ডায়াপার র্যাসের বাংলা কি? কিছু কিছু ইংরাজীর বাংলা করা সত্যি কঠিন। ডায়াপার বললে অনেকেই বুঝতে পারবে না, যদি বলি হাগিস- প্রায় সবাই বুঝবে। অথচ ‘হাগিস’ হল একটি বিশেষ কোম্পানীর ডায়াপার। এই ডায়াপার পরিয়ে শিশুর ত্বকে যে র্যাস বের হয়, বা চামড়ার অসুখ হয়, তাকেই আমরা ডায়াপার র্যাস বলতে পারি। র্যাসের অর্থ, ত্বক লাল হয়ে ঘা মত হয়ে যাওয়া, বা ফুস্কুড়ি ওঠার মত হওয়া। সাধারণ অর্থে, ডায়াপার পরিয়ে শিশুর পাছায় বা সামনের দিকে যে লাল লাল র্যাস হয়- তাকেই ডায়াপার র্যাস বলা হয়।
কি হয়?
- শিশুর পাছায়, থাইতে বা জননাঙ্গে, যে সব যায়গা ডায়াপার দিয়ে ঢাকা থাকে, সেখানে লাল হয়ে যায়। বেশি হলে ঘা হয়ে যেতে পারে, এমনকি রক্তও বের হতে পারে।
- কখনও কখনও উপরের ত্বক শক্ত ছালের মত হয়ে ফাটা ফাটা হয়ে যেতে পারে।
- অন্য ভাবেও বোঝা যেতে পারে- দেখা যায় যখনই শিশুর ডায়াপার পরিবর্তন করা হয়, তখন সে কাঁদে বা তার অস্বস্তি হয়। শিশু অস্থির হয়ে যায়। এ ছাড়া ওই জায়গায় যখনই হাত দেওয়া হয়, শিশু কাঁদতে থাকে।
- অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত নরম ত্বকে ব্যাকটিরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটে, তখন তার চেহারা অন্যরকম হয়ে যেতে পারে।
কি করে বোঝা যাবে ছত্রাকের সংক্রমণ হয়েছে?
- র্যাসযুক্ত এলাকাটি ফুলে যাবে এবং ত্বকের উপর সাদা সাদা ছোপ দেখা যাবে।
- র্যাসের বাইরের দিকে লাল লাল ফুস্কুড়ি হতে পারে।
- ত্বকের ভাঁজ লাল হয়ে যাবে এবং স্যাঁতসেঁতে হয়ে ফোলা ফোলা হয়ে যাবে।
ডায়াপার র্যাসের কারণঃ
- মলমূত্রঃ শিশুকে ডায়াপার পরিয়ে রাখলে ডায়াপারে মল-মূত্র লেগে থাকে। দুটোই এসিডিক। মল আরও বেশি এসিডিক। এগুলো যদি দীর্ঘক্ষণ ডায়াপারে লেগে থাকে এবং শিশুর নরম ত্বকের সংস্পর্শে আসে, তাহলে ত্বকে র্যাস হতে পারে।
- বেশি ঘষাঘষিঃ যখন টাইট ডায়াপার পরানো হয়, তখন সেই ডায়াপার শিশুর নরম ত্বকের সাথে ঘষা খায় এবং এর ফলেও র্যাস হতে পারে।
- নতুন পোষাকের জন্যঃ অনেক সময় নতুন পোষাকের কাপড় শিশুর সহ্য হয় না। পোষাকে যদি ডিটারজেন্ট বা কোন ফ্যাব্রিক লাগানো থাকে, বা পোষাকের অন্য কোনও উপকরণের জন্যেও র্যাস হতে পারে। তাই র্যাস হলে শিশুকে নতুন পোষাক পরানো হয়েছে কি না, তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- ব্যাকটিরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণঃ ডায়াপার ঘেরা জায়গাগুলো প্রায়ই ভিজে এবং স্যাঁতসেঁতে থাকে। আর অনেক সময় মল, মূত্র ডায়াপারে লেগে থাকে। মল মূত্রের মধ্যে অনেক ব্যাকটিরিয়া ও ছত্রাক থাকে। এই ভিজে পরিবেশ ছত্রাক ও ব্যাকটিরিয়া জন্মানোর পক্ষে সহায়ক। তাই সহজেই ডায়াপার ঘেরা জায়গাগুলোতে এদের সংক্রমণ ঘটে। এ ছাড়াও ত্বকের ভাঁজে ভাঁজে সংক্রমণ ঘটতে পারে। সংক্রামিত জায়গাগুলো লাল, সাদাটে (ছত্রাকের ক্ষেত্রে) অথবা গুটি গুটি হয়ে যেতে পারে।
- খাদ্য-খাবারঃ স্তনদুগ্ধ পান করা শিশুদের মলের সঙ্গে তার মায়ের খাবার বিষয়টি জড়িত । মা যদি এমন কিছু খায়, যা মায়ের হজম হয় না, তখন শিশুর মলের পরিবর্তন হবে। এ ছাড়া বয়স্ক শিশুরা যখন শক্ত খাবার খায়, তাদের মলের পরিবর্তন ঘটে। তারা বার বার মলত্যাগ করতে পারে, ল্যাকটজ ইন্টলারেন্স থাকলে শিশুর মলে এসিডের মাত্রা বাড়ে। সব মিলিয়ে ডায়াপার র্যাস শিশুর ও তার মায়ের খাদ্যাভ্যাসের কারণেও বাড়তে পারে।
