আজকাল মন ভালো থাকেনা, জানিনা সত্যই আমার সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট গুলোই এতো হতাশায় ভরা নাকি পৃথিবীটা সত্যিই এতো উগ্র, নিষ্ঠুর, অনুভূতিহীন হয়ে উঠছে মাঝেমাঝে বুঝে উঠতে পারিনা। পৃথিবী জুড়ে নৃশংস ঘটনা ঘটছে, এ হয়তো আমরা আটকাতে পারবোনা কিন্তু সেই ঘটনার পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করতে করতে মানুষ কি করে শিশু মৃত্যুর ভিডিও দেখেও উল্লাস করে আমি সত্যিই জানিনা। এই সাদা কালো পৃথিবীতে এই নৃশংস মানুষের দল যদি নিজেদের মানসিক ভাবে সুস্থ বলেই দাবী করেন, তবে আমার মনে হয় পারিপার্শ্বিক বিচ্ছিন্ন, নিজের জগৎ এ ডুবে থাকা, মানসিক “অসুস্থ” মানুষেরা বরং ভালো আছেন, নিজের জগৎ-এ সুখেই আছেন।
যাই হোক, দিনের মধ্যে যেটুকু সময় সবকিছু ভুলে থাকি তা নিজের বাচ্চার সাথে খেলা করে আর রুগীর সাথে কথা বলেই সম্ভব হয়, ভাবছি লিখে রাখবো সেসব অতি সাধারণ তুচ্ছ কথোপকথন, এই অন্ধকার উগ্র হিংসার পৃথিবীতে একটু স্নিগ্ধ বাতাস বুঝি তারাই দিতে পারেন, অন্তত আমাকে, এই লেখাগুলো তাই নিজের জন্যই লিখছি।
ছেলেটাকে প্রথম দেখি একটা হোমে, ভর্তি ছিলো। নেশা করতোই সাথে ওর আছে schizoaffective disorder… যখন প্রথম দেখি তখন সে “কাল ভৈরব” এর সাথে কথা বলে (auditory hallucinations), সেই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছেলেটা মোটামুটি বাড়ির সবার জীবন অসহ্য করে দিয়েছিলো। কিন্তু সে ছিলো সম্পূর্ণ নিজের রচিত জগৎ-এ, খুশি। রাগ কন্ট্রোল করতে পারতো না,হিংস্র হয়ে উঠতো মাঝেমাঝেই, বাবা কে মেরেছে অনেকবার। তারপরে হোমে। সেই হোমে সে অনেক মাস থাকলো, তারপরে কিছুদিনের জন্য বাড়ি গিয়েছিলো। বাড়ি গিয়েই ওষুধ বন্ধ করে দিয়ে আবারও প্রায় একই অবস্থায় ফিরে আসে সেই হোমে।
দ্বিতীয় বার ওর বাবার চোখে এক চরম অসহায়তা দেখেছিলাম। উনি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছেন। ভয় পাচ্ছেন নিজের ছেলেকেই। বলছেন দরকার হয়ে আমি সারাজীবন খরচ চালাবো কিন্তু আর বাড়ি নিয়ে যাবোনা। ছেলের ভয়ে উনি নিজেই নাকি তিনদিন বাড়ি ঢোকেন নি।
আরো কয়েকটা মাসের চিকিৎসার পরে, ছেলেটি বাড়ি ফিরেছে। এর মাঝেই আমার প্রেগন্যান্সি, বাচ্চা হওয়া।
এখন সে একাই আসে দেখাতে। পড়াশোনা করছে, চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে। ওর বাবাকে ফোনে ধরেছিলাম সেদিন, বললেন, “ওকে সব বুঝিয়ে দিলেই হবে ম্যাডাম, ও এখন একদম ভালো আছে “। যে ছেলেকে উনি একদিন বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই রাজি ছিলেন না, আজকে সেই ছেলের উপর অগাধ ভরসা ফিরে এসেছে দেখে সত্যিই খুশি হলাম।
মহেশ (নাম পরিবর্তিত) যতবারই আসে আমার ছেলের খোঁজ নেয়, এবারও জিজ্ঞেস করেছে, ম্যাডাম আপনার ছেলে এখন হাঁটতে পারে? একটা ওই ওয়াকার কিনে দিতে পারেন, ছুটে বেড়াবে। আমি রোজগার করলে আমিই কিনে দিতাম। বলে সরল হাসলো।
মাঝেমাঝে কিভাবে যেনো রুগীদের কিছু কথা একটা স্নিগ্ধ বাতাসের মতন মনভালো করা অনুভূতি এনে দেয়… আমার বিশ্বাস ও একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবেই… এই যে ওর সাফল্য, ওই আমার পরম প্রাপ্তি হয়ে থাকবে।
মাঝেমাঝে ভাবি কি করতে যে ডাক্তার হয়ে ছিলাম। তারপর মনে হয় প্রতিদিনের এই টুকরো টুকরো কথোপকথন, এই এক একটা মানুষের জীবনের গল্প শোনা, এক একটা মানুষের উত্তরণের সাক্ষী থাকা, এইসব ছাড়া কি নিয়েই বা বাঁচতাম?