একটি হাতুড়ে প্রতিবেদন
ফাল্গুনী সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কৃষ্ণপক্ষের প্রথম প্রহরে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠেছে পলাশ শিমুলের ফুল জঙ্গল। বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে সাথীহীন হাতুড়ে বিস্তীর্ণ ঢেউ খ্যালানো মাঠের দিকে আনমনে তাকিয়ে ছিলেন। বহুদূর থেকে একটা এলোমেলো সঞ্চারমান টর্চের আলো এগিয়ে আসছে। বাংলার মাস্টার মুস্তাক আহমেদ আসছেন।
আসার কথা ছিলো। আজ কলকাতায় গেছিলেন। হার্ট বিশেষজ্ঞের কাছে। হাতুড়ে আলো লুকিয়ে রাখা ম্রিয়মান লন্ঠনটার শিখা বাড়িয়ে খবরের কাগজ ঢাকা টেবিলে স্থাপন করলেন।
মাস্টারের সঙ্গে এসেছেন ওনার স্ত্রী সাবিনা বৌদি। বৌদি ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করলেন “আচ্ছা, দাদা হার্ট ব্লকটা কি জিনিস?”
লন্ঠনের আলোয় হিজাবের পেছনে উদ্বিগ্ন চোখদুটি আর স্খলিত আঁচলের ফাঁকে পূরন্ত নতমুখী একটি স্তন দৃশ্যমান হয়।
মাস্টার বড়ো ভালো বাংলা পড়ান। একদিন পড়ন্ত বৈশাখে হাতুড়েকে জীবনানন্দ বোঝাচ্ছিলেন। “আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে শীত-রাত্রিটিরে ভাল …..নরম জলের গন্ধ নদী বারবার তীরটিরে মাখে….” ভালবেসেছি অথচ উনি উল্টে নিলেন বেসেছি ভালো তারপর মধ্যে দিলেন কর্মবাচ্যটা গুঁজে আর নদী আর জল যেন আটা নদীর গন্ধ দিয়ে তাদের মাখা হচ্ছে …”দূরে আজানের ডাক আসে আসহাদ আল্লাই লাহ’ ইল্লাহ ..”।
আজ সেই মাস্টার আর তার উদ্বিগ্ন স্ত্রী হাতুড়ের সামনে। আজ কবিতা নেই শুধু ভয়— মৃত্যুভয় …
হাতুড়ে বলতে আরম্ভ করেন “বৌদি, হার্ট ব্লক বলতে কিন্তু হার্টের আর্টারিতে ব্লক বোঝাচ্ছে না। ওটাতে আর্টারি ময়লা জমে বন্ধ হয়ে যায়। তখন প্লাম্বার দিয়ে লাইন পরিষ্কার করতে হয় অথবা নতুন পাইপ লাইন বসাতে হয়। কিন্তু মাস্টারের যেটা হয়েছে সেটা ইলেকট্রিক লাইনে গন্ডগোল।”
পরিষ্কার কৃষ্ণপক্ষ সন্ধ্যায় হাটুরে রবি বাড়ি ফিরছে দেখা যায়। গলায় কাছা- সদ্য পিতৃহারা। বেচারা পেটের জ্বালায় বাবার কথা ভাবতে সময় পায়নি। পেট চলে প্লাস্টিক বাসনের দোকান থেকে। দোকান বন্ধ তো পেট বন্ধ। অনেক পেট। ওর বাবা ফেরার সময় হাতুড়ের ঘরে একটু জিরিয়ে জল বিড়ি খেয়ে দুটো দুঃখের গল্প করে তারপর যেতো। সে পর্ব শেষ হলো।
মুস্তাক আহমেদ ভাই প্রশ্ন করে “ইলেকট্রিক লাইন মানে? বুঝলাম না যে….”
হাতুড়ের নিশ্বাস দখিনা বাতাসকে উষ্ণতর করে তোলে, “শোনো মাস্টার, আমাদের শরীরের ভেতরে একটা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আছে। তাপ বিদ্যুৎ বা জল বিদ্যুৎ নয় এখানে ইলেকট্রোলাইট থেকে নার্ভ বিদ্যুৎ তৈরি করে”
সাবিনা বৌদি অবাক হতে ভুলে যান “বিদ্যুৎ উৎপাদন … কী বলচো তুমি হাতুড়ে ভাই?”
হাতুড়ে নিজে একটা সিগারেট ধরান। হেসে বলেন “মাস্টার তুমি এটা টানলেই ফুটে যাবে গ … আমি সব কাজ শেষ করে বসন্ত শেষের গান গাইছি তাই আমি ধূমপান করি … তারপর শোনো ঐ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটা থাকে হার্টের ডান দিকের একদম ওপর বাগে – হার্টের পেছনে লুকানো…. এটাকে এস এ নোড বা পেস মেকারও বলা হয়”
বৌদি- আমাদের উতলা কবি মুস্তাকের প্রেমে পাগল বৌদি বলেন “ঐ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটা খারাপ হয়ে গেছে?”
হাতুড়ের ধূমপান একটু রাজকীয় – দূর দিগন্তে চক্ষু মেলে আপন সুখে সাদাকাঠিতে টান দ্যান। তারপর হাতুড়ে ফিরে আসেন আবার আলোচনায়। “ ঐ কেন্দ্র থেকে একটা তার একটা সাব স্টেশনে আসে। তার নাম এভি নোড, এখানেই বিদ্যুৎ পরিবহনের ব্যবস্থা হয়। এখানে লাইন ভাগ হয়। একভাগ ডাইনে যায় অন্য ভাগ বাঁয়ে। এরা আবার যেতে যেতে ছোটো ছোটো ভাগ করতে করতে যায় …”
“ওর অসুবিধাটা কোথায়?” সাবিনা বৌদির মাথায় হিজাব নাই বরং চোখে লড়াই করার আগুন আছে। কার সঙ্গে লড়াই করবি রে তুই বালিকা? শত্রু অনেক কুটিল।
“মাস্টারের সাব স্টেশন মানে এভি নোড খারাপ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ হার্টের আসল জায়গাগুলোয় পৌঁছচ্ছে না” জীবনানন্দ আর ধানশিরিটির তীরে ফিরে আসার কবিতা বলা মাস্টার মৃত্যুর মুখ কি তুমি দেখিয়াছ?
মুস্তাক ফিসফিস করে প্রশ্ন করেন “ভাই, তাহলে আমার হার্টটা চলছে কি ভাবে?” মুস্তাকের প্রশ্নে একটু অবিশ্বাস খেলা করে।
হাতুড়ে সিগারেটে (মৃত্যুদূত জেনেও) শেষ সুখ টানটি দিয়ে বলে “সবটুকু প্রকৃতির অদ্ভুত কার্যকলাপ বুঝলা, মুস্তাক? হার্ট তো বড়ো দরকারি তাই সব কিছু লোডশেডিং হলেও – আলো না থাকলেও একটা ব্যবস্থা আছে। যেটা দিয়ে হার্ট কয়েকটা দিন কোন রকমে নিজেকে চালিয়ে নিতে পারে। এই সময়টুকু তোমার হাতে আছে… এই সময়টাতে ইডিওভেন্ট্রিকুলার রীদমে হার্ট চালু থাকে”
মুস্তাক নতুন ডেস্কটপ কিনেছেন। বলেন “কম্পিউটারের ইউ পি এস য্যামন?”
হাতুড়ে নিশ্চিন্তির হাসি হাসেন “অবশেষে বুঝেছো তাহলে?”
সাবিনা বৌদি লন্ঠনের হলদে শিখার দিকে তাকিয়ে বলে “আর্টারির মতোন এই ইলেকট্রিক লাইনটা সারানো যায় না?”
হাতুড়ে মাথা নাড়েন “না, বৌদি। এই লাইনটা তো কনসীলড লাইন তাই এই লাইনে মেরামতি নাই”
মুস্তাক বলেন “তাহলে?” বলে দম বন্ধ করে থাকেন।
“না গো মাস্টার। আবার নতুন করে উৎপাদন কেন্দ্র আর ইলেকট্রিক লাইন বসাতে হবে – মানে পেস মেকার ..”
“ওকে কতদিন থাকতে হবে হাসপাতালে?”
“মোটামুটি তিন চার দিনের বেশী নয়…. দশ মিনিটের ছোট্ট কাজ … টেরও পাবে না হে”
মুস্তাক কৃষ্ণ ফাল্গুনীর পঞ্চমী সন্ধ্যায় উচ্চারণ করতে থাকেন আর তার চোখ দিয়ে অবিরল জল গড়িয়ে পড়ে “যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়; যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে- ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে, যখন চড়াইপাখী কাঠালীচাঁপার নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে ….উরে ব্বাপ রে …”
শেষটুকু জীবনানন্দ লেখেন নি। মাস্টারের পাছুতে হাতুড়ের সজোর লাথিতে শব্দটি উৎসারিত হয়েছে। সাবিনা দুই বন্ধুর মারামারি দেখতে অভ্যস্ত।
হাতুড়ে গজগজ করতে থাকেন “যাচ্ছে শালা ফোড়া কাটার মতো একটা কেস করতে …. এমন কাব্য আওড়াচ্ছে য্যানো ক্ষুদিরামের বাবা …ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছে …”
মুস্তাক হাসে “ঠিক আছে হাতুড়ে ভাই, বদলা লুঙাই লুঙা ওয়াপস আনে দো..”