংশেই (পা, হাত, মাথা এমনকি কিডনিতেও) সেটা হতে পারে। অ্যাথেরোস্কেরোসিস এবং বিভিন্ন রকম কোলেস্টেরল নিয়ে পরবর্তী পর্বে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হবে।
ডায়াবেটিসের সাথে নিম্ন লিখিত রিস্ক ফ্যাক্টর গুলি হৃদরোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয়ঃ
১. ধূমপান।
২. স্থূলতা।
৩. উচ্চ রক্তচাপ।
৪. শারীরিক পরিশ্রম না করা।
৫. রক্তে লিপিডের গণ্ডগোল।(ট্রাইগ্লিসারাইড ও লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বেড়ে যাওয়া এবং ভালো কোলেস্টেরল বা হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন কমে যাওয়া)
৬. কিডনির সমস্যা।
যাদের ডায়াবেটিস টাইপ-২ হয়েছে, তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সম্ভাবনা অনেক বেশি। একই সাথে রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা, দৈহিক স্থূলতা ইত্যাদির সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ, ৮০ শতাংশ রক্তে লিপিডের অস্বাভাবিকতা ও ৮০ শতাংশ দৈহিক ওজন-জনিত সমস্যায় ভোগেন। এসব রোগ একই সূত্রে বাঁধা এবং এদের একত্রে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ বলে। এইসব রোগের মূল কারণ শরীরের বিভিন্ন কোষের ইনসুলিন রেজিটেন্স তৈরি হওয়া।
সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাকঃ
ডায়াবেটিসে আরো একটি মারাত্মক ঘটনা ঘটে। ডায়াবেটিস রোগীরা অনেক হার্ট অ্যাটাকের তীব্র ব্যথা অনুভব করতে পারেন না।ডায়াবেটিস আমাদের স্নায়বিক অনুভূতিকে ভোঁতা করে দেয়। যার ফলে অন্যদের মতো হৃৎপিণ্ডে সমস্যা হলে বুকে ব্যথা বা চাপ লাগা, ঘাম হওয়া অথবা পরিচিত উপসর্গগুলি তাঁদের প্রায় হয়ই না।এমনকি অনেক সময় কোনো উপসর্গ ছাড়াই অনেকের হার্ট অ্যাটাক হয়। ফলে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়ে যায় বা আদৌ শুরু করা হয় না। ফলে রোগীরা মারাত্মক জটিলতায় ভোগেন বা মৃত্যুবরণ করেন।
হৃদপিণ্ডের ধমনি ব্লকেজ হয়ে হার্ট অ্যাটাক শুধু নয়, ডায়াবেটিস থেকে হৃৎপিণ্ডের পেশি দুর্বল হয়ে ডায়াবেটিক কার্ডিয়াক মায়োপ্যাথি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের অন্যদের তুলনায় হার্ট ফেলিওর অনেক বেশি হয়।
তাছাড়াও ডায়াবেটিসে মস্তিষ্কে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় তিন গুণ বাড়ে।
চিকিৎসাঃ
রিস্ক ফ্যাক্টর গুলি এড়িয়ে চলা। যেমন ধূমপান বন্ধ করা, জীবনযাপনে শৃঙ্খলা, পরিমিত ও প্রয়োজনীয় পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত এবং সঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ, দৈহিক ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ও পরিমিত শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম করা ইত্যাদি।
রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের এইচবিএ১সি (HbA1C) ১ শতাংশ কমানো গেলে ডায়াবেটিস সংশ্লিষ্ট মৃত্যুহার প্রায় ২১ শতাংশ কমবে এবং হার্ট অ্যাটাক কমবে প্রায় ১৪ শতাংশ।
ডায়াবেটিসে রক্তচাপ তার সমবয়সী অন্য মানুষের চেয়ে কম রাখতে হবে। তাদের জন্য আদর্শ রক্তচাপ হলো <১২০/৭০ মিলিমিটার পারদ। রক্তচাপ ঠিক রাখতে পারলে ডায়াবেটিস জনিত কিডনির জটিলতা অনেকটাই কমানো যেতে পারে। একইসাথে স্ট্রোক, ডায়াবেটিসে মৃত্যু, হার্ট ফেলিওর ও অন্ধত্বের হারও কমবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীর রক্তচাপ ১০ মিলিমিটার পারদ কমানো গেলে ডায়াবেটিস সংশ্লিষ্ট মৃত্যুহার প্রায় ১৫ শতাংশ কমবে, হার্ট অ্যাটাক কমবে প্রায় ১১ শতাংশ।
ডায়াবেটিস ছাড়াও রোগীদের হৃদরোগ হওয়ার আর কোনও রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলেই স্ট্যাটিন জাতীয় লিপিড কমানোর ওষুধ দেয়া উচিৎ। এমনকি লিপিড প্রোফাইল না করিয়ে অথবা লিপিড প্রোফাইল স্বাভাবিক থাকলেও দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে এতে হৃদরোগের ঝুঁকি যথেষ্টই কমে।
হৃদরোগ থাকলে সাথে সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।