- ত্বকের সংবেদনশীলতাঃ শিশুর ত্বক খুবই নরম ও সংবেদনশীল। বাইরের যে কোনও ধরনের অত্যাচার বা চুলকানিতে ত্বকের ক্ষতি অনেক বেশি হয়। যাদের একজিমা বা ‘সিবোরিক ডার্মাটাইটিস’ আছে, বা হাঁপানি আছে, তাদের ত্বক অনেক বেশি সংবেদনশীল। তাদের ক্ষেত্রে এই র্যাস বেশি হয় বা সহজে হয়।
- এন্টিবায়োটিক খাওয়ানোঃ যদি কোনও কারণে শিশু এন্টিবায়োটিক খায়, তবে ডায়াপার র্যাসের সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক এন্টিবায়োটিকের কারণে মল পাতলা হয়, আবার এন্টিবায়োটিক উপকারি ব্যাকটিরিয়া ধ্বংস করে, ফলে ছত্রাকের সংক্রমণ বেড়ে যায়। স্তনদুগ্ধ পান করা শিশুর মা যদি এন্টিবায়োটিক খায় তবেও শিশুর মল পাতলা হতে পারে ও র্যাস বাড়তে পারে।
- সাবান বা ডিটারজেন্টঃ যখন শিশুর কাপড় বা প্যান্ট ডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করা হয়, তখন সেই ডিটারজেন্টে যদি ঠিকমত ধুয়ে ফেলা না হয়, সে জন্য শিশুর র্যাস হতে পারে। সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
- অন্য কারণঃ মনে রাখতে হবে, মল স্বাভাবিক ভাবেই এসিড। যদি কোনও কারণে হজম না হয় বা পাতলা পায়খানা হয়, তবে এসিডের মাত্রা বাড়ে। তার জন্যে শিশুর নরম ত্বকে ঘা হতে পারে বা ত্বক লাল হয়ে যেতে পারে। ডায়াপার না পরালেও যাদের পাতলা পায়খানা হয়, সেই সব শিশুর মলদ্বারের চারপাশে লাল হয়ে যেতে পারে, র্যাস হতে পারে বা ঘা ও হতে পারে। তেমন হলে বাড়াবাড়ি হওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কি করলে ডায়াপার র্যাস হবে না?
- বার বার ডায়াপার পরীক্ষা করুন ও দরকারে পালটে দিন।
- ডায়াপার পাল্টানোর সময় শিশুকে জলে ধুইয়ে পরিষ্কার করুন, যেন কোনও ময়লা লেগে না থাকে। পরিষ্কার করার সময় বেশি ঘসাঘসি করবেন না, হাল্কা করে নরম কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করার পর শুকনো, নরম তোয়ালে দিয়ে শিশুকে মুছিয়ে দিন, যেন কোন জল লেগে না থাকে। শুকিয়ে গেলেই আবার দরকারে ডায়াপার পরাবেন।
- খুব টাইট করে ডায়াপার পরাবেন না। তাতে শিশুর নরম ত্বকে ঘষা লাগে, আর হাওয়া বাতাস চলাচল না করলে স্যাঁতসেঁতে ভাবও বেশি থাকে। সহজে র্যাস হয়।
- সব সময় ডায়াপার পরাবেন না। চেষ্টা করুন যত কম সময় ডায়াপার ব্যবহার করা যায়।
- নিয়মিত ভাবে শিশুর জন্যে স্কিন লোশান ব্যবহার করুন। ডায়াপার র্যাস না হওয়ার জন্যে নানা রকম লোশান পাওয়া যায়। কিছু না থাকলে ত্বক নরম রাখার জন্যে অলিভ অয়েল বা নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। তবে কোন রকম গন্ধতেল ব্যবহার করবেন না।
- ডায়াপার বদলানোর পরে আপনার হাত ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিন। হাতে যদি নোংরা কিছু বা কোনও জীবাণু থাকে, তবে শিশু সংক্রামিত হতে পারে।
ডায়াপারের বিকল্পঃ
