গল্পটা সকলেই জানেন।
ছোটবেলায় যখন হামাগুড়ি দিতাম আমরা বা যখন একটুখানি হাঁটতে শিখেছি, তখন বারবার পড়ে গেছি! হয়তো কোন কিছুতে পা লেগে বা এমনিই কোন কিছুর উপর পড়েছি। এখনো বাচ্চারা এমনি পড়ে যায়।
আমাদের বাড়ির বড়রা কি করতো বা এখনো বড়রা কি করে??
দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিত বা নেয়। তারপরও যদি বাচ্চার কান্না না থামে, তাহলে কি করতো বা করে??
ভাবুন তো! বাচ্চাকে দেখিয়ে দেখিয়ে চেয়ার টেবিল বা মেঝেকেও মেরে দিত বা দেয়! বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, বাচ্চার ব্যথা ওতে না কমলে ও, বাচ্চা ভাবে ওটাই বোধহয় তার শত্রু, এবং তাকে যেহেতু মারা হয়েছে, বাচ্চার কান্না বন্ধ হয়ে যেত বা যায়!
তাহলে এটাও এক ধরণের চিকিৎসা হলো তো?? হলো!
বটমলাইন – যদি না আঘাত খুব মারাত্মক আকারের হয়!!!
কি কিউট, তাই না?? একটি ফাঁকিও দেওয়া গেল! ব্যথার আসল কারণ না বাচ্চা বলতে পারলো না আপনি খুঁজলেন!
ভাবছেন, চিকিৎসার বিবর্তন নিয়ে বলতে এসে হঠাৎ কিসের গপ্পো ফাঁদলাম?
আসছি আসছি। সবই রিলেটেড। বিজ্ঞানের বিবর্তনের যত গল্প আছেল, তত গল্প আর কারো কাছে নেই!!
চলুন, এবার একটু ঘুরে আসি সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডে। সবাই জানেন, আমাদের দেশের চেয়ে বেশ আগে ইংল্যান্ড বা অন্য দেশে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছিল। তৎকালীন রাজা মহারাজারা এই কাজে বেশ সহযোগিতা করতেন।
একটি গল্পকে আমি সাজালাম।
ডিউক অফ বাকিংহাম বসে আছেন সিংহাসনে। তখন সে দেশে চলছে গৃহযুদ্ধ। মূলতঃ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলই ছিল উদ্দেশ্য। সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ধর্মীয় কারণও! ক্যাথলিকরা এক্ষেত্রে বেশ উগ্রই ছিল।
তো এরকম যুদ্ধ চলাকালীন সবদিনই একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতো আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। যে যেমন পারে লতা পাতা তাবিজ কবচ ইত্যাদি ব্যবহার করতো। কিন্তু তাতে মোটেই কাজের কাজ হতো না।
ডিউকের এমন চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখে এগিয়ে এলেন একজন বিখ্যাত সভাসদ! শুধু সভাসদ বললে ভুল হবে, তিনি তৎকালীন ইংল্যান্ডের একজন বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোলজিস্ট, দার্শনিক, বিখ্যাত রোমান ক্যাথলিক, এবং সবচেয়ে বড় কথা – একজন তথাকথিত বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ (?)!
তাঁর উপাধি ছিল – Ornament of the nation! এহেন মহাপুরুষের নাম ছিল Sir Kenelm Digby!
তিনি ডিউকের সামনে এসে প্রায় অলৌকিক বাবাদের মতো দাবি করে বসলেন! কি দাবি? বললেন – আহতদের ক্ষতগুলোর চিকিৎসার জন্য তিনি একটি গোপন মহৌষধি পাউডার পেয়েছেন। তাও আবার ফ্লোরেনসের একজন সন্ন্যাসীর কাছ থেকে!! অবশ্যই তাঁর নামধাম গোপন রাখলেন ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে!!
(খেয়াল করুন, বাবাদের গল্পের মতো লাগছে না খানিকটা?
কোন গবেষণা নেই, গোপনে অনামী সন্ন্যাসীর থেকে স্বপাদেশ পাওয়ার মতো হঠাৎ ওষুধ পেয়ে গেলেন! আমাদের দেশেও এমন হয়! মানুষ খেতে না পাক ক্ষতি নেই, কিন্তু চিকিৎসা না পেলেই চিন্তায় বাবারা নিজেদের বগলের চুল ছিঁড়তে থাকেন! তারপর হঠাৎ একটা মহৌষধি পেয়েও যান!!)
অতএব, হইহই রইরই কাণ্ড! ডিগবির মতো একজন পরিচিত মুখ যখন এই দাবি করে বসেছেন, তখন তো কিছু একটা সারবত্তা থাকবেই!!
ডিউক বললেন – আচ্ছা ডিগবি, এতো সুখবর। কিন্তু মুখের কথায় তো আর মানা যাবে না। তুমি প্রমাণ দাও!
কারণ, সে দেশে অন্ততঃ বাবাকে মানতে গেলেও যে খানিক বিজ্ঞানসম্মত ক্ষমতা দরকার, সেটা রাজা বিশ্বাস করতেন।
(আমাদের দেশে এখনো যেটা লাগে না!)
ডিউক, একাধারে জ্ঞানী, তার উপর এমন দাবী করে বসেছেন, খালি পকেটে তো আর আসেননি! সামনে নিয়ে এলেন নিজের পোষ্য সেক্রেটারিকে!
বললেন- এই আমার নিজের সেক্রেটারি, যার শরীরে ঘা হয়েছিল, আমার ই মহৌষধি পাউডার দ্বারা নিরাময় হয়েছে!!
এবার ভাবুন, একে তো ডিউকের প্রিয় সভাসদ, অত বড় জ্ঞানী , তার উপর হাতে গরম প্রমাণ (একজন হলেও বাবার ভাষায় ট্রায়াল বলা যায়!) নিজের সেক্রেটারিকে সারিয়ে তুলেছে – রাজা হোন বাদশা হোন, হাতে বিকল্প কিছু না থাকলে বিশ্বাস না করে আর যাবেন কোথায়??
(ভাবুন, আজকের দিনে যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান রয়েছে, সেই অবস্থায়ও রাজা-মহারাজারা এরকম বাবাদের পায়ে মাথা ঠোকেন মহৌষধি পেতে!)
অতএব, মহাবিজ্ঞানী ডিগবির আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেল – মহৌষধি পাউডার!! একখানা গালভরা নাম দিয়ে তার দেদার বিজ্ঞাপন দেওয়াও চললো মিডিয়ায় – পাউডার অফ সিমপ্যাথি!!
এতোদূর এসে অব্দি একবার জিজ্ঞেস করবেন না – কি সেই মহৌষধি পাউডার?? আর কিভাবেই বা সেটা কাজ করতো বা কাজে লাগানো হতো??
করবেন না জানতাম, কারণ এতোক্ষণ অব্দি তো মোটামুটি একটা যুক্তিগ্রাহ্য অপবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের রহস্য গল্পের মতোই সাজিয়ে দিয়েছি!
এবার এখানে থেমে গেলে এটাকে আরামসে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেয়া যায়! তার উপর পিঠে যদি রাজার হাত থাকে, তাহলে তো কথাই নেই!!
এবার প্যানডোরা’স বক্স খুলি তাহলে? ডিগবির এই পাউডার আসলে কি ছিল?
ফেরাস সালফেট বা গ্রীণ ভিট্রিয়ল!! সেটাকে জলে গুলে ফের রোদে শুকিয়ে নেয়া হতো! খানিকটা পাউডার মতোই দেখতে হতো!
তাতে কি? এতো পুরো বিজ্ঞানের গল্প!
এবার বলি পদ্ধতি। ডিগবি মহাশয় রুডল্ফ গক্লেনিয়াস বলে একজন পণ্ডিতের জ্ঞান ধার করে, বলা ভালো চুরি করে শুরু করেছিলেন চিকিৎসা। কোন একজন রোগীর, ধরা যাক তরোয়াল বা বর্শার আঘাত আছে বা পেরেক ঢুকে গেছে বা কেউ গুলি করেছে! ডিগবি বললেন – যে জিনিসে আঘাত লেগে রোগীর শরীরে ক্ষত হয়েছে, মহৌষধি “গুঁড়ো” লাগাতে হবে সেখানে!! মানে তরোয়াল বা বর্শা বা পেরেক বা বন্দুকে!!! আর রোগীর শরীরের ক্ষত একটা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে!! তাহলেই কেল্লাফতে!!
চমক লাগলো??
তো এই পদ্ধতি চললো বহুদিন!!
আজ একজন অশিক্ষিত মানুষ অব্দি বলে দেবে – মালটা শিওর কুড়ি টাকার পাউচ খাওয়া মাতাল ছিল!!
কিন্তু, ক্ষত কি সারেনি?? সেরেছিল অবশ্যই! না হলে রাজা মানতো না!!
কিভাবে??
শরীর নিজে থেকে সারিয়ে তুলতে পারে অনেক বড় বড় ক্ষতও!!হ্যাঁ, কোন চিকিৎসা ছাড়াই!! আজও!! যদি না সেই আঘাত খুব মারাত্মক ভাবে কোন অঙ্গের ক্ষতি করে বা অন্য কোন কমপ্লিকেশন যেমন ইনফেকশন হয়!!
এই পদ্ধতিরই আরেকটি রূপ ছিল – weapon salve। যেখানে কোন রোগীর ক্ষত সারাতে ক্ষত থেকে রক্ত আর ফ্যাট কাপড়ে পেঁচিয়ে যে অস্ত্র বা জিনিস দ্বারা ঘা হয়েছে, তার গায়ে পেঁচিয়ে দেওয়া হতো!! বহু পণ্ডিতও সেটাকে সাপোর্ট করেছেন!!
তখন না ছিল জার্ম থিওরি, না ছিল এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, না ছিল বডির নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে সামান্য কোন জ্ঞান!! অতএব, ডিগবি মহাশয় এর powder of sympathy চলেছে রমরমিয়ে!! Weapon salveও চলেছে রমরমিয়ে!!!
কি বুঝলেন এতোক্ষণে?
একটুখানি পাউডার অফ সিমপ্যাথি দিয়ে কোন সাধারণ রোগ বা মরণাপন্ন মানুষকে যদি সত্যিই বাঁচানো যেত, তাহলে বিজ্ঞান ওতেই পড়ে থাকতো!! এক পাও এগোতো না!!
অবশ্য এখন মনে হয়, এরকম পাউডার কিছু বড় বড় রোগীদের (যাঁরা নিজেদের চিকিৎসায় নিজেদের মহৌষধি ব্যবহার করেন না, অথচ অন্যকে দেওয়ার জন্য পাগল!) চিকিৎসায় ব্যবহার করা উচিত !
কি বলেন??
বিজ্ঞান এসব পাউডার অফ সিমপ্যাথিকে এমন ভাবে রগড়ে দিয়েছে যে, একসময় সেটাকে আর কোথাও লাগানোর কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি মানুষ!!
অথচ কি অবাক কাণ্ড! হাজার বছরের পুরনো পদ্ধতিকেও একবারও বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই না করে আপনি ব্যবহার করে ফেলছেন! তাও এমন একজনের কথা শুনে – যে নিজেই দ্বিচারিতা পূর্ণ এবং স্বঘোষিত ব্যবসায়ী বাবা!!
এবার এরা যখন নানারকম পাউডার অফ সিমপ্যাথি ছড়িয়ে আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছে, তাদের কাছে জানতে চাইবেন না – ডিগবির তো সেক্রেটারি ছিল, তুমি বাবা সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে কেউ চেনে না এমন একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে কি এমন গবেষণা করলে যে দাবি করছো- সবার অসুখ সারিয়ে দেবে??
জানতে চাইবেন না – করোনার কোন স্পাইকে কি কি পাউডার লাগালে যে, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা পারলো না, আর তুমি করোনার থেকে একদম গ্যারান্টি আদায় করে নিলে রোগ সেরে যাবে??
প্রশ্ন করুন! নিজের বাঁচার জন্য করুন!!
বিজ্ঞানের বুকপকেটে তো দূরের কথা, জাঙ্গিয়ার পকেটেও এরকম সহানুভূতির পাউডার থাকে না!! তাকে প্রতিদিন আরো উন্নত কিছু খুঁজে বের করার তাগিদে ছুটতে হয় – সামনের দিকে।
আপনি যদি ছোট্ট শিশু না হন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিবর্তন যদি মানেন, নিজের বিবর্তন যদি মানেন, তাহলে অবশ্যই বিশ্বাসের উপর ভরসা না করে প্রশ্ন করবেন!! প্রমাণ চাইবেন – যেটা পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা করলেও একই ফলাফল আসবে!! উপকার করবে!!সহানুভূতির পাউডারে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল হয়ে থাকবেন না!!গ্যারান্টি!
অবশ্য গণতান্ত্রিক দেশে ইচ্ছে হলে কুল থাকতেই পারেন! বলা তো যায় না – কিছু টাকা পেলে বাবারা হয়তো আপনাকে না দিয়ে একদিন করোনাকেই পাউডার অফ সিমপ্যাথি মাখিয়ে চীনে পাঠিয়ে দেবেন!!
হেঁ হেঁ হেঁ