ঝাপ্টিবাড়, ডাহুকমারা, দূরাভাঙ্গা, বেদ্রাবাদ। নাম গুলো শুনেছেন? না এগুলো কোনো গাছগাছড়া বা পশুপাখির নাম নয়। এগুলো কিছু জায়গার নাম। আমরা দায়সারা করে যে অন্চলকে উত্তরবঙ্গ বলে ডাকি এগুলো সেই এলাকাতে। এখানেও মানুষ থাকেন। তাঁদেরও রোগ বালাই হয়। নাম কা ওয়াস্তে হাসপাতাল থাকলেও থাকে না কারেন্ট। রাতে পেশেন্ট আসেন হ্যাজাক ঝোলানো ভ্যান রিক্সায়। পাটাতনে শুয়ে। চিকিৎসকরাও সেখানে নিজের কাজ করেন যথাসাধ্য। সরকারি বাসস্থানে তাঁর রুমমেট কিছু হৃষ্টপুষ্ট টিকটিকি। আর পড়শি বলতে কাঁঠাল গাছ দাপানো খান কয়েক ভাম। থাকার মধ্যে বছরভর টিউকলের জল। আর বর্ষাকালে তো জলই জল। ঘর ভর্তি, হাঁটু অবধি। কয়েকটা দিন থেকে আসবেন না কি রোমান্চকর এই ঝাপ্টিবাড়িতে। না কি নিরীহাসুরের লেখা, গায়ে কাঁটা দেওয়া সে সব গল্প পড়েই ক্ষান্ত দেবেন। উপরি বোনাস লোকাল ডায়ালেক্ট।
ভনিতা ছেড়ে এবার মেন লাইনে ঢোকা যাক। এ এক অভিনব সংকলন। ব্যতিক্রমী ঊদ্যোগও বলতে পারেন। এক নয়, দুই নয়, একসঙ্গে একত্রিশ জন চিকিৎসকের দিনলিপি ধরা রয়েছে দুই শক্ত মলাটের বাঁধনে। এনারা কেউ বনফুলের মতো কিংবদন্তী লেখক নন। নর্ম্যান বেথুনের মতো ফ্রন্টলাইন যুদ্ধক্ষেত্রে সেবা করার অভিজ্ঞতাও কারো নেই। তবে এনারা কেউ কাজ করেছেন বাংলাদেশ সীমানায় যেখানে কাঁটাতারের বেড়াও থাকে না। আলপথ বেয়ে একটু এগোলেই বিদেশভ্রমণের সৌভাগ্য। কারও দিন কেটেছে খাস জঙ্গলমহলে। আবার কেউ থেকেছেন এমন প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে থাকতে বললে শহুরে মানুষ নাক সিঁটকোবেন। প্রতিটি ঘটনা উঠে এসেছে বাস্তব জীবন খেকে। কাজের ফাঁকে ঘটে যাওয়া আপাত-নৈমিত্তিক ঘটনা গুলোর মধ্যে এনারা গল্প খুঁজে পেয়েছেন। নিজস্ব ভঙ্গিতে সে গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। প্রতিটি গল্পেই আছে কিছু বার্তা, কিছু টেক হোম মেসেজ।
মৃত্যুর মত ধ্রুবসত্য তো মানুষের জীবনে আর দ্বিতীয়টি নেই। তবু মৃত্যু নিয়ে আমরা সবাই ভাবি। ডাক্তারবাবুরা হয়তো একটু বেশিই ভাবেন কারণ সেখান থেকে তাঁরা শিক্ষা পেতে চান। দূরারোগ্য ব্যাধিতে বয়স আঠারোর ডেবি চিরতরে চোখ বুজলে ডাক্তার দার্শনিকের অবস্থান নেন। গল্পগুলো আলাদা। স্থান, কাল, পাত্র আলাদা। গল্পকারদের বয়সও ভিন্ন। তাঁরা “চিকিৎসক একাদশ” বা এ ধরণের কোনো নাম নিয়ে কোনো টিমগেম খেলেন নি। তবু প্রায় প্রতিটি লেখাই তারুণ্যের তেজে অভিন্ন। পলিটিক্যাল কারেক্টনেস এর ধার ধারেন না। মাফিয়া-দুস্কৃতির বন্দুকের সামনেও অপারেশন করেন সমান পারদর্শিতায়। অথচ তাদের লেজুড়বৃত্তি করেন না। উল্টে রাজনৈতিক নেতার চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। আবার রোগীর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আবেগ অশ্রু একাকার হয়ে যায়।
মালদার গ্রামীণ হেল্থ সেন্টার। ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম ডাক্তার স্ক্যালপেল হাতে মধ্যরাতে যমরাজের মোকাবিলা করেন। আর রোগীর আত্মীয়স্বজন পাঁচ সেলের টর্চ লাইট ধরে আলোর অভাব পূরণ করেন।
এদের কাহিনী পড়বো না তো কি ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট অ্যাক্টের ধারা উপধারা কপচাবো! রোমহর্ষক এসব গল্পেও পাঠককূল যে সাহিত্যরসে বন্চিত হবেন না সে টুকু দায়িত্ব নিয়ে বলা যায়। ভাষার প্রান্জল্য ও স্থানীয় ভাষ্যের সুনিপুণ ব্যবহারও তাক লাগানোর মতো। রোগী চিকিৎসক সম্পর্কের অম্ল ও মধুর দুটো দিকই ধরা পড়েছে বইটায়। একদিকে অপারগ পেশেন্ট ফি এর পরিবর্তে হাজির করেন আস্ত মোরগ বা ব্যাগ ভর্তি জ্যান্ত কাঁকড়া। আবার অন্যদিকে কিছু অতিসক্রিয় মানুষ কোভিড সন্দেহে চিকিৎসককে একঘরে করেন।
প্রাণ বাঁচানো যাঁদের পেশা তাঁদের গল্প প্রাণের কাছাকাছি হওয়াই স্বাভাবিক। গর্ভপাত করানো হয়তো কোনো চিকিৎসকের কাছেই সুখকর কাজ নয়। তবে পরিজনের লালসার শিকার যে অবুঝ কিশোরী, তার গর্ভপাতের সময় চিকিৎসকের মানসিক টানাপোড়েন কেউ কি ভেবে দেখেছেন? রক্তে ভেসে যাচ্ছে চতুর্দশী। অজ্ঞান করার সুবিধা অমিল। তবু ভ্রূণমোচন না করলেই নয়। জাগ্রত অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন শেষে বালিকা চপ মুড়ির অফার ফিরিয়ে যখন মোম রঙ আর আঁকার খাতা চায় ডাক্তার তাঁর আবেগকে বাগে রাখতে চান। আবার অন্যগল্পে সন্তানধারণে অক্ষম নারীর স্বামী একান্তে ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করেন তিনি পুনর্বিবাহযোগ্য উপযুক্ত বীর্যবান পুরুষ কিনা। ডাক্তার এখনও ভেবে চলছেন তাঁর উত্তর কি হওয়া উচিত।
প্রকাশ্যে নিজের ভুল স্বীকার করা তো আজকের সমাজে আউট অফ ফ্যাশন। চিকিৎসকরাও তো সেই সমাজেরই অংশ। কিন্তু এই বইয়ে যে একজন দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করলেন “আমার ভুলে মারা গিয়েছিলেন এক রোগিনী….”! তিন দশক আগের ঘটনা। স্বাস্হ্য পরিষেবা তখনও ক্রেতা সুরক্ষা আইনের আওতায় ছিল না। থাকলে কি হতো জানা নেই। তবে অনুতপ্ত চিকিৎসক সে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। পরবর্তী পেশেন্টরা তার সুফল পেয়েছেন। আবার একই লেখক সঠিক পরিকাঠামোর অভাব উপেক্ষা করে, উপযুক্ত সরন্জাম ছাড়াই জরুরি অবস্থায় কিভাবে মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন তার কাহিনীও শুনিয়েছেন। আসলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে এনারা এক এক জন সত্যিকারের হিরো। যেমন এক সাপ-পাগল চিকিৎসক শুনিয়েছেন তাঁর দরদ দিয়ে ডাক্তারির কথা। সাপের কামড়ে কোথাও একটি মানুষেরও মৃত্যু হলে যার মন খারাপ হয়ে যায়।
শুধুমাত্র রোগের চিকিৎসাতেই থেমে যেতে চান নি অনেকেই। চেয়েছেন রোগের মূলে আঘাত করতে। মাইকেল মার্মটের মত এই অসম বিশ্বে বিরাজমান “হেল্থ গ্যাপে” এনারা বিচলিত। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেছেন নিজের পেশাকে। স্নেহ ভরে চিকিৎসা করেছেন দেহোপজীবিনির। মৃত্যুর খবর পেয়ে বৃদ্ধ ডাক্তার একবার শেষ দেখা দেখতে হাজির হয়েছেন পতিতালয়ে। অথবা লকডাউনের সময় চিকিৎসক দম্পতি এক দিনে জনা পন্চাশেক যৌনকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ আখ্যান না পড়লে আধুরা থেকে যাবে জিন্দেগী। গাত্রবর্ণ নিয়ে আমাদের অবসেশান রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মেয়ের রং ফর্সা করার জন্য শ্যামলাবরণ মা যখন তিন মাসের শিশুকন্যাকেও বারংবার সাবান জলে স্নান করাচ্ছেন চিকিৎসকের মনে পড়ছে “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার”।
বাঙালী মননে হয়তো আদর্শবান চিকিৎসক বলতে এখনো রূপোলী পর্দার অগ্নীশ্বর মুখোপাধ্যায়ই বিরাজ করেন। তবু সদ্য পাশ করা ডাক্তার যখন লকডাউনে পরিবার ছেড়ে একটানা চার মাস হাসপাতালেই থেকে যান তাকেও কি অগ্নীশ্বর বলবেন না? রোগীর অবস্থার অবনতিতে ভেঙ্গে পড়েন এই তরুণ। আবার ভালো হলে উল্লাস করেন। শুধু ওষুধ পথ্য নিয়ে নয়, রোগীর পাশে দাঁড়ান সর্বতোভাবে। পরিবর্তে রোগীও খুঁজে পান তাঁর জীবনের আইকন। কথোপকথন নির্ভর রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের অনন্য নজির পাই আর এক অসামান্য প্রাবন্ধিকের কলমে। রোগী হয়তো তথাকথিত মেঠো ভাষাতেই কথা বলবেন। কিন্তু সে ভাষা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব তো সেবা প্রদানকারীই। গ্রহীতার নয়। ডাক্তারি শিক্ষায় ভাষার গুরুত্ব যে কতখানি তার বর্ণনা পাই বিভিন্ন ঘটনাক্রমে।
“ডক্টর্স ডায়েরি” হতে পারে একটি পাঁচমিশালি সংকলন। তবে খন্ডচিত্র নয়। একটি জীবন্ত কোলাজ। আউটডোরে বসে থাকা ব্যক্তি মানুষগুলোর মধ্যে ডাক্তার নিজস্ব জবানিতে খুঁজে পান অখন্ড ভারতবর্ষ। হয়তো আপনিও পাবেন।এখানে আদিবাসী বুড়ি দিয়েছেন ডাক্তারির প্রথম পাঠ। এনারা মাটির কাছাকাছি থাকা কিছু চিকিৎসক। গম্ভীর মুখে খচখচ করে প্রেসক্রিপশন লিখে যাঁরা দায়িত্ব খালাস করেন না। এনারা কথা বলেন ওয়ার্ডের বাইরে অপেক্ষমান পরিজনের সাথেও। গল্প খুঁজে পান প্রতিভাবান বেহালাবাদকের স্নায়ুদৌর্বল্যের সফল চিকিৎসায়, কর্পোরেট হসপিটালে কাজ করতে আসা ভিন্ রাজ্যের নার্সের জীবনে কিংবা দুর্গাপূজোর সময় মৃত্যুমুখী কিশোরীর ফোলা হাতে চুড়ি পরার অদম্য চেষ্টায়। তবে শুধুমাত্র সিরিয়াস কালেকশন ভেবে ভুল করবেন না। শেষ পাতে চাটনীর ব্যবস্থাও আছে। রোগী উবাচে হাস্যরস। আছে কৌতুক ভরা টোটকা। তাতে অবশ্য টাকে চুল গজায় না। এসব পড়তে গিয়ে যদি কেউ সামান্য আঘাত পান তার জন্য আছে “বঙ্গ জীবনের অঙ্গ” বোরোলীনের নিদান। তাও আবার ঈষৎ গরম করা।
সব শেষে প্রণতি প্রকাশনীর কথা না বললেই নয়। প্রিন্ট থেকে প্রচ্ছদ সব কিছুতেই মুন্সীয়ানার ছাপ। সম্পাদনাতেও রয়েছে গভীর ভাবনা চিন্তার নিদর্শন। ১৭৬ পৃষ্ঠার বই পড়ে ফেলতে লাগতে পারে কাপ দুই তিন চা-কফি। পড়ে ভালো তো লাগবেই। হয়তো কিছু অভিযোগও থাকবে। আমার যেমন মনে হলো নেতাজি ইনডোরে রাতভর বিভিন্ন শিল্পী সমন্বয়ে একটা জলসা শুনলাম। কেউ শোনালেন জনপ্রিয় আইটেম নম্বর। কেউ বা ধ্রুপদী। তারপর ভোর বেলায় আয়োজকদের গাল পাড়তে বেরিয়ে এলাম। আর্টিস্টদের আরো একটু বেশি করে সময় না দিলে চলে! আর সেখানেই শিল্পীদের সাফল্য। আয়োজকদেরও।