কিছুদিন আগে পর্যন্ত কোনও ব্রান্ডেড ডায়াপার ছিল না। এমনকি কোনও ডায়াপারই ছিল না। এখনও গ্রামের দিকে ডায়াপারের ব্যবহার সব সময় হয় না। সে ক্ষেত্রে নরম সুতোর কাপড়ই বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে ভাল হয় যদি পুরানো সুতির সাদা ধুতি বা শাড়ী বা ওই ধরনের নরম কাপড় পাওয়া যায়। নতুন কাপড়ে মাড় থাকে, তাই বার বার ধুয়ে নিয়ে সেই কাপড়ের মাড় ছাড়িয়ে নরম করে নিতে হবে। যে কাপড়ই ব্যবহার করা হোক না কেন, ব্যবহারের আগে ভাল করে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
কাপড়কে চারকোনা করে ছোট করে কেটে নিতে হবে। তারপর ভাঁজ করে তিন কোনা করে নিয়ে শিশুর পিঠের নীচে দিয়ে তাকে পরিয়ে দিয়ে হবে। বিষয়টি খুবই সহজ ও অল্প ব্যয়ে হয়ে যায়। স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। এ ছাড়াও তিন কোনা করে কাপড় কেটে তার পাশটা সেলাই করে দিলেও হয়।
কাপড়ের ডায়াপার কি করে পরিষ্কার করতে হবে?
কাপড়ের ডায়াপার বা ন্যাপকিন ব্যবহার করলে সেগুলো যথাযথভাবে পরিষ্কার করা দরকার যাতে জীবাণুমুক্ত হয়। নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভাল হয়-
- বেশি ময়লাযুক্ত কাপড় আগে ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে রাখুন।
- তারপর হাল্কা ডিটারজেন্ট এবং ব্লিচিং দিয়ে গরম জলে ধুয়ে ফেলুন। ব্লিচিং জীবাণু ধ্বংস করে। দুর্গন্ধ থাকলে একটু ভিনিগার মিশিয়ে দিলে গন্ধ চলে যায়।
- এবার ভাল করে বার বার পরিষ্কার জলে ধুয়ে সমস্ত রাসায়নিক ধুয়ে ফেলুন, কাপড়ে যেন কোনও রাসায়নিক লেগে না থাকে।
- কোন সুগন্ধী জিনিস ব্যবহার করবেন না, তাতে শিশুর এলার্জি থাকতে পারে এবং ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চিকিৎসাঃ
শিশুর ক্ষয়ে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত ত্বককে যথাসম্ভব নরম রাখতে হবে। এ ছাড়া ত্বকে এমন কিছু লাগানো যেতে পারে, যাতে ত্বক মল-মূত্রের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং ত্বক সহজে মল-মূত্রের সংস্পর্শে না আসে।
- জিঙ্ক অক্সাইড বা পেট্রোলিয়াম জেলি জাতীয় মলম লাগানো যেতে পারে।
- বেবী পাঊডার লাগানো যেতে পারে, যদি বেশি র্যাস না হয়। র্যাস হয়ে ঘা হলে পাউডার লাগালে সেই পাউডার শুকিয়ে গিয়ে ত্বকে টান ধরতে পারে। আর পাউডার লাগানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন মুখে না যায়। অনেকেরই এতে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
- ছত্রাকের সংক্রমণ হলে ছত্রাকনাশক ক্রিম লাগাতে হবে।
- বেশি খারাপ অবস্থা হলে ডাক্তারের পরামর্শমত এন্টিবায়োটিক মলম বা স্টেরয়েড লাগানো যেতে পারে।
আরও কিছু দরকারি কথাঃ
- ডায়াপার পরিবর্তনের সময় ভাল করে হাত ধুতে হবে।
- ডায়াপার পরানো থাকলে বার বার পরীক্ষা করতে হবে, শিশু সেটি ভিজিয়ে দিল কি না দেখতে হবে।
- পরিষ্কার করার সময় স্বাভাবিক জল ব্যবহার করতে হবে।
- পরিষ্কার করার সময় ঘষাঘষি করা যাবে না। জল দিয়ে পরিষ্কার করে তারপর নরম কাপড় দিয়ে হাল্কা করে জল মুছিয়ে নিতে হবে।
- সম্পূর্ণ একালাটি শুকিয়ে গেলে তারপর নতুন ডায়াপার পরাতে হবে।
- এলকোহল বা সুগন্ধী জাতীয় কিছু ব্যবহার করা যাবে না।
ডায়াপার র্যাস নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার কিছু নেই। র্যাস যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। র্যাস দেখা দিলে বা বাড়তে থাকলